Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ব্যাংক খাত থেকে শেয়ারবাজার, কঠিন আতঙ্কে দেশ

habiburরাজনৈতিকভাবে সুসময় হলেও আওয়ামী লীগ সরকার এই মুহুর্তে কঠিন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। অর্থমন্ত্রী থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থনীতিবিদ থেকে রাজনীতিবিদ সবার বক্তব্যেই ব্যাংকিং খাত থেকে শেয়ারবাজার ঘিরে চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমন সর্বত্র অর্থনৈতিক খাত রক্ষায় গভীর আকুতি উঠেছে।

রোববার জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন বাবলু অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যর্থতার অভিযোগ এনে অবসরে যেতে বলেছেন। তার মানে পদত্যাগ চেয়েছেন। জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেছেন, আজ অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অর্থনীতির রক্তক্ষরণের কারণে জাতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে অর্থনীতিকে দুর্বল করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন ডিসেম্বরে অবসরে যাবেন। বাবলুর প্রশ্ন, ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন রক্তক্ষরণ কন্টিনিউ করবেন , আজকে এখনি পদত্যাগ করুন , মানুষকে বাঁচান, জাতিকে বাঁচান। বাবলু আরও বলেন, অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা হয়নি। ব্যাংকখাতে আতংক, উদ্বেগ, উদভ্রান্তি বিরাজ করছে। হ্যাঁ, এই অবস্থা মানি মার্কেটের। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।

chardike-ad

প্রথমে পানামা পেপার্সে নাম আসলো, সরকার বা অর্থমন্ত্রী কোন ব্যবস্থা নিলেন না। তারপর প্যারাডাইস পেপার্সে অনেক ব্যবসায়ীর নাম আসলো। কোন ব্যবস্থা নিলেন না। এগুলো বিভিন্ন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমে ওয়াশিংটন ভিত্তিক কোম্পানি বের করেছে। অথেন্টিসিটি আছে। এগুলোর উপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে পদত্যাগ করতে হয়েছ। বাবলু বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারে সাতাশ জনের নাম এসেছে। কেউ রাজনীতিবিদ নন। ব্যবস্থা নিতে ভয় কিসের?

তিনি বলেন, সোনালী, রূপালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক থেকে চৌদ্দ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা চলে গেছে। এটা গৌরি সেনের টাকা নয়। ষোলকোটি জনগণের টাকা, কিভাবে দিলেন তার কোন জবাব নেই। এর আগে জাতীয় পার্টির আরেক এমপি ও সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, শেয়ার মার্কেটে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে। সূচক নেমে গেছে তলানি তে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নিম্নমুখী। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই মুহুর্তে শেয়ার বাজার নিয়ে আবার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। পঁচিশ শতাংশ শেয়ার বিক্রির একটি ষড়যন্ত্র চলছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পরে আমাদের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের স্ট্রাটেজিক পার্টনারের কাছে পঁচিশ ভাগ শেয়ার এখন কেন বিক্রি করবো! যে মুহুর্তে ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের মুখে, শেয়ার মার্কেট তলানিতে, সেই মুহুর্তে কারা এই ষড়যন্ত্র করছে ?

আওয়ামিলীগ নেতা মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ফার্মার্স ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলো। তাকে বের করে দেয়া হলেও ব্যাংকের টাকা নেই। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে নির্দোষ বলেছেন। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যে অনাস্থা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন সেখানে এ নিয়ে সরকারের কঠোর তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, অধ্যাপক আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংক শেষ করে গেছেন। সরকারি লোকজনই ব্যাংকিং খাত ডুবিয়েছে। অর্থমন্ত্রী এর আগেও শেয়ার বাজার লুটেরাদের বিরুদ্ধে ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর বলেছিলেন, ওদের হাত অনেক লম্বা। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর বলেছিলেন, নিজেদের লোকজনের কারণেই ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। অর্থমন্ত্রী সত্য বলার মধ্য দিয়ে বারবার অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন। কোন ব্যবস্থা কখনই নিতে পারেননি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর বলেছেন চার হাজার কোটি টাকা কোন টাকা নয়। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে সংস্কারের দাবি উঠলেও কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়েছে অনেক। ভুয়া এলসির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে অনেক টাকা।

একের পর এক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা , সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক ব্যক্তির হাতে একের পর এক ব্যাংক দখলে দেয়া, যার নিজেরই ব্যাংক ঋণ পচাত্তর হাজার কোটি টাকা। এতে করে গোটা ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের অনাস্থাই বাড়েনি , ভয়ভীতি আতংক গ্রাস করেছে গোটা ব্যাংকিং খাতকে। জনতার সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুদুল হাই বাচ্চু এখনো গ্রেফতার হননি, আইনের আওতায় আনা হয়নি। ব্যাংকগুলোতে এখন দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। তার নেতিবাচক প্রভাব পরেছে শেয়ারবাজারের গ্রাহকদের মাঝে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে দেশকে যখন মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সরকার সেখানে ডলারের দাম বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুদ্রাস্ফিতি ঘটতে যাচ্ছে। ডলারের দাম একশোতে যাবে। জনতা ব্যাংকের বারাকাত নাম পরিচয়হীন এক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন দলবাজ পরিচালকদের নিয়ে। ব্যাংক জালিয়াতির এই ঘটনা ভয়ের মাত্রা বাড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গভর্নর ডক্টর আতিউর রহমান পদত্যাগ করে চলে গেলেও জড়িত কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি কপাল খুলেছিলো কয়েকজনের। নিঃস্ব হয়েছিলো কয়েকলাখ মানুষ। পরবর্তীতে আইনের সংস্কার হলেও সেই মামলার আসামীরা এখনও ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের নেতৃত্বে কর্তৃত্ব ফলায়। ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি আরও কিছু লুটেরার কপাল খুলে দেয়। নিঃস্ব হয়ে পথে বসে যায় ৩২ লাখ বিনিয়োগকারী। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করেছিলো। রিপোর্টের আলোকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সুপারিশ হয়নি কার্যকর। বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল হক দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে বাজার স্থিতিশীল করে দেবেন। ছয় বছরে পারেননি। নিজের আখের গুছিয়ে ক্ষমতার দাপট ষোলআনা পূরণ করেছেন। শেয়ারবাজারে এখন সূচক ছয় হাজারের নিচে । পতন একশ পয়েন্টে। আতঙ্ক বিরাজ করছে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের চেয়েও ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে শেয়ারবাজার । এখন সরাসরি বিনিয়োগকারী চল্লিশ লাখের উপরে ২৫০টি ব্রোকার হাউজ পুঁজি বাজারে । সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। আতঙ্ক অস্থিরতায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে সবার।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে কৌশলগত বিনিয়োগকারী বা অংশীদারিত্ব ডিমিউচুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে ঢাকা স্টকএক্সচেঞ্জের পঁচিশ ভাগ শেয়ার কিনতে চায় চীনের সাংহাই ও শেনজেন স্টক কোম্পানি। সাংহাই বিশ্বের প্রভাবশালী পুঁজি বাজারের তালিকায় পঞ্চম আর শেনজেন অষ্টম স্থানে রয়েছে। তারা তিনশো সাত কোটি টাকা প্রযুক্তি খাতে সহায়তা দিতে চায়। বাইশ টাকা করে শেয়ার কিনে নয়শো বিরানব্বই কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে শেয়ারের দাম পরবে আঠাশ টাকা ।

অন্যদিকে ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ পনেরো টাকা করে শেয়ার কিনতে চায়। পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত এদেশীয় একটি কোম্পানি তাদের হয়ে পুঁজি বাজারে খেলছে আর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুঁজি বাজারের স্বার্থপরিপন্থী তৎপরতায় ভূমিকা রাখছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যেখানে তাদের স্বার্থ রক্ষায় চীনা কোম্পানির প্রস্তাব অনুমোদন দিতে চেয়েছে সেখানে সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বাগড়াই দেয়নি , পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত দালাল কোম্পানিটির হয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে।

এদিকে আইসিবি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো শেয়ার বাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য। সেখানে শেয়ার বাজারের টাকা নিয়ে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কাটিয়ে স্থিতিশীলতা রক্ষার বিপজ্জনক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আইসিবির চারশো কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দেউলিয়া ফার্মার্স ব্যাংককে দেয়া হচ্ছে । পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই অবস্থা চললে ব্যাংকিং খাতে করুণ বিপর্যয় ঘটবে, আর কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিতে গিয়ে পুঁজি বাজারের স্বার্থপরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে শেয়ার বাজারে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ধ্বস নামবে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামিলীগ সরকার সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও অর্থনৈতিক খাত নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এখন নির্বাচনী বছরে। দেশি বিদেশী বিনিয়োগও নেই। নেই কর্মসংস্থান ।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, পুর্বপশ্চিম বিডি ডট নিউজ
সৌজন্যে: পুর্বপশ্চিম বিডি