Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গ্র্যাজুয়েট রিকশা পেইন্টার

tonmoy1প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা না পেয়েও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন যেসব রিকশাচিত্রশিল্পী, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকেই রিকশাচিত্রকে তন্ময়ের কাজের  মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়া।

রিকশা আমাদের সাধারণের একটি অতি পরিচিত ও প্রিয় একটি বাহন। হয়তো সে কারণেই এর সব কিছুতেই সাদামাটা একটি বিষয় থাকে। এমন কী এর পেছনে যে চিত্রগুলো দেখা যায়, সেগুলোতেও আঁকা থাকে সাধারণ মানুষের প্রিয় চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের ছবি। ফলে এ সাদামাটা বিষয়গুলো কবে যে আমাদের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা আমরা নিজেরাও জানি না। আর সে ঐতিহ্যের খোঁজে রিকশা নিয়ে আজকাল চলছে নানা গবেষণা। এমনকি প্রতিদিন চার চাকার গাড়ির ভিড় বাড়তে থাকা এ শহরে একসময় যে ঘোড়ার গাড়ির মতো রিকশাও থাকবে গুটিকয়েক, সে চিন্তায় ভবিষ্যতে রিকশার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

সে যা-ই হোক অজানা আতঙ্কে এখনই আতঙ্কিত না হয়ে রিকশার কথা যখন এল, তখন এর পেছনে শোভা পাওয়া চিত্রকর্ম নিয়ে চিন্তিত এক তরুণের কথা শোনা যাক। যে তরুণ অনেক বেশি কৃতজ্ঞ দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা রিকশা চিত্রশিল্পীদের প্রতি। তাই তো একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা না পেয়েও যে শিল্পীরা আজো তাদের কাজ নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের লক্ষ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের স্নাতকোত্তর প্রথম পর্বের শিক্ষার্থী তানজিব হোসাইন তন্ময় রিকশাচিত্রকেই তার কাজের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

chardike-ad

tonmoyনোয়াখালী জেলার দ্বীপ অঞ্চল হাতিয়ার ছেলে তন্ময় ছোটবেলা থেকেই যে স্বপ্ন দেখতেন শিল্পী হবেন, এমনটা নয়। তবে পারিবারিক পরিবেশ, বিশেষ করে বড় ভাইয়ের সান্নিধ্যে কবে যে আঁকাআঁকির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন নিজেও জানেন না। বাবা ব্যবসা আর মা চাকরি করার কারণে বাসায় ফিরতে দেরি হতো বলে প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তেন তন্ময়। ফলে বাবা-মা বাসায় ফিরলে সবাই একসঙ্গে খাবে, এই লক্ষ্যে তন্ময়কে জাগিয়ে রাখতে গল্প বলতেন তার বড় ভাই। কিন্তু গল্প যে শুধু মুখেই বলতেন, তেমনটি নয়। ছবি এঁকে এঁকে কল্পনার সব রাজা-রানী আর দৈত্য-দানবকে হাজির করা হতো তার সামনে। শুধু তাই নয়, মা যখন তন্ময়কে পড়াতেন, তখন আগ্রহ তৈরি করতে তিনিও আঁকার ছলে তন্ময়কে শেখাতেন অ আ ক খ। এভাবেই কাটে তন্ময়ের শৈশব। বড় ভাইয়ের আঁকাআঁকির অভ্যাস আর পারিবারিক পরিবেশের কারণে তন্ময় একসময় চিন্তা করেন আঁকাআঁকি নিয়েই তিনি পড়াশোনা করবেন। এভাবেই নোয়াখালী জিলা স্কুল আর হাতিয়া দ্বীপ কলেজের পাঠ চুকিয়ে তন্ময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার উদ্দেশে যাত্রা করেন ২০১১ সালে। সেখানে এক বছরের মতো পাঠ নিয়ে পরের বছরই ভর্তি হন ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। সেই থেকেই এক ভিন্ন যাত্রা শুরু তন্ময়ের।

আঁকাআঁকির জন্য চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর ঢাকা শহরের অনেক ভালো লাগা আর মন্দ লাগা তাকে ভাবাতে থাকে। সে ভালো লাগার একটি জায়গা তাকে আরো ভাবাতে থাকে, সেটি হলো রিকশাচিত্র। আর মন্দ লাগাটি হলো এখানকার মানুষের শিকড় ভুলে যাওয়া এবং অতি মাত্রায় শহুরে হয়ে ওঠার প্রবণতা। এ দুয়ের মিশেলে তন্ময় ঠিক করেন রিকশাচিত্রই হতে পারে তার আঁকাআঁকির একটি মাধ্যম। এ বিষয়ে তন্ময়ের কাছে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের রিকশাচিত্রে যে ধরনের চিত্রগুলো আঁকা হয়, সেগুলো মূলত বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের ছবি। আর বর্তমান সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখা হয়। বিশেষ করে একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়— ‘খ্যাত’। আমার কাছে এ বিষয়টি খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। এছাড়া রিকশাচিত্রের মতো একটি বিষয় এখন পর্যন্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। অর্থাত্ আমরা যারা চিত্রকলার ওপর লেখাপড়া করছি, তাদের কোনো সুযোগ নেই এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত জানার। অনেকটা জেদের বশেই রিকশাচিত্র নিয়ে সবার সামনে হাজির হওয়া।

ছোটবেলা থেকেই চারপাশে ঘটে যাওয়া সব কিছু অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা রপ্ত করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তন্ময় আজ চিত্রকর্মের বিভিন্ন মাধ্যম থাকার পরও রিকশাচিত্রকেই বেছে নিয়েছেন। ভিন্নভাবে সব কিছু দেখার বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়া যায় যখন তিনি বলেন, আমাদের সব কিছুতেই শ্রেণী বিদ্যমান। এমনকি শিশুদের খেলনাতেও। আরো বিস্তারিত বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ঈদের সময় আমাদের গ্রামের বাজারে যখন খেলনা কিনতে যেতাম, তখন দেখতাম এক ধরনের চশমা সবাই কিনছে। একটু বড় হয়ে শহরের খেলনা চশমাগুলো যখন দেখলাম, তখন মনে হলো এগুলো আরো ভালো। অর্থাত্ সবচেয়ে সস্তা চশমাগুলো এমন গ্রামেগঞ্জেই যায়। তো সে চিন্তাটাকে আমি আমার আঁকা পোর্ট্রেটগুলো প্রকাশ করার চেষ্টা করি। সেখানে আমি এক ধরনের চশমা ব্যবহার করি। যেগুলো আসলে শৈশবে দেখা সে ‘সস্তা’ চশমাগুলোই।

ভবিষ্যতে আঁকাআঁকির অন্য কোনো মাধ্যমে কাজ করবেন কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তর তন্ময়ের জানা না থাকলেও তিনি জানালেন রিকশাচিত্র নিয়েই তার আরো গভীর ভাবনার কথা। তন্ময় জানান, আমি এত দিন ডিজিটাল ফরম্যাটে রিকশাচিত্রগুলো করার চেষ্টা করেছি। এখন চেষ্টা করছি বড় ক্যানভাসে রঙ-তুলি দিয়ে আমার ভাবনাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরতে। আর ইচ্ছা আছে রিকশা চিত্রশিল্পীদের কাছ থেকে এ বিষয়গুলো আরো বিস্তারিত শেখার।

পুরনোকে ভুলে না গিয়ে সামনে এগোতে চাওয়া তন্ময় আলাপের একেবারে শেষে এসে জানান, রিকশা পেইন্টিংয়ের চর্চা আগে খুব বেশি হতো, এখন চর্চা কমে গেছে। আমার মনে হয়েছে এটাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন। আর একটা দেশের সংস্কৃতি অনেক বেশি তুলে ধরে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিজস্ব জিনিসগুলো। ছোটবেলায় বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, সিনেমার পোস্টার ইত্যাদি প্রায় সব কিছুতেই প্রচুর উষ্ণ রঙের ব্যবহার দেখতাম। আমার এ বিষয়গুলো ভালো লাগে বলেই এমন কাজ করা।

তবে তন্ময় শুধু যে নিজের আঁকাআঁকি নিয়েই ব্যস্ত, তা নয়। রিকশাচিত্রকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে ফেসবুকে খুলেছেন ‘রিকশা আর্ট মিউজিয়াম’ নামে একটি গ্রুপ। যেখান থেকে রিকশাচিত্র-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের বিষয়ের প্রচার করে থাকেন এ গ্র্যাজুয়েট ‘রিকশা চিত্রশিল্পী’। বণিকবার্তা।