Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

উত্তর কোরিয়ার হাইড্রোজেন বোমা ও চীন

hidozen-bomaউত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমা বানিয়েছে এবং হামগং প্রদেশে মাটির নিচে ১০ কিলোমিটার গভীরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করেছে। প্রচণ্ড ভূমিকম্প পুরো উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রকম্পিত করেছে। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৬.৩। উত্তর কোরিয়ার লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে বম্ব শেল্টারে আশ্রয় নেয়। চীন ও রাশিয়ার বহুতলেও কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে।

পাশ্চাত্য স্বীকার করেছে, পিয়ংইয়ং যত বোমা পরীক্ষা করেছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিধর। বিস্ফোরণের পর ভূকম্পনের মাত্রা বিবেচনা করে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, বোমাটির শক্তি ছিল ১০০ কিলোটনের মতো, অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে জাপানের নাগাসাকি শহরে যে পারমাণবিক বোমা ৭০ হাজার মানুষের জীবন নিয়েছিল, উত্তর কোরিয়ার আজকের বোমাটির শক্তি তার চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি। অনেকে বলছেন আট গুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির অধ্যাপক বিপিন নারাং বলেন, বোমাটি হাইড্রোজেন বোমা হোক আর না হোক, এটি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি শহর পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব। পাকিস্তানের পরমাণুবিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক প্রযুক্তি পাকিস্তানের প্রযুক্তির চেয়ে অনেক উন্নত এবং এ ধরনের বোমা কয়েক মিনিটে যেকোনো শহর গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
হাইড্রোজেন বোমা বানানোর জন্য বিপুল তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। তাপ সৃষ্টির কাজটি করা হয় পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। এভাবে হাইড্রোজেন বোমায় খুবই অল্প সময়ের মধ্যে দু’টি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। প্রথমটি ঘটে ফিশনের মাধ্যমে আর দ্বিতীয়টি ঘটানো হয় ফিউশনের মাধ্যমে। ফিউশনপ্রক্রিয়ায় দুই বা তার চেয়ে বেশি হাইড্রোজেন পরমাণুকে একীভূত করা হয়। এ কারণে বোমাটির নামের আগে যুক্ত হয়েছে হাইড্রোজেন। ফিউশনের জন্য ১০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রা প্রয়োজন। এটি দ্রুত করা খুব সহজ নয়। এ জন্য হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা কঠিন।

chardike-ad

হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষার পরপরই আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্ত বরাবর ব্যাপক বোমা বিস্ফোরণের ফলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তবে তার মাত্রা কম। গোটা কোরীয় উপদ্বীপ ও চীনে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলেও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়। এ ঘটনার পরপরই কোরীয় উপদ্বীপে পরমাণু বিমানবাহী রণতরী এবং কৌশলগত বোমারুবিমান মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামাও বেজে উঠতে পারে। কয়েক দিন আগেই রাজধানী পিয়ংইয়ং থেকে ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণের পর জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপের ওপর দিয়ে মাঝসমুদ্রে আছড়ে পড়েছিল। জাপান বলছে, তারা আগেভাগেই উত্তর কোরিয়ায় আক্রমণ চালাবে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ বাহিনী নাকি কিম জং উন এবং দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের হত্যার পরিকল্পনা করেছে। সিউলের বিরুদ্ধে কিম যুদ্ধ ঘোষণা করলে; এ পরিকল্পনা কার্যকর করা হবে।

উত্তর কোরিয়া বলেছিল, গত আগস্ট মাসেই গুয়ামে হামলা চালাবে, যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়। গুয়ামের সমুদ্র এলাকায়ও যদি মিসাইল আঘাত করে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে আঘাত করার মতো। পিয়ংইয়ং বলেছে, তারা চারটি মিসাইল ছুড়বে। হঠাৎ করে গুয়াম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হলো? এটি প্রশান্ত মহাসাগরে পশ্চিমে ছোট্ট এক দ্বীপ। লোকসংখ্যা মাত্র দেড় লাখ। তবে পর্যটনের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের লোকেরা এই দ্বীপে ভ্রমণ করতে যায়। উত্তর কোরিয়ার গুয়াম আক্রমণের ঘোষণার পর পর্যটকেরা আর যাচ্ছে না। গুয়াম উত্তর কোরিয়ার ৩৫০০ কিলোমিটার দূরে। ফিলিপাইন থেকে এটি কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুয়াম জাপানের ছিল। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের সময় ১৮৯৮ সালে গুয়াম আমেরিকার ভূখণ্ড হয়। উত্তর কোরিয়াকে ঘায়েল করার জন্য সময়ে সময়ে গুয়ামকে সজ্জিত করা হয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভার দিয়ে। এখানে আমেরিকার নৌঘাঁটিতে নৌসেনা রয়েছে সাত হাজার। রয়েছে কোস্টগার্ড স্টেশন ও এয়ার ফোর্স বেজ। এসব সামরিক স্থাপনা গুয়ামের তিন ভাগের এক ভাগ দখল করে আছে। এখানে শক্তিশালী ও উন্নতমানের থাড অ্যান্টিমিসাইল সিস্টেমও রয়েছে। বিমানঘাঁটিতে রয়েছে বিশাল আকারের বোমা বহনকারী বোমারুবিমান, জঙ্গিবিমান, ড্রোন, স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থা। উত্তর কোরিয়ায় হামলার জন্য গত মে মাস থেকে এ পর্যন্ত ১১ বার হামলার মহড়া চালানো হয়েছে মর্মে এক্সপ্রেস ট্রিবিউন সংবাদ দিয়েছে।

থাড হলো অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা (টার্মিনাল হাই অ্যাল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স)। এর রাডার গুয়ামে স্থাপন করা হয়েছে। থাড সহজে বহনযোগ্য, কিন্তু এর বিধ্বংসী ক্ষমতা বেশি। থাড আক্রমণকারী মিসাইলকে ধ্বংসও করতে পারে। এর সুবিধা হলো, এই ক্ষেপণাস্ত্র ভূমি থেকে, যানবাহন থেকে বা সি কেরিয়ার থেকে নিক্ষেপ করা যায়। থাডের আরেক সুবিধা হলো অন্য ডিফেন্স সিস্টেমের সাথে বা অ্যাটাক সিস্টেমের সাথে একত্রে কাজ করা। দক্ষিণ কোরিয়ায় দু’টি থাড সিস্টেম বসানো হয়েছে। হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষার পর আরো চারটি থাড সিস্টেম বসানোর প্রক্রিয়া চলছে। থাড চালু হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে এবং টার্গেট নির্ভুল।

দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সেওনজু এলাকায় লোকজন বাধা দিলেও সেখানে থাড বসানো হয়েছে। জাপানে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালানোর লক্ষ্যে উত্তর কোরিয়া নিজের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিস্তার ঘটানোর কারণে থাড ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়েছে মর্মে ওয়াশিংটন জানিয়েছে। চীন বলেছে, থাড মোতায়েনের কারণে ‘আঞ্চলিক নিরাপত্তা’ বিঘিœত হয়েছে। মস্কো ও বেইজিং বলেছে, তারা এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান জোরদার করবে। উল্লেখ্য, আমেরিকা বহু আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে থাড মোতায়েন করেছে। এর আওতায় সমগ্র ইরান ভূখণ্ড। ৬৫ বছর ধরে উত্তর কোরিয়া বেশির ভাগ সামরিক স্থাপনা ও ইন্ডাস্ট্রি ভূগর্ভে তৈরি করেছে এবং এসব রক্ষার জন্য ছোট ইউনিট, শক্তিশালী যন্ত্রপাতি ও যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। শত্রুপক্ষের নজর এড়ানোর জন্য ট্রাক্টর ইরেক্টর লঞ্চার বানিয়েছে, যেগুলো শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজে যাতায়াত করতে পারে।

১৯৫০-৫৩ সালের যুদ্ধে আমেরিকা উত্তর কোরিয়ায় বোমা মেরে সব কিছু মিসমার করে দিয়েছিল। উত্তর কোরিয়া এই আক্রমণ ভুলতে পারেনি, তার বুকে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন।

দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার রদবদল এবং মূল কমান্ড পয়েন্টগুলো দখল করতে চান। অপর দিকে পিয়ংইয়ং হঠাৎ আক্রমণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণাংশ, সিউল ও ইনচিয়ান দখল করার পরিকল্পনা করছে। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটি ওসান ও কুনসানসহ দক্ষিণ কোরিয়ার আরো আটটি বিমানঘাঁটি দখল করা উত্তরের প্রাথমিক হিসাবে রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার বিশেষ কমান্ডো বাহিনী ওকিনাওয়া ঘাঁটিতে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। জাপানের এই ঘাঁটি ও গুয়ামে আমেরিকার থাড অ্যান্টিমিসাইল সিস্টেম অকার্যকর করার জন্য পিয়ংইয়ং প্রস্তুত। উত্তর কোরিয়া ইলেকট্রনিকস অস্ত্রসম্ভারেও প্রভূত উন্নয়ন ঘটিয়েছে। মার্কিন নিরাপত্তা সূত্র থেকে জানানো হয়েছে গুয়াম, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়াকে লক্ষ্য করে উত্তর কোরিয়ার কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হলে তা ভূপাতিত করার নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার নৌ-কমান্ডো বাহিনীর ইউএস নেভি সিলের হাতে নিহত হয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন। একই কায়দায় উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উনকে বিদায় দিতে তৎপর নেভি সিল। এর জন্য তারা দক্ষিণ কোরিয়ার কমান্ডোদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে মর্মে ব্রিটিশ সংবাদপত্র টাইমস জানায়। দু-এক মাসের মধ্যেই নাকি দক্ষিণ কোরিয়ার কমান্ডোরা নেমে পড়বে এই হত্যাকাণ্ডে।

উত্তর কোরিয়া ইতঃপূর্বে আইসিবিএম (ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল) পরীক্ষা করেছে। আইসিবিএমের সবচেয়ে কম পাল্লা হলো ৫৫০০ কিলোমিটার এবং দূরপাল্লা হলো ৭০০০ থেকে ১৬০০০ কিলোমিটার। মার্কিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন স্বীকার করেছেন, এই প্রথমবার পিয়ংইয়ং এ ধরনের মিসাইল পরীক্ষা করেছে। তিনি জানান, এটি বড় রকমের সামরিক অগ্রগতি। এতে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়। কেননা আইসিবিএম বড়মাপের ও বড় ওজনের পরমাণু ওয়্যারহেড বহন করতে সক্ষম। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকে স্বীকার করে নিতে হবে, উত্তর কোরিয়া পরমাণু শক্তিধর দেশ। জাপান জানায়, উত্তর কোরিয়া পরমাণু ওয়্যারহেডের এমন ক্ষুদ্র সংস্করণ বানাতে সক্ষম হয়েছে, যা ব্যালিস্টিক মিসাইলে সহজেই জুড়ে দেয়া যাবে। তাহলে জাপানও উত্তর কোরিয়ার প্রথম আঘাতের কেন্দ্র হবে। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ঘাঁটি ও সামরিক স্থাপনা রয়েছে। জাপান সেনাবাহিনী আতঙ্কিত যে, ভূমিকম্পের দেশে এখন আরো বড় ধরনের হামলা হবে।

স্মর্তব্য, শক্তিশালী জাপানকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু বোমা মেরে পথে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। জাপান চেয়েছে তারা কোনো যুদ্ধে জড়াবে না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। জাপান সতর্কতা জারি করে, উত্তর কোরিয়া সামরিকসম্ভারে আরো উঁচু অবস্থানে পৌঁছেছে এবং পিয়ংইয়ংয়ের হাতে এখন ৬০টি পরমাণু বোমা রয়েছে। তাই জাপান খুব দ্রুত তার সামরিকসম্ভারের উন্নতি ঘটাচ্ছে। জাপান এমন কোনো যুদ্ধে নিজেকে রক্ষার জন্য স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে শত্রুপক্ষকে আঘাত হানবে, যা উত্তর কোরিয়ার নেই। জাপানের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, উত্তর কোরিয়া দ্রুত সাবমেরিন লঞ্চ ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরি করছে। এখনো তাদের হাতে না থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সামরিকসম্ভারে তা যুক্ত হবে। জাপান চায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারাও যাতে প্রথমেই আঘাত হানতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ৭ আগস্ট এমন ধারণাই দিয়েছেন। এরই মধ্যে জাপান টোকিওতে প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে, যা দিয়ে যেকোনো মিসাইল ধ্বংস করা যাবে। মোতায়েন করা হয়েছে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র। জাপানে এরই মধ্যে বোমা আশ্রয় তাঁবু প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। স্কুলগুলোতে বোমা হামলা থেকে রক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত ড্রিল করানো হচ্ছে। বাহ্যত দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে জাপানই বেশি ভীত। যদিও জাপানের উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র রয়েছে।

২০১১ সালে কিম জং ইলের মৃত্যুর পর চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক নিচে নামতে শুরু করে। তাই বলা যায়, এখন এ ক্ষেত্রে চীনের প্রভাব কম। তবে অনেক পশ্চিমা সমালোচক মনে করেন, এখানে চীন গেম খেলছে। চীন ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে ক্লোজ ডোর সম্পর্ক আছে। চীন চাইলেই দেশটিকে শান্ত করতে পারে। ওয়াশিংটন বারবার চীনকে চাপ দিচ্ছে মধ্যস্থতা করে উত্তর কোরিয়াকে থামানোর জন্য। বেইজিং বলেছে, প্রতিবেশীকে প্রচুর চাপ দেয়া হচ্ছে কিন্তু উত্তর কোরিয়ারও নিজস্ব মতামত আছে; তেমনি চীনের করণীয় সম্পর্কে স্বাধীন মতামত আছে। চীন উভয়পক্ষকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। আমেরিকার সামরিক কমান্ডো ও গোয়েন্দারা চায় উত্তর কোরিয়ার সরকার পরিবর্তন করতে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টও চান এমন সার্জিক্যাল আক্রমণ চালাতে। যদি এমন হয়, তবে চীন উত্তর কোরিয়ার উদ্বাস্তুতে ভরে যাবে। উত্তর কোরিয়া দরিদ্র এলাকা এবং সেখানে খাদ্যাভাব রয়েছে। তার সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। তখন চীন উত্তরের বাফার জোন হারাবে, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র তার দরজায় চলে আসবে। তাই চীন চাইছে আলোচনার টেবিলে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হোক। আলোচনার টেবিলে বসাতে হলে ওয়াশিংটন ও সিউলের উচিত হবে সব ধরনের মহড়া এবং সামরিক উপকরণ জমানো ও বন্ধ করা এবং উত্তর কোরিয়ার মিসাইল টেস্ট বন্ধ করা দরকার। উভয়পক্ষ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।

জাতিসঙ্ঘ এ পর্যন্ত আটবার অবরোধ দিয়েছে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু পিয়ংইয়ং মিসাইল কর্মসূচি বন্ধ করেনি। আমেরিকা চায় অবরোধের ব্যাপারে চীন কঠিন অবস্থান নিক, যাতে উত্তর কোরিয়া বুঝতে পারে। ওয়াশিংটনের আরো উদ্দেশ্য হলো, চীনের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়া। জাং লিয়াং গুই, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চার, বেইজিং বলে, পিয়ংইয়ং বিশ্বাস করেÑ পাঁচটি পরমাণু পরীক্ষা ও দু’টি আইসিবিএম পরীক্ষার পর যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিরাপত্তাভীতির বিষয়ে বার্তা প্রদান করা যাবে। তখনই যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া সঙ্কট সঠিকভাবে মুখোমুখি দাঁড়াবে। তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়া নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে অতিমাত্রায় বিশ্বাসী। পিয়ংইয়ং ইতোমধ্যেই ওয়াশিংটনের রেডলাইন অতিক্রম করেছে। গোপন বিষয় প্রকাশ, অর্থাৎ গুয়াম আক্রমণের কথা প্রকাশ করে আমেরিকার নিরাপত্তাকে ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে আমেরিকার ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। তিনি আরো বলেন, ঘরের দরজার সামনে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু যুদ্ধ শুরু করুক, এটা চীন চাইবে না। পরমাণু যুদ্ধ বাধলে চীনের বহু এলাকা মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়বে এবং মানুষ, পশুসম্পদ, খাদ্য এসব সরাসরি আক্রান্ত হবে। এসব সামাল দেয়ার জন্য চীনকে রেড অ্যালার্ট জারি করতে হবে। এর দায়দায়িত্ব কে নেবে তা নিরূপণের জন্য এবং সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য চীন উভয়পক্ষের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে। অর্থাৎ চীন পরমাণু যুদ্ধ চায় না।

চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, উত্তর কোরিয়া চীনের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। অতীতে চীন পিয়ংইয়ংয়ের স্বার্থরক্ষা করেছে। যেমনÑ জাতিসঙ্ঘের অবরোধের বিষয়ে ভেটো প্রদান ও ব্লক করা। মনে করা হয়, বিশ্বে এমন অন্য কোনো দেশ নেই, যার প্রভাব উত্তর কোরিয়ার ওপর চীনের চেয়ে বেশি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সতর্ক করে বলেন, তিনি উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে চীনকে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেবেন না। জাতিসঙ্ঘে চীনের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, চীনের সক্ষমতা বাস্তবভিত্তিক সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। কারণ এটা প্রধান দুই পক্ষের ওপরই নির্ভর করছে। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়াকেই উত্তেজনা প্রশমনের প্রাথমিক দায়িত্ব নিতে হবে। তাদেরকেই সঠিক পথে এগোতে হবে, চীনকে নয়।

জোয়েল এস উইথ, যিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টে নিরাপত্তা ও উত্তর কোরিয়া বিষয়ে ২০ বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি জানান, যদি ট্রাম্প মনে করেন, সামরিক হস্তক্ষেপ ও অবরোধের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্র বানানো থেকে নিবৃত্ত করা যাবে, তবে তিনি ভুল করবেন। যদি তেমন পদক্ষেপ নেয়া হয়, তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি ওয়াশিংটনের আওতার বাইরে চলে যাবে। ট্রাম্প প্রশাসন বতর্মান সামরিক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখলে তা হবে চরম অবস্থা, যেখান থেকে কোনো পক্ষ পেছনে সরে আসতে পারবে না। ট্রাম্প প্রশাসনকে এমনিতেই বড় বড় সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যার অনেকটা নিজেদেরই সৃষ্টি। ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত, উত্তর কোরিয়ার সাথে সংলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সিদ্ধান্তে আসা। সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে, জাতিসঙ্ঘে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধির মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো দেশে এ আলোচনা করা যেতে পারে এবং তা এখনই। সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। পরমাণুমুক্ত কোরীয় উপদ্বীপের বিষয়ে পিয়ংইয়ং কোনো মত দিলে তার সূত্র ধরে আলোচনা করে যুদ্ধ এড়ানো যাবে। তবে এখন বিষয়টি খুব কঠিন। ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে, সকল অপশন এখন টেবিলে আছে। এই সূত্রে এখনো আশা আছে বলে মনে হয়।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার আগেই গোটা বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। এক টুইটে তিনি লিখেছিলেন, আমেরিকাকে তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার আরো শক্তিশালী করতে হবে এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে গোটা দুনিয়ার হুঁশ না ফেরা পর্যন্ত তার বিস্তারও বাড়াতে হবে। দুনিয়াজোড়া একটা পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত। ট্রাম্প এখন তারই মুখোমুখি। মাত্র কয়েক দিন আগে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, উত্তর কোরিয়ার হুমকি এমনভাবে মোকাবেলা করা হবে, যা বিশ্ব এর আগে কখনো দেখেনি। ১১ আগস্ট ট্রাম্প বললেন, উত্তর কোরিয়া সঙ্কটে সামরিক সমাধানই একমাত্র পথ। তিনি আরো বলেন, যদি পিয়ংইয়ং গুয়াম বা তার কোনো মিত্রদেশ আক্রমণ করে তবে প্রথম যে প্রস্তাব, সে হলো কিম জং উন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষার পর বলেছেন, আমরা চাই না কোনো দেশ ধ্বংস হয়ে মাটির সাথে মিশে যাক।

লেখক: মো: বজলুর রশীদ (অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার)