Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নতুন ঢাকা গড়ার জন্য মেয়র আনিসুলের উদ্যোগ

মেয়র আনিসুল হক আমার কয়েকজন প্রিয় মানুষের একজন। তার মৃত্যু আমার কাছে খুবই কষ্টকর। দেশবাসী বিশেষ করে ঢাকাবাসীর কাছেও কষ্টকর। তিনি নিজ কাজের মধ্য দিয়ে ঢাকাবাসীর অন্তরের অন্তঃস্থলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

chardike-ad

আনিসুল হক সম্পর্কে লিখতে গেলে স্থপতি হিসেবে আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি প্রথমে আলোকপাত করতে হয়। তিনি নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের অর্থাৎ আমাদের এবং পরিকল্পনা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কয়েকবার বসেছেন। ঢাকার মেয়র হলে রাজধানীকে কীভাবে একটি সুন্দর নগরীতে পরিণত করা যাবে, সেটি তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে, জনপ্রতিনিধিদের মাঝে খুবই বিরল। পেশাজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিজের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ঠিক করার ঘটনা আমার জানামতে খুব কম। রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধির এ ধরনের তথ্য সংগ্রহের খবর আমরা তেমন জানি না।

মেয়র হওয়ার পরে প্রথমেই তিনি আমাদের সঙ্গে বসেছেন। কয়েকবার বৈঠক করেছেন। কোন কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, কোন কাজগুলোর মাধ্যমে মানুষের আস্থাভাজন হওয়া যাবে, সেগুলো বাছাইয়ের ব্যাপারে তিনি আমাদের সহযোগিতা নিয়েছিলেন। আমাদের চিন্তাচেতনার সঙ্গে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। আমরা বলেছিলাম, ঢাকা শহরের বড় দুটি ঘটনা হলো— জলজট ও যানজট। জলজট নিয়ে তিনি প্রথমে কার্যক্রম শুরু করেন। আমরা বলেছিলাম, এ সমস্যা সমাধানে আপনি পেশাজীবীদের সঙ্গে নিয়ে দিকনির্দেশনা তৈরির জন্য আলোচনার ব্যবস্থা করুন। শুরুতেই তিনি এ কাজটি আরম্ভ করেছিলেন। পরবর্তী ধাপে ধাপে অনেক কাজ তিনি করে ফেলেন। বিলবোর্ডের অত্যাচারে ঢাকার আকাশ দেখার সুযোগ ছিল না। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হলো, এসব বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলা হবে। যারা বিলবোর্ডের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাদের পুনর্বাসনের চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। রাতারাতি বিলবোর্ডগুলো সরানোর ব্যবস্থা তিনি নিলেন এবং স্বয়ং মাঝরাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিলবোর্ডগুলো সরানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। বিলবোর্ডগুলো সরানোর ফলে প্রতিদিন মানুষের যাতায়াতে যেন কষ্ট না হয়, সেজন্য ভোর পর্যন্ত কার্যক্রমটি চলত।

আনিসুল হক সবুজ ঢাকা তৈরির চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো ঘটনা ঘটল যে, ফুটওভারব্রিজে প্রথম গাছপালার ব্যবস্থা করা। এ  ব্যাপারে তিনি আমাদের নিয়ে অনেকের সঙ্গে বসলেন, বৃক্ষ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে তিনি কাজটি শুরু করলেন। অনেকের দৃষ্টিতে কাজটি ছোট মনে হলেও সারা ঢাকা শহরের সব ফুটওভারব্রিজ কিন্তু তার দেখানো পথ ধরেই আজকে সুন্দর গাছপালা ও ফুলে সুশোভিত হয়েছে।

এরপর তিনি যানজট নিরসনে কিছু কাজ করেছেন। আমরা তাকে বলেছিলাম যানজট নিয়ে কাজ করতে হলে আপনাকে মালিকপক্ষের সঙ্গে বসতে হবে। তিনি মালিকপক্ষের সঙ্গে বসলেন। এসটিপিতে বলা হয়েছিল, তিনটি কোম্পানি গঠন করে ব্যক্তিমালিকানার বাসগুলো ওইসব কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। তিনি মালিকপক্ষের সঙ্গে বসলেন এবং চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত হলো, ছয়টি কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকা শহরের সব যানবাহনকে নিয়মনীতির মধ্যে নিয়ে আসবেন; বিদ্যমান বাস মালিকরা ওইসব কোম্পানির অংশীদার (শেয়ারহোল্ডার) হবেন। এ কাজে তিনি মালিকদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। সাত রাস্তার মোড়টি খালি করে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বহুতল পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করার চিন্তাভাবনা তিনি মালিকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। একইভাবে গাবতলীতে রাস্তা থেকে পার্কিং সরিয়ে নতুন করে বাস পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্য সিটি করপোরেশনের জায়গা উদ্ধার করেন। সেখানে কার্যক্রম শুরুর চিন্তাভাবনা করেন। তার কাজ এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ঢাকায় উন্নত মানের চার হাজার বাস নামানোর জন্য মালিকদের সঙ্গে নিয়ে আর্থিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনায়। এমনকি বিশ্বের অনেক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করেন।

সন্দেহ নেই, চার হাজার উন্নত মানের বাস নামানো এবং মালিকপক্ষের মাধ্যমে ছয়টি কোম্পানি করে রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ করা সম্ভব হলে ঢাকা শহরের যানজটের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী হয়ে যেত। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যেত। যানজট সমাধানের আলোচনার পাশাপাশি তিনি কিন্তু নিরীক্ষাস্বরূপ ‘ঢাকার চাকা’ প্রকল্প করে গুলশান এলাকার মানুষের চলাচলের একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে প্রতিনিয়ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চলছে। হ্যাঁ, ভাড়া নিয়ে অনেকের দ্বিমত এখনো রয়েছে। কিন্তু এটি একটি সুন্দর শুরু।

তিনি প্রায়ই একটি কথা বলতেন, ‘হাতিরঝিলের আদলে সমগ্র ঢাকা শহরকে তৈরি করতে চাই।’ যানজট নিরসনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি তার এখতিয়ারভুক্ত প্রতিটি এলাকার রাস্তার উন্নয়ন করেছেন। ফুটপাতের ব্যাপারেও তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমাদের। আমরা বলেছিলাম, ফুটপাত হতে হবে জনবান্ধব; সব বয়সের মানুষ যেন সুস্থ ও সুন্দরভাবে ফুটপাতে চলাচল করতে পারে। একসময় ফুটপাত থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নামতে হতো। আমাদের সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সেই ফুটপাতগুলো মানুষের যাতায়াতের উপযোগী করেছেন। বৃষ্টির পানি ধারণ করে ড্রেনেজ করার ব্যবস্থা করেছেন।

একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই, তিনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও হাত বাড়িয়েছিলেন। তিনি ঢাকা শহরের যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা নিরুৎসাহিত করতে অনেক ডাস্টবিন করেছিলেন এবং সেগুলো চূড়ান্তভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলেন। আরেকটি বিষয়, নির্বাচনের আগে আমরা তাকে বলেছিলাম, অন্তত একটি কাজ করে আপনি ঢাকা শহরের মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিতে পারেন। সেটি হলো, ৫০০-৬০০ উন্নত মানের গণশৌচাগার তৈরি। অর্থাৎ পুরুষ-নারীর পরিচ্ছন্ন টয়লেট সুবিধা নিশ্চিতে আমরা তাকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। বিভিন্ন স্থানে জায়গা পাওয়াসাপেক্ষে এ কাজগুলো শুরু করেন এবং পূর্ণ নিরাপত্তাসহ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অত্যাধুনিক সুবিধার পরিচ্ছন্ন টয়লেট তার এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় তিনি তৈরি করেছেন, যেটি বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি যে প্রচুর কাজ করেছেন, এর  মধ্যে সরকারিভাবে অনেক কাজ করার ক্ষমতা তার হাতে নেই। কিন্তু ব্যক্তি আনিসুল হক ও মেয়র আনিসুল হক সমন্বিতভাবে যুদ্ধ করে ক্ষমতার বাইরের কাজগুলোও সুন্দরভাবে সমাধানের রাস্তা দেখিয়েছেন। কিছু বিষয়ের সঙ্গে আমরা হয়তো দ্বিমত পোষণ করেছি। কিন্তু সেগুলোকে তিনি প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়ে পরবর্তীতে চূড়ান্ত সমাধানের কথাও চিন্তা করেছেন। তিনি একদম সফল হননি— এ কথা বলা যাবে না। আংশিকভাবে সফল হয়েছেন, তার এমন অনেক কাজও রয়েছে।

মূলত বিচিত্রমুখী কাজের জন্য আনিসুল হক আমার একজন প্রিয় মানুষ। জানি না অবর্তমানে তার স্বপ্নের ঢাকাকে তৈরি করার মানুষ আমরা খুঁজে পাব কিনা। আমাদের খুঁজে পেতে হবে। আমরা প্রচণ্ড আশাবাদী। তিনি নিজেও অসম্ভব আশাবাদী ছিলেন। তার প্রতি মানুষের এই আস্থা, সেটি হলো বাংলাদেশের রাজনীতি তথা মানুষের জন্য কাজ করার একটি বড় ভরসা। আস্থাশীল একজন মানুষ চাইলে অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। বিশ্বাস ও আস্থার মাধ্যমে তিনি মানুষের অন্তর জয় করেছিলেন। তার সবচেয়ে বড় যে গুণটি আমার দৃষ্টিতে আকর্ষণ করেছিল সেটি হলো, কোনো ভুল ধরিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেটি তিনি স্বীকার করে নিতেন, শুধরে নিতেন; যেটি বাংলাদেশের মানুষের ভেতরে, রাজনীতিবিদদের ভেতরে কমই দেখা যায়। এ ভুলত্রুটি স্বীকারের মানসিকতা মানুষকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়, যেটি আনিসুল হককে নিয়ে গিয়েছিল। পেশাজীবীদের সহযোগিতা ছাড়া তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। পেশাজীবীর সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তিনি কাজ করার চেষ্টা করেছেন। আমি আশা করি, তার এ শূন্যস্থানটি পূরণের জন্য বাংলাদেশে কিছু মানুষ অবশ্যই আছে। তারা এগিয়ে আসবে আনিসুল হকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। আনিসুল হকের পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সহানুভূতি থাকল। কারণ পরিবার-পরিজন যেভাবে তাকে সহযোগিতা করেছে, সেটা আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

আনিসুল হক ঢাকা শহরের উন্নয়নে নিজে এককভাবে নয়, পুরো পরিবারকে নিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার সন্তান, স্ত্রী আমাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতেন। আমরা আনিসুল হকের মধ্যে বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধির একটি আদর্শ রূপ দেখতে পাই। সোনার বাংলা গড়তে এ রূপটি যেন আমাদের জতিনিধিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, এই কামনা করি। আশাকরি, তার কাজের মাধ্যমেই তিনি সারা জীবন বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

মোবাশ্বের হোসেন, স্থপতি