Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বছরে ২০ টন সোনা আসে অবৈধ পথে!

gold-ornamentবাংলাদেশে প্রতিবছর সোনার চাহিদা প্রায় ২১ টন। বছর ধরে এ পরিমাণ স্বর্ণের অলঙ্কারই বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু গত ১০ বছরে বৈধভাবে এক তোলা সোনাও আমদানি হয়নি। সর্বোচ্চ ৫ ভাগ এসেছে ব্যাগেজ রুলের আওতায়। বাকি ৯৫ ভাগ চাহিদার জোগান প্রশ্নবিদ্ধ। চোরাই সোনা দিয়েই চাহিদার বিশাল এ অংশ পূরণ হচ্ছে। পুরো বাজারই একটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। ফলে অধিকাংশ সোনার ব্যবসাই অবৈধভাবে চলছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবৈধভাবে আমদানির জন্য দু’ধরনের সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত, হুন্ডির মাধ্যমে দেশের অর্থ পাচার হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এ অবস্থায় ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার দোকানগুলোর সোনা ও ডায়মন্ডের উৎসের তথ্য জানতে চেয়ে ভ্যাট কমিশনারেটকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চিঠিতে জুয়েলারি দোকানগুলো সোনা ও হীরা বিক্রির বিপরীতে কী পরিমাণ রাজস্ব দিয়েছে তা জানাতে বলা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত তথ্যসহ চিঠির জবাব দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী ২১ টন সোনার সমপরিমাণ হচ্ছে ১৮ লাখ ৪১১ ভরি। এর মধ্যে ৫ শতাংশ যাত্রীর সঙ্গে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসে। নির্দিষ্ট পরিমাণের (একশ’ গ্রাম) বেশি সোনা আনলে প্রতি ভরিতে তিন হাজার টাকা হিসাবে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। চাহিদার বাকি ৯৫ শতাংশ বৈধভাবে আমদানি করলে এ হিসাবে (ভরিতে ৩ হাজার টাকা) সরকার ৫১২ কোটি টাকা রাজস্ব পেত। কিন্তু এ পরিমাণ সোনা বৈধভাবে আমদানি না হওয়ায় প্রতিবছর সরকার ৫১২ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

chardike-ad

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দুটি বিষয় খুবই উদ্বেগের। প্রথমত, তথ্য-উপাত্তে মনে হচ্ছে, দেশের চাহিদার বড় অংশই চোরাই পথে আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন থেকে ভারতে সোনা পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দর। তিনি বলেন, বৈধভাবে সোনা আমদানি না হওয়ায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ কারণে স্বর্ণের নীতিমালার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সভাপতি ও ভেনাস জুয়েলার্সের মালিক গঙ্গাচরণ মালাকার মঙ্গলবার বলেন, সোনার বাজারে আজকের বিশৃঙ্খলার জন্য সরকার দায়ী। কারণ, দেশে স্বর্ণের কোনো নীতিমালা নেই। বাজুসের পক্ষ থেকে গত ২৫ বছর পর্যন্ত বলা হলেও নীতিমালার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক অত্যন্ত বেশি। এ কারণে মানুষ ভিন্ন চিন্তা করছে।

জুয়েলারি সমিতির নেতারা বলছেন, সোনায় শুল্ক অত্যন্ত বেশি। এ কারণে সোনা আমদানি হয় না। তবে তাদের দাবি, বিদেশ থেকে বাংলাদেশিরা যেসব সোনা নিয়ে আসে সেগুলো তারা কিনছেন। কিন্তু এর পরিমাণ মোট চাহিদার ৫ শতাংশেরও কম। সমিতির হিসাবে দেশের সোনার দোকানগুলো প্রতিদিন গড়ে ২৫ কোটি টাকা বিক্রি করে। এ হিসাবে সোনার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২১ টন। অর্থাৎ এই পরিমাণের স্বর্ণের অলঙ্কার দেশে কেনাবেচা হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে দেশে এক তোলা সোনাও বৈধভাবে আমদানি হয়নি। বৈধ আমদানি না থাকায় এ খাত থেকে কোনো শুল্কও আদায় হয়নি। ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি স্বীকার করছেন, কিন্তু উৎস সম্পর্কে সবাই নীরব। এতে প্রমাণিত হয়, দেশের স্বর্ণের বাজার চলছে চোরাচালানের সোনায়।

সূত্র বলছে, প্রতিবছর বিভিন্ন সংস্থা যে পরিমাণ সোনা আটক করছে, অবৈধ পথে তার ১০ গুণের বেশি সোনা ঢুকছে দেশে। এর একটি অংশ বাংলাদেশে থাকছে। বাকি সোনা বিভিন্ন পথে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে ভারতে। অভিযোগ- সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে সোনা পাচারের কাজ চলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, অবৈধ পথে সোনা আমদানি ঠেকাতে সব ধরনের কৌশল নিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। ফলে বিমানবন্দরগুলোতে সোনা আটক হচ্ছে। পাশাপাশি বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ সোনা জব্দ করা হচ্ছে। ফলে আগের বছরগুলোর তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে চোরাচালান কিছুটা কমেছে। তিনি বলেন, বিগত ৪ বছরে ১ হাজার ১০১ কেজি সোনা জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা।

জানা গেছে, বৈধভাবে বিদেশ থেকে ব্যাগেজ রুলে শুল্ক ছাড়াই একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম বা সাড়ে ৮ ভরি পর্যন্ত সোনা আনতে পারেন। এর বেশি আনলে তাকে প্রতি ভরিতে ৩ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। তবে ব্যাগেজ রুলে যে পরিমাণ সোনা আসছে, তা দেশের মোট চাহিদার ৫ শতাংশের কম। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এভাবে সোনা আনছেন ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারকারীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী স্বীকার করেন, দেশে সোনার চাহিদার বেশিরভাগই আসে চোরাচালান থেকে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজে বা বিমানে সোনার বার, স্বর্ণালঙ্কার পাচার হয়ে আসছে। এসব দেশে বাংলাদেশের একটি চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে।

এদিকে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় সোনা ও ডায়মন্ডের দোকানের তথ্য জানতে চেয়ে মাঠপর্যায়ে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। আগামী ১ মাসের মধ্যে এসব তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার ৪টি ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো ওই চিঠিতে দোকানগুলো বিক্রির বিপরীতে গত ৩ অর্থবছরে কী পরিমাণ ভ্যাট দিয়েছে, তা জানাতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ক্রেতা আকর্ষণে ভ্যাট আদায় ছাড়াই সোনা বিক্রি করছে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। এ ছাড়া ভ্যাট আদায় করলেও তা সরকারকে ঠিকমতো পরিশোধ করছে না ব্যবসায়ীরা। অনেক প্রতিষ্ঠানে ইসিআর থাকলেও সেটি ব্যবহার না করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভ্যাট পরিশোধ করছে না। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সোনা ও ডায়মন্ড বিক্রির খাত থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকার ভ্যাট পেয়েছে ২০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬-তে ২৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ভ্যাট পেয়েছে ২৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ৬ বছরে দেড় হাজার কেজির বেশি চোরাই সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭৫ কেজি বা প্রায় ৭ মণ সরকার পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে সরকারের কাছ থেকে এই সোনা কিনে নিয়ে রিজার্ভে যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকি প্রায় সাড়ে ১২০০ কেজি বা ৩১ মণ ১০ কেজি সোনা ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ী খাতে জমা আছে। মামলা নিষ্পত্তি হলে এসবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সৌজন্যে : যুগান্তর