Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা

gub lib3জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞানের প্রয়োগ— উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য। যদিও বাংলাদেশ এ লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট। যোগ্যতা ও মেধা এখানে বিবেচ্য নয়। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রকট। উপাচার্যদের দেয়া হয়েছে অবাধ ক্ষমতা, যা তারা প্রয়োগ করেন ক্ষমতাসীনদের সমর্থনে। সর্বোপরি সুশাসনের অভাব রয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তৈরি হচ্ছে না গ্রহণযোগ্য নতুন ধারণা। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানে উন্নীত হতে পারছে না দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই। তারা ঢুকতে পারছে না বিশ্বের প্রথম সারির ১০০ এমনকি ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও। যদিও সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ১০০ ছাড়িয়েছে।

chardike-ad

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (এআইবিএস) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে গত বছর একটি জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করে। সম্মেলনে উচ্চশিক্ষার নানা সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রারসহ দুই শতাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা তাদের মতামত তুলে ধরেন। ওই মতামতের ভিত্তিতে সম্প্রতি ‘উচ্চশিক্ষায় কৌশলগত ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর নেতৃত্ব’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এআইবিএস।

মানসম্পন্ন শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা শিক্ষকের। কিন্তু উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ মানসম্পন্ন শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এআইবিএসের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনাই এখানে মুখ্য, মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে যা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিলের ৯০ শতাংশের বেশি আসে ইউজিসি থেকে। যদিও এ তহবিলও পর্যাপ্ত নয়। এ তহবিলের বণ্টনও সঠিকভাবে হয় না। এর ওপর রয়েছে আর্থিক নানা অনিয়ম। এসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে এআইবিএস বলছে, আর্থিক বিষয় ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর ইউজিসির কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই।

যোগাযোগ করা হলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও অনিয়ম রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা। ইউজিসির বর্তমান কাঠামো দিয়ে তা সম্ভব নয়। তাই ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে। এটি সম্পন্ন হলে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সব নিয়োগই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে করা যাবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় সরকার ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি যে স্বাভাবিক বিষয়, তা স্বীকার করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত হস্তক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দেয়া ক্ষমতাকে বাড়াবাড়ি রকমের বেশি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। আর এ ক্ষমতা তারা ব্যবহার করেন সরকারের সমর্থন নিয়ে। শিক্ষকদের মধ্যে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার প্রবণতাও উচ্চশিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশের জন্য বাধা হিসেবে দেখা হয়েছে প্রতিবেদনে। কারণ শিক্ষকদের এ প্রবণতা কখনো কখনো শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা পরিবেশকে জটিল করে তোলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিভিন্ন সংকট রয়েছে। তবে এর সমাধানে কাজ চলছে। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ পেয়ে থাকি। এছাড়া শিক্ষার মান অনেকাংশেই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতার ওপর। তাই শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিকেও ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও মূল্যায়নের যে পদ্ধতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুসরণ করে তা ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া দেশে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল এখনো গড়ে ওঠেনি, যার মাধ্যমে শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করা সম্ভব হয়।

জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতিকে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছে এআইবিএস। তারা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাকে এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নেই নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই অনুপস্থিত শক্তিশালী ও কার্যকর অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। পাশাপাশি ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে লৈঙ্গিক সমতার ঘাটতি রয়েছে।

অবকাঠামোর ঘাটতির কথা বলা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগেরই নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই। যেগুলোর আছে, তারাও ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলা হয়েছে, বোর্ড অব ট্রাস্টির হাতেই এখানকার সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। যদিও উচ্চশিক্ষার উত্কর্ষের দিকে মনোযোগ নেই অধিকাংশেরই। তাদের প্রভাবে বিদ্যাপীঠের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হচ্ছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লাভজনক নাকি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, সেটিও স্পষ্ট নয়।

জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেসের ইমেরিটাস প্রফেসর হাফিজ জি এ সিদ্দিকী বলেন, মানসম্মত শিক্ষায় অনিশ্চয়তা আছে— এ বিষয়ে আমি একমত। আর এর কারণ একাধিক। শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা যেমন আছে, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে প্রতিষ্ঠাতার চাপ। ফলে কেউ ভালো পড়াতে পারছেন না। আবার ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিলেই যে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে তা নয়, শিক্ষক মনোযোগের সঙ্গে প্রস্তুতি নিয়ে বরাদ্দ সময়টির পূর্ণ ব্যবহার করছেন কিনা, তা তদারকিরও কোনো ব্যবস্থা নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন কাঠামোয় বৈষম্য আছে— মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানুষ বলেই চাহিদা পূরণ না হলে শিক্ষকেরও আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় না। এছাড়া আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত কারণ। এক্ষেত্রে বলা যায়, ক্রমেই ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বয়ংক্রিয় শিক্ষা ব্যবস্থা নেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলেও তা অপ্রতুল। আবার গবেষণার ঘাটতিও ভালো শিক্ষক না পাওয়ার অন্যতম কারণ। সার্বিকভাবে বলা যায়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানের দৈন্য আছে। বাস্তবতা হলো পৃথিবীর সব দেশেই এ অবস্থা বিরাজমান।

দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান এসব সংকট উত্তরণে বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি গবেষণা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের নিয়মিত প্রকাশনা, মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে এআইবিএস। সবশেষে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ইউজিসিকে আরো শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চমানে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় দলীয়ভাবে, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। নিয়োগের পর পদায়নের ক্ষেত্রে আগে গবেষণা ও উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন হলেও এখন আর তার প্রয়োজন পড়ছে না। সবকিছুই হচ্ছে দলীয়ভাবে, যা গবেষণাকে নিরুত্সাহিত করছে। এছাড়া শিক্ষার বাইরে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনেরও বিকল্প নেই।

বণিক বার্তা