Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দশ বছরের মধ্যে এশিয়ার 'বাঘ' হবে বাংলাদেশ

ঢাকা থেকে মো. মহিবুল্লাহ, ১৪ আগষ্ট ২০১৩:

26590_in_amb2সম্প্রতি বাংলাদেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল আরটিভির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন ডিপ্লোমেটিক জোন-এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লী উন-ইয়ং। সে আলাপচারিতার চুম্বক অংশ প্রশ্নোত্তর আকারে বাংলা টেলিগ্রাফের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

chardike-ad

প্রশ্নঃ কেমন লাগছে বাংলাদেশে?

উত্তরঃ আমি বাংলাদেশে এসেছি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর হয়ে গেলো। এই অল্প সময়েই আমি এখানকার মানুষের আতিথেয়তায় যারপরনাই অভিভূত। আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখন অনেক বাংলাদেশীই আমাকে বলেছিলেন যে, যেদিন আমি এখান থেকে চলে যাবো সেদিন আমাকে কাঁদতে হবে। সে কথাটার তাৎপর্য আমি ইতোমধ্যেই বুঝতে শুরু করেছি। বিদেশীদেরকে আপন করে নেয়ার যে সহজাত প্রবণতা এদেশের মানুষের রয়েছে তা একেবারেই অসাধারণ। অতিথি আপ্যায়নে তাঁদের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। এছাড়া এখানে আমার বেশ ক’জন ভালো বন্ধুও জুটে গেছে। সব মিলিয়ে ঢাকা শহরের জীবনটা যথেষ্ট ভালো লাগছে। এমন একটি দেশে নিজ দেশের রাষ্ট্রদূত হতে পেরে আমি সত্যিই খুব খুশী।

প্রশ্নঃ এখানকার কোন জিনিসটা আপনার সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছে? খাবার, আমাদের নববর্ষ উদযাপন বা অন্য কিছু?

উত্তরঃ এখানকার অনেক কিছুই আমার ভালো লেগেছে। খাবার তো অবশ্যই। কোরিয়ান খাবারের সাথে আমি বাংলাদেশী খাবারের অনেক মিল পাচ্ছি। আমাদের কোরিয়ান খাবারও যেমন খুব মশলাদার হয়, এখানকার খাবারও অনেক মশলাযুক্ত এবং আমার কাছে বেশ সুস্বাদু মনে হয়েছে। আমি বেশ উপভোগ করছি। আর নববর্ষের কথা বলতে গেলে সত্যি বলতে এ বছর প্রচণ্ড ব্যস্ততার দরুন নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়ে ওঠে নি। তবে আমি টিভিতে দেখেছি এবং জমকালো অনুষ্ঠানমালা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আশা করছি আগামী বছর সরাসরি নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবো।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোরিয়ান বিনিয়োগ বিষয়ে যদি কিছু বলেন?

উত্তরঃ বাংলাদেশ-কোরিয়া সম্পর্কে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীরাই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন। সত্তরের দশকের শেষভাগে কোরিয়ান ব্যবসায়ীরা এদেশে গার্মেন্টস শিল্পের গোড়াপত্তন করেন। বর্তমানে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের প্রতিষ্ঠিত ২২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর ১২৪ কোটি ইউএস ডলার রপ্তানি করছে যা কিনা বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের পাঁচ শতাংশেরও বেশী। এসব কারখানায় লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রক্রিয়াধীন কেইপিজেড চালু করা সম্ভব হলে এটি হবে দু’দেশের সম্পর্কে একটি বিশাল মাইলফলক এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় সাফল্য।

প্রশ্নঃ তৃতীয় বিশ্বের আরও অনেকগুলো দেশের সাথে বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হুমকিতে রয়েছে। এই সমস্যাটা আমরা কিভাবে সমাধান করতে পারি?

উত্তরঃ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রায় প্রতি বছর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেগুলো কিনা জলবায়ু পরিবর্তনেরই নেতিবাচক ফলাফল। তবে এটি কোন দেশের একক সমস্যা নয়, এটি একটি বিশ্বজনীন সমস্যা যা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করা হচ্ছে। দক্ষিন কোরিয়াও এসব কার্যক্রমে অংশ নিয়ে এ সংকট মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া দক্ষিন কোরিয়া পৃথকভাবে বাংলাদেশে সোলার সেচ পাম্প ব্যবহারে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করছে এবং রাজশাহী অঞ্চলে এর মাধ্যমে ধানও চাষ করা হচ্ছে। কোরিয়া সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশের ১২০০ বাসাবাড়িতে সৌর বিদ্যুতের সংযোগ প্রদান করা হয়েছে।

প্রশ্নঃ দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত?

উত্তরঃ দক্ষিণ কোরিয়ার মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রশিক্ষণটি সারা বিশ্বেই বেশ সমাদৃত হয়েছে। ছয় মাস কিংবা এক বছর মেয়াদী কর্মশালায় ১৫টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশের প্রশিক্ষণার্থীরা যেমন কোরিয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তেমনি আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরাও বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যেই আমরা ১৩০০ সরকারি কর্মকর্তাকে কোরিয়ায় নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এছাড়া প্রায় ৭০ জন কোরীয় স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন।

প্রশ্নঃ কোরিয়ায় বিদেশী জনশক্তি নিয়োগের পদ্ধতি এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) বিষয়ে যদি কিছু বলেন?

উত্তরঃ কোরিয়া সরকার ইপিএস প্রবর্তন করেছে ২০০৭ সালে। বর্তমানে এর আওতায় প্রতি বছর বাংলাদেশসহ ১৫ টি এশীয় দেশের ৭০ থেকে ৮০ হাজার কর্মী কোরিয়ায় কাজ করতে যাচ্ছেন। এবং আমরা মনে করি, কোরিয়ান ইপিএস অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে সর্বোত্তম পদ্ধতি।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নেয়ার জন্য কোরিয়া সরকারের আলাদা কোন কোটা রয়েছে কি?

উত্তরঃ এই মুহূর্তে দক্ষিণ কোরিয়া প্রতি বছর ২ হাজার বাংলাদেশীকে কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। এ সংখ্যাটা ভবিষ্যতে আরও বাড়ানোর ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। আর বাংলাদেশের কর্মীরা সেখানে অন্যদের মতোই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, কোন ধরনের বৈষম্য করা হচ্ছে না। তাঁরা যেমন সেখানে খুব ভালো বেতনে কাজ করছে, তেমনিভাবে তাঁরা কোরিয়ার অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এর মাধ্যমে উভয়পক্ষই লাভবান হচ্ছে বলে আমি মনে করি।

প্রশ্নঃ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কোরিয়া সরকার বাংলাদেশকে কিভাবে সহায়তা করছে?

উত্তরঃ তথ্যপ্রযুক্তির বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমান বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে কোরিয়া সরকারের প্রদত্ত তথ্যপ্রযুক্তি সেবাসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ই-গভর্নেন্স। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত করা সম্ভব হবে। এছাড়া কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সী (কোইকা) ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে একাধিক উপজেলা তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। কোরিয়াভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক্স সম্প্রতি ঢাকায় তাঁদের একটি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আরএন্ডডি) সেন্টার চালু করেছে (বিশ্বে এটি স্যামসাংয়ের ১৮তম আরএন্ডডি সেন্টার) যেখানে স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্যের সফটওয়্যার প্রস্তুতি ও উন্নয়নের কাজে সাত শতাধিক প্রকৌশলী কাজ করছেন।

প্রশ্নঃ উচ্চ শিক্ষায় ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি কোরিয়াও এখন একটি জনপ্রিয় নাম। এ দিকটিতে কোরিয়া সরকার এখন বিদেশীদের কেমন সুযোগ দিচ্ছে?

উত্তরঃ কোরিয়ায় ফেলোশিপ প্রোগ্রামের আওতায় বর্তমানে প্রতি বছর এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী কোরিয়ায় পড়াশুনা করার সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা যাচ্ছেন প্রতি বছরই। এ বছর আমার জানামতে ২০ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী এই ফেলোশিপ পেয়েছেন।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশ-কোরিয়া বানিজ্যে যে বাধাগুলো রয়েছে সেগুলো কিভাবে দূর করা যেতে পারে?

উত্তরঃ সত্যি কথা বলতে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ-কোরিয়া বানিজ্য যথেষ্ট গতি পেয়েছে। দ্বিপাক্ষীয় বানিজ্যের পরিমাণও বেড়েছে। তবে বাংলাদেশে কোরিয়া যে পরিমাণ রপ্তানি করছে তার তুলনায় কোরিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম। কোরিয়া যেখানে প্রতি বছর দেড়শ কোটি ইউএস ডলারের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করছে, সেখানে বাংলাদেশ কোরিয়ায় রপ্তানি করছে বার্ষিক ত্রিশ কোটি ইউএস ডলারের পণ্য। তবে গত দুই বছরে কোরিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০১১ সালে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ২১ শতাংশ। আমরা আশাবাদী যে খুব দ্রুতই আমাদের দ্বিপাক্ষীয় বানিজ্য একটি ভারসাম্য অবস্থানে চলে আসবে।

প্রশ্নঃ ভবিষ্যতে তৈরি পোশাকের বাইরে বাংলাদেশের আর কি কি পণ্যের রপ্তানি কোরিয়ায় আরও বৃদ্ধি পেতে পারে?

উত্তরঃ বর্তমানে শুধু তৈরি পোশাকই নয়, চামড়া, জুতাসহ বেশ কিছু পণ্য বাংলাদেশ থেকে কোরিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি হচ্ছে। আমি আশা করি বাংলাদেশের আরও অনেক পণ্যই ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে জায়গা করে নেবে এবং সেসবের রপ্তানি কোরিয়াতেও বৃদ্ধি পাবে।

প্রশ্নঃ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোরিয়া সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বিষয়ে যদি আমাদের একটু বলেন?

উত্তরঃ সুশাসনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে পূর্ণ গনতন্ত্র ও জবাবদিহিতা। কোরিয়ায় প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর জাতীয় সংসদ ও জাতীয় অডিট এজেন্সীর তরফে অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও আয়ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া ই-গভর্নেন্স বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যেই কথা বলেছি, এটিও বর্তমান যুগে সুশাসনের জন্য অন্যতম সহায়ক হতে পারে। এর সাহায্যে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে। ফলে একজন নাগরিক তাঁর কোন একটি কাজ যে কোন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খুব সহজেই করিয়ে নিতে পারছেন, তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ছুটোছুটি করতে হচ্ছে না।

প্রশ্নঃ আজ থেকে দশ বছর পর বাংলাদেশকে ঠিক কোন অবস্থানে দেখতে চান?

উত্তরঃ আমি একেবারে মন থেকেই চাই যে, আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এশিয়ার পরবর্তী বাঘ হবে, যাকে বলে বাংলার বাঘ। আর সেটা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে। এদেশের অর্থনীতিকে একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য এদেশের মানুষের আগ্রহ ও সদিচ্ছার কোন অভাব নেই। তাছাড়া যেখানে কোরিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ জনসখ্যা সংকটে ভুগছে, সেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ১৭ কোটি জনগোষ্ঠীর এক বিশাল সম্পদ। সুতরাং, এই দিকটিতে দক্ষিন কোরিয়া ও বাংলাদেশ পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু ও সহযোগী হতে পারে। আর বাংলাদেশ সরকারের ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটিও সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে- এমনটাই আশা করি।