Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাংলাদেশি শ্রমিকদের কষ্টের বিনিময়ে টিকে আছে সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার

singapore-labourযারা সিঙ্গাপুরে আসতে পাগল, ইনবক্স ভারী করছেন, সুদুত্তর না দেয়ায় গালি দিচ্ছেন পেট ভরে, তাদের একটা সত্য ঘটনা বলি, একেবারেই সাম্প্রতিক। এক কোম্পানির মালিকের ছেলের বিয়ে। বড় বস বাবা, সেকেন্ড বস ছেলে। সেকেন্ড বসের বিয়ে। সিঙ্গাপুরের বাইরে। ওভারসিজে।

শ্রমিকদের বেতন চার কার্ড, মানে দুই মাস না দিয়ে উড়াল দিয়েছে ৬০ জনের বহর নিয়ে। উড়ালের দিনপাঁচেক পর এক কার্ড রিলিজ হয়েছে। তিন কার্ডের হবে এক সময়। এই সময়ে খাবার চুরি হয়েছে। মানে একের অজান্তে অন্য জন খেয়েছেন। দশ, বিশ ডলারের হাওলাত হয়েছে। দুই চার ডলার চুরির সংবাদ আছে। কর্মক্ষেত্র থেকে মালামাল চুরি হয়েছে।

chardike-ad

একজন নতুন এসেছে, পুরাতন লোক। আগে ছিলেন এখানে। ছয় হাজার ডলার খরচ। পরিচিত জন মিথ্যা বলে এনেছেন। বাইশ ডলার বেতন। এখানে আঠার ডলার। মাসে সত্তর ডলার হাউস ভাড়া কাটিং। কাজ, বাথরুম, ড্রেন, বিল্ডিং ভাঙা, মানে যেকোনো কাজ। সকাল, সরি ভোর চারটায় গাড়িতে বসতে হয়, সকাল আটটা থেকে কাজের হিসাব। রাত সাতটায় কাজ শেষ। ক্যাম্পে পৌঁছাতে দশটা। রাত দশটার কাজ হলে বারোটা।

বেতন হয়েছে দুই মাসে পনের দিনের। খাবারের টাকা বাকি। মোবাইল বিল, খবর এসেছে কলেজপড়ুয়া মেয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙে ফেলেছে। ভারতীয় লোকটি পাগল প্রায়। প্রথম দিনের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারকে বলে আত্মীয়ের কাছে দৌড়। পরদিন সকালে ইঞ্জিনিয়ার জিজ্ঞেস করে কী খবর তোমার মেয়ের। কেঁদে উঠে হু হু করে। মেয়ের অপারেশন। ইঞ্জিনিয়ার কিছু বলে না। দূর থেকে দেখে, ভাবে তার ও দুটি মেয়ে আছে। দশ ডলার হাতে দেয়। কাজে মন নেই দেখে, ইঞ্জিনিয়ার বলে চলে যাও। কাজে থাকলে এক্সিডেন্ট করবে।

ইঞ্জিনিয়ারের বাসা ভাড়া বাকি। গত দু’দিন ধরে বাসার কেয়ারটেকার তাড়া দিচ্ছে। বাস কার্ডে টাকা নেই। বাবা অপেক্ষায় আছে সংসারের খরচের। স্ত্রী সন্তানের বাসা ভাড়া, টিউশন, স্কুল ফি ইত্যাদি। ইঞ্জিনিয়ারের এক বন্ধু প্রায় প্রতিমাসেই মাসের শুরুতে বাসা ভাড়া খরচ দিয়ে সচল রাখছে তাকে। শ্রমিক বা শ্রমজিবি সবাই। পারমিট, এস পাশ, পাশে তফাৎ। কষ্ট একই, ধরন ভিন্ন।

গত কয়েকদিন হলো দাস নামে এসেছে। সেও ধরা। যে কাজের কথা সে কাজ পায়নি। তাই প্রতিদিন টেলিফোনে ব্যস্ত। তর্কাতর্কি। হুমকি ধামকি। চলছেই। ইঞ্জিনিয়ারের অবস্থা করুণ। কাজ শেষ করার চাপ। ঠিকাদার ঠিক মতো আসে না। মালামাল ডেলিভারি আজকেরটা তিন দিন, সাত দিন,পনের দিন পর।

মূল মালিক পেমেন্ট দিচ্ছে না ঠিকাদারকে। ঠিকাদার দিচ্ছে না কর্মচারী আর ছোট ঠিকাদারদের। কোম্পানির ম্যানেজার হিমশিম খাচ্ছে ম্যানেজ করতে। চারদিকেই হাহাকার। অর্থের সংকট।

বাংলাদেশি শ্রমিক কষ্ট করে আসে নিজে স্থিতি না পেলেও বনে যায় এজেন্ট। নিজের অর্থ ব্যয় পোষাতেই শুরু করে লোক ঠকানোর ধান্দা। ভিসা ব্যবসা। একটি ভিসা হলে টাকা নিয়ে ক্যান্সেল করে দেয়া এখন প্রতারণার শীর্ষে। একটা আই পি তে মানে ভিসাতে মূল এজেন্ট সাব এজেন্ট তিন থেকে পাঁচজন। আর অনেক কোম্পানি কম হলেও দুই হাজার ডলার নিচ্ছে। আর পর প্রতি হাত দুই, তিন, পাঁচশত। কেউ আছে হাজার পনেরশ নিতেও দ্বিধা করে না। কোম্পানি আছে বা নেই ভালো মন্দ বিচার্জ নয়। লোক আসলে কিংবা আই পি হলে টাকা হাতানোই মূল টার্গেট। আর দেশে যারা আছে সব জানে। কোনো মতে ঢোকার পরিকল্পনা। এসেই শুরু হামলা, মামলা, মারামারি। জেনে শুনে বিষপান আর পাগল হোন, ইচ্ছা করে ধরা খান।

মানুষের সকল সময় এক যায় না। আজ আমির কাল ফকির। এই তো দুনিয়া। আজ যে ফোরম্যান কাল সে ওয়ার্কার। মেনে নিতে অনেকের কষ্ট। সব কাজ করতে হবে শ্রমিকের, এটাই সত্য। শোষিত হবে এটাই সত্য। দেশ আর বিদেশ ভালো চাকরি, ভালো কাজ ভাগ্যের ব্যাপার।

অনেকেই প্রশ্ন করে, আপনি বিদেশে থাকেন আর অন্যদের নিষেধ করেন? আরে ভাই আমাকে দিয়ে আপনাকে বিচার করা কি ঠিক! আমার অনেক বন্ধু আমার তিন, চার গুণ বেশি সেলারিতে ছিল এখন নেই। আবার অনেকেই অনেক ভালো আছে। আমার চেয়ে কম বেতনে ছিল, আছে, থাকবে।

অনেক শ্রমিক ভাইয়েরা রাগে, ক্ষোভে অভিমানে জেদে দেশে ফিরে যায়, গেছে। আবার ফিরে আসতে চাচ্ছে। কারণ যে একবার বিদেশে আসে তার ঠিকানা বিদেশ হয়ে যায়। দেশে খাপ খাওয়াতে পারে না। খুব কম আছে যারা নিজেদের দেশে প্রতিস্থাপন করতে পারে।

বিদেশের কষ্ট বিদেশিরা ছাড়া কেউ বোঝে না। সোজা কথায় বলি, সিঙ্গাপুরের অবস্থা ভালো নয়। শ্রমবাজার সংকুচিত হয়েছে এটাই সত্য। এ দেশে আঠার ডলার সেলারি, সাপ্লাই কোম্পানিতে কাজ। যেকোনো কাজ করতে হবে। এগারো মাসের পারমিট, থাকা খাওয়া প্রায় তিনশত ডলার যারা ডরমেটরিতে থাকে তাদের। রিলিজে বারোশত লেভি থাকা খাওয়াসহ দুই হাজার ডলার খরচ। সুপারভাইজার ইঞ্জিনিয়ার যারা বাইরে থাকে তাদের ন্যূনতম খরচ হাজার, বারশো ডলার এই সব বিবেচনা করে, প্লেন ফেয়ার, এজেন্ট মানি হিসাব করে সিঙ্গাপুরে আসা উচিত।

সব জেনে শুনে এখানে এসে মারামারি অশান্তি করে বাংলাদেশের বদনাম আর নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। আমি, আমরা কেন আছি, ভাগ্যে ছিল তাই আছি। যে কদিন রিজিক আছে থাকতেই হবে। কী বলেন?

আমি কিন্তু বিভিন্নভাবে সত্যটা তুলে ধরি। এ দেশ, এদেশের নিয়ম কানুন সব ঠিক আছে। কাগজপত্র ফুল টাইট ইন্সুরেন্স, আদালত, পুলিশ, সরকার, ফাস্টক্লাস। টুরিস্টদের জন্য আর পয়সাওয়ালাদের জন্য সিঙ্গাপুর এক বালাখানা। শ্রমিকের জন্য নয়। সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার খন ঝুঁকিপূর্ণ। সাবধান। আই পি রিজেক্ট হচ্ছে কোনোরূপ কারণ দর্শানো ছাড়া। টাকা হাতিয়ে নিয়ে কেনসেল করে দিচ্ছে। যার সাথে জড়িত বাংলাদেশি শ্রমিকও। যারা অলিখিত, প্রমাণ ছাড়া লাইসেন্সবিহীন ভ্রাম্যমাণ এজেন্ট। বেহাল হালচাল সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজারে। বাংলাদেশ হাইকমিশনের আওতায় কিন্তু এসব আই পি যাচাই বাছাই নেই। তাদের যেকোনো অনুষ্ঠানে ফিতা কাটানোই উত্তম। তারাও বইমেলা, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, উচ্চমার্গীয় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সরকারি দিবস, পাসপোর্ট ইত্যাদিতেই সীমাবদ্ধ। শ্রমবাজারে ধস আর রমরমা হলেই না হলেই কি, বাংলাদেশ সরকার তাদের বেতন ঠিকই দেবে। হুন্ডি চোরাচালান, কিংবা যেকোনো অপকর্ম তাদের এখতিয়ারে নয়।

বর্তমান হাইকমিশন আবার জনপ্রিয় এখন বিশেষ করে পূর্বের তুলনায়। পূর্বে যারা একটি আধটু প্রতিবাদ করতেন কাগজে কলমে তারা এখন সেলফি তুলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। পত্রপত্রিকায় তারিফও করেন। আসলেই মানুষের ঘরে ঘরে যেমন নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়, তেমনি এক লাখ ৬০ হাজারের কে কোথায় কোন অপকর্মে জড়িত তাও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। কোন কোম্পানি ভালো, কোন কোম্পানি মন্দ তারা জানবেই কেমন করে। কী করেইবা সেলারি ইস্যুতে কথা বলবে। এটলিস্ট শ্রমবাজারে এখন যে বিমানভর্তি লোক আসা যাওয়া করছে তা শ্রমিক এজেন্টদের বদৌলতে। বাংলাদেশ হাইকমিশনতো ভিসা বাড়লো কিংবা কমলো তা দেখবে না। কোথায় কোন কোম্পানিতে আই পি হলো তাও জানার কথা না। ফেসবুকে, অনলাইনে পত্রিকায় স্বল্প টাকায় সরকারিভাবে মালশিয়া, সৌদি আরব, কোরিয়ায় লোকজন নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখা গেলেও সিঙ্গাপুরের জন্য দেখা যায় না। কেউ আশাও করে না হয়তো।

সাবধান, যে আসবে তাকেই হতে হবে। টাকা তার। জীবন তার। কাউকে আঙ্গুল প্রদর্শন করে কোনো লাভ নেই। কূটনৈতিক তৎপরতায় বার চাঙা হবে সে আশা গুঁড়ে বালি। এক সময় টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এ দেশে এসে, পালিয়ে কাজ করে এই বাংলাদেশি শ্রমবাজারের সৃষ্টি। আজও টিকে আছে বৈধ, অবৈধ, প্রতারণার, ধৈর্যের ফলেই। বাংলাদেশি শ্রমিকদের কষ্টের বিনিময়ে টিকে আছে এই শ্রমবাজার, অন্য কোনো কারণে নয়।

লেখক: জাহাঙ্গীর বাবু, সিঙ্গাপুর প্রবাসী