জাপানের মানুষেরা তাদের বুদ্ধিমত্তা, ভদ্রতা, সুস্বাস্থ্য ও অতিথি পরায়নের জন্য বিখ্যাত। জাপানের অনেক অনন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
১. আগে নৈতিকতা পরে শিক্ষা:
জাপানের স্কুলগুলোতে ছাত্রদের কোন পরীক্ষা নেয়া হয় না যতক্ষন পর্যন্ত না তারা চতুর্থ গ্রেডে পৌছায়(১০ বছর বয়স)। তবে এসময় তারা কিছু শুধু ছোটখাট পরীক্ষা দেয়।
বিশ্বাস করা হয়, স্কুলের প্রথম তিন বছর শিশুদের মেধা যাচাইয়ের সময় নয়, সেসময় তাদের ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাটার, দয়ালু, প্রকৃতি-প্রেমিক ও ন্যায়পরায়নতার মতো নানা গুনে দীক্ষা দেয়া হয়।
২. শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় পহেলা এপ্রিল থেকে:
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় সেপ্টম্বর-অক্টোবর মাসে, কিন্তু জাপানে একাডেমিক ইয়ার শুরু হয় এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে।
তাছাড়া তখন চেরী ফুল ফোটার সময়। প্রকৃতি এসময় তার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে। তাদের শিক্ষাবর্ষ তিন সেমিস্টারে বিভক্ত- এপ্রিল ১ থেকে জুলাই ২০, সেপ্টম্বর ১ থেকে ডিসেম্বর ২৬ এবং জানুয়ারি ৭ থেকে মার্চ ২৫। শিক্ষার্থীরা বছরে প্রায় ৬ সপ্তাহের ছুটি পায় এবং শীত ও বসন্তের ছুটি থাকে আরো ২ সপ্তাহের।
৩. স্কুলে কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকে না; ছাত্ররা নিজেরাই তাদের স্কুল পরিষ্কার করে:
জাপানিজ স্কুলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তাদের ক্লাসরুম, ক্যাফেটেরিয়া এমনকি টয়লেট পরিষ্কার করে থাকে। তারা বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে কাজ বন্টন করে নেয়।
এতে শিক্ষার্থীরা যে কোনো কাজকে সম্মান করতে শিখে এবং দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার অভ্যাস তৈরি হয়।
৪. স্কুলের দুপুরের খাবারে রাখা হয় স্বাস্থ্যসম্মত মেন্যু এবং ক্লাসরুমেই ছাত্র-শিক্ষক একসাথে লাঞ্চ করে:
জাপানিজ শিক্ষা ব্যবস্থায় সবসময় এটা নিশ্চিত করা হয় যেন শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাবার গ্রহণ করে। প্রায় প্রতিটি স্কুলে এজন্য পেশাদার বাবুর্চিসহ স্বাস্থ্যকর্মী নিযুক্ত থাকে। সেই সাথে ছাত্র-শিক্ষক এক সাথে খাবার গ্রহনের ফলে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্কও সৃষ্টি হয়।
৫. স্কুলের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুল-পরবর্তী প্রাইভেট প্রোগ্রামও সেখানে বেশ জনপ্রিয় :
ভালো জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য অধিকাংশ জাপানিজ শিক্ষার্থীরা সাধারনত প্রিপ্যারেটরি স্কুল বা বিভিন্ন প্রাইভেট প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। পাঠ্যক্রম বহির্ভূত এইসব প্রোগ্রাম সাধারনত সন্ধ্যার পরে হয়ে থাকে।
সারাদিনের ৮ ঘন্টা স্কুল, সাথে সন্ধ্যাকালীন অতিরিক্ত কোর্স- কেনো তাদের পাসের হার ৯৯% সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
৬. চিরাচরিত বিষয় ছাড়াও শিক্ষার্থীদের জাপানিজ ক্যালিগ্রাফি এবং কবিতা সম্পর্কে জানতে হয়:
নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করতে শেখানোর জন্যই জাপানিজ পাঠ্যক্রমে এই দুইটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। ক্যালিগ্রাফিতে সাধারনত একটি বাশেঁর তৈরি ব্রাশ কালিতে ডুবিয়ে কলম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৭. প্রায় সব শিক্ষার্থীকেই স্কুল ইউনিফর্ম পরতে হয়:
প্রায় শতভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক। সামাজিক ভেদাভেদ ও বৈষম্য দুরীকরনে এবং শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মননিবেশ করাতে ইউনিফর্মের বিকল্প নেই।
৮. জাপানে স্কুলে উপস্থিতির হার প্রায় ৯৯.৯৯%:
জাপানিজ শিক্ষার্থীরা সাধারনত কখনো ক্লাস মিস করে না অথবা ক্লাসে দেরি করেও আসে না। এক জরিপে দেখা যায় প্রায় ৯১% জাপানিজ শিক্ষার্থী বলেছে তারা কখনোই বা শুধু দুইএকটা ক্লাসে শিক্ষকের লেকচার মনোযোগ দিয়ে শুনেনি- বিশ্বাস করা যায়?
৯. একটি মাত্র পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নির্ধারন করে:
হাইস্কুল শেষে জাপানিজ শিক্ষার্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে হয় যা তাদের ভবিষ্যত নির্ধারন করে। শিক্ষার্থীদের একটি কলেজ সিলেক্ট করতে হয় যেখানে তারা পড়তে চায় এবং ওই কলেজের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট নম্বর পেতে হয়।
প্রায় ৭৬% শিক্ষার্থী তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে এই পরীক্ষার পর। বোঝাই যাচ্ছে কতো গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষা। এজন্য এই পরীক্ষাটিকে সেখানে ডাকা হয় “Examination Hell” নামে।
১০. কলেজের দিনগুলো একজন শিক্ষার্থীর শ্রেষ্ঠ সময়:
“Examination Hell” এর পরে শিক্ষার্থীরা একটি লম্বা ছুটি পায়। মাঝেমধ্যে তারা এই ছুটিকে বলে, ‘vacation before work’। জাপানে কলেজের সময়গুলো একজন শিক্ষার্থীর শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে ধরা হয়।