teer-sm১০ টাকায় ৭০০ টাকা, ২০ টাকায় ১৪০০ টাকা; অর্থাৎ প্রতি টাকার বদলে ৭০ গুণ লাভ- এমন আশায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন সিলেট নগরীসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজেলার নিম্ন আয়ের মানুষ।

লোভনীয় এ অফার দিচ্ছে ভারতের শিলংয়ের অনলাইন ভিত্তিক লটারি খেলার ওয়েবসাইট ‘তীর কাউন্টার ডটকম’। লটারি খেলার ওয়েবসাইট বলা হলেও এটি মূলত জুয়া খেলার আধুনিক সংস্করণ।

chardike-ad

জুয়ার আধুনিক এ সংস্করণ সীমান্ত পেরিয়ে বর্তমানে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সিলেট নগরীর কাজিরবাজার, সুরমা মার্কেট, করিম উল্লাহ মার্কেট, বালুচর, বড়বাজার, বন্দরবাজার, রিকাবিবাজার, তালতলা, মদিনা মার্কেট, লালদিঘীরপাড় হকার্স মার্কেট, সিটি মার্কেট, শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, শেখঘাট, মালনীছড়া চা বাগান, কুয়ারপাড়, চাঁদনিঘাট, দক্ষিণ সুরমার কদমতলীর বালুর মাঠ, পুরাতন রেলস্টেশন এলাকা, লাউয়াই, কামালবাজারসহ অর্ধশত স্পটে। প্রতিদিনই এসব স্পটে বসে ‘শিলং তীর’র জুয়ার আসর।

তীর খেলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, এক থেকে ১০০-এর মধ্যে প্রতি সংখ্যার একাধিক টিকিট থাকে। সেখান থেকে যেকোনো সংখ্যার টিকিট সর্বনিম্ন এক টাকা দিয়ে কিনে কেউ জয়ী হলে তিনি ৭০ টাকা পান। এভাবে কেউ ১০০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনে জিততে পারেন সাত হাজার টাকা।

তারা জানান, একজন লোক একাধিক নম্বরের টিকিট কিনতে পারেন। এক টাকার বিনিময়ে ৭০ টাকা পাওয়ার আশায় অনেকে প্রতিদিনই ‘তীর খেলা’র টিকিট কিনে থাকেন। তবে ১০০টি সংখ্যার মধ্যে একটিমাত্র নম্বরের টিকিট ক্রেতারা বিজয়ী হন। এতে বিজয়ীরা সামান্য টাকা পেলেও প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন সবারই হাতে স্মার্টফোন রয়েছে। ফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশি প্রতিনিধিরা জেনে নেন লটারিতে কোন নম্বরটি লেগেছে। এরপর যারা লটারি কিনেছেন, তাদের নম্বরটি জানিয়ে দেয়া হয়। পরে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে টাকার লেনদেন হয়।

ভয়ঙ্কর এ জুয়া খেলার তথ্য উল্লেখ করে সিলেট বিভাগের কমিশনার ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম www.teercounter.com ওয়েবসাইটটি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি লিখেছেন। চিঠির একটি অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও পাঠান হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

চিঠি পেয়ে বিটিআরসি ওয়েবসাইটটি বন্ধের নির্দেশনাও দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু এখনও সে নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। আজও বন্ধ হয়নি জুয়া খেলার ওয়েবসাইটটি, বন্ধ হয়নি জুয়া খেলাও।

বিভাগীয় কমিশনারের চিঠিতে বলা হয়েছে, সিলেট বিভাগের জেলাসমূহে বিশেষ করে ভারত সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজেলায় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়েবসাইট তীর কাউন্টার ডটকম ব্যবহার করে শিলং ‘তীর খেলা’ নামক অবৈধ লটারি/জুয়ার বিস্তার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন বিকাল ৪টায় একবার এবং বিকাল সোয়া ৫টায় একবার ওয়েবসাইটে লটারির ফলাফল ঘোষণা করা হয়। সিলেট মহানগর এলাকার বিভিন্ন স্থানে আয়োজকরা এজেন্ট নিয়োগ করে এবং তাদের মাধ্যমে লটারিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তিদের নিকট অর্থ সংগ্রহ করে। এরপর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলাফল তারা মোবাইলে প্রদর্শন করে এবং বিজয়ীদের অর্থ পুরস্কার দেয়া হয়।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ওয়েবসাইটে সংখ্যাটি উঠলে আয়োজক সংস্থা বিজয়ীকে ৭০ গুণ বেশি অর্থ পুরস্কার প্রদান করে। অবৈধ এ লটারির নেশায় পড়ে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষরা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে গৃহিনী, দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ নিম্ন আয়ের লোকজন পরিবারকে বঞ্চিত করে কষ্টার্জিত অর্থ অবৈধ পথে বাজি ধরছে এবং সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে।

চিঠিতে বলা হয়, বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনকালে স্থানীয় জনগণের নিকট হতে এ ধরনের আসক্তির ভয়াবহ চিত্র সম্পর্কে অবগত হন এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি ওয়েবসাইটটি বন্ধের জন্য অনুরোধ করেন। এছাড়া গত ১৭ জুলাই সিলেট বিভাগীয় আইন-শৃঙ্খলা কামিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয় এবং বর্ণিত অপরাধমূলক জুয়া খেলা থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এ অবস্থায় শিলং তীর নামক জুয়া খেলার জন্য ব্যবহৃত ওয়েবসাইট ‘তীর কাউন্টার ডটকম’ বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করে বিভাগীয় কমিশনার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, আমরা অলরেডি আইজিডাব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে)-সহ সংশ্লিষ্টদের ওয়েবসাইটটি বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছি। তারা যদি আমাদের নির্দেশনা না মানে তাহলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম মোবাইলফোনে বলেন, ওয়েবসাইটটি এখনও বন্ধ হয়নি। এটি বন্ধ না হলে জুয়া খেলা চলতেই থাকবে। ‘এ ধরনের জুয়া খেলা বন্ধের বিষয়ে আমাদের পুলিশ ও প্রশাসন তৎপর। যেহেতু এটি ইন্টারনেট বেজড খেলা, তাই এ বিষয়ে আমাদের করার কিছু থাকে না। স্থানীয়রা না জানালে আমরাও বিষয়টি জানতে পারি না।’

তিনি আরও বলেন, এটা তো গৃহিণীরা খেলে, নিম্ন আয়ের লোকসহ সব ধরনের পেশার লোক এটি এখন খেলছে। সবার হাতেই স্মার্টফোন। এ কারণে এটি খেলতে অন্য কোথাও যাওয়া লাগে না। বাসায় বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খেলা যায়। ফলে প্রশাসনের পক্ষেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ জন্য আমরা ওয়েবসাইটটি বন্ধের কথা বলেছি।

জানা গেছে, গত দুই বছরে সিলেট মহানগরীর অর্ধশতাধিক স্পট এবং বিভিন্ন উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর এ ‘তীর খেলা’ নামক জুয়ার আসর। শত চেষ্টা করেও স্থানীয় প্রশাসন এটি রুখতে পারছে না। মাঝেমধ্যে চিহ্নিত জুয়ার স্পটে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন জুয়াড়িকে আটকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে পুলিশের তৎপরতা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের শিলং থেকে ‘তীর খেলা’ নামক জুয়া বছর কয়েক আগে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটে বিস্তার লাভ করে। এসব উপজেলা থেকে গত দুই বছরে এটি ছড়িয়ে পড়ে সিলেট মহানগরীসহ অন্যান্য উপজেলায়।