তলেতলে সম্পর্কটা চলে আসছিল। এ নিয়ে ফিসফাসও ছিল। কিন্তু এখন দিনকে দিন খুলে যাচ্ছে ঘোমটা। সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যকার আড়ালের ‘সম্পর্ক’ ক্রমেই আলোয় আসছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো।
সংস্কারের আওয়াজ তুলে নিজ দেশে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি আলোচিত।
সৌদি আরবের সিংহাসনে আছেন বাদশা সালমান। তবে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তাঁর ৩২ বছর বয়সী পুত্র। যুবরাজ নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিরও হর্তাকর্তা হতে মরিয়া। তাই তিনি আঞ্চলিক রাজনীতির নানা বিষয়ে বেপরোয়াভাবে হস্তক্ষেপ করে চলছেন। এসবের মধ্যে সম্প্রতি তাঁর কিছু বক্তব্য মুসলিম বিশ্বকে হতবাক করেছে। তাঁর কথার জের ধরে প্রশ্ন উঠেছে, এই যুবরাজ আসলে কী চান?
মার্কিন সাময়িকী দ্য আটলান্টিককে দেওয়া মোহাম্মদ বিন সালমানের সাক্ষাৎকারটি অনেকের জন্যই একটা ‘শক’। তাঁর অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কী হতে যাচ্ছে, তার কিছুটা হলেও আভাস মেলে এই সাক্ষাৎকারে। মোহাম্মদ বিন সালমান কোনো রাখঢাক না রেখে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রে বাস করার অধিকার আছে। ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের তাদের নিজস্ব ভূমির ওপর অধিকার আছে।
সৌদি যুবরাজের এই বক্তব্যের বার্তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’র মাধ্যমে যাদের গোড়াপত্তন, দখলদারির মাধ্যমে যারা টিকে আছে, তাদের পক্ষেই কথা বললেন মোহাম্মদ বিন সালমান। মধ্যপ্রাচ্যের ‘ক্যানসার’ ইসরায়েলের প্রতি কোনো আরব নেতার এমন প্রকাশ্য স্বীকৃতি বলতে গেলে বিরলই।
গত ডিসেম্বরে জেরুজালেমকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মোহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরবের ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। নামমাত্র বিবৃতি দিয়ে ‘দায়িত্ব’ সেরেছে রিয়াদ। এ সময় সৌদি যুবরাজের ‘বড় গলা’ থেকে কোনো ঝাঁজালো হুংকার বের হতে দেখা যায়নি।
চরম মুসলিমবিদ্বেষী ট্রাম্পকে ‘মুসলমানদের সত্যিকারের বন্ধু’ মনে করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। আর ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনার হলেন সৌদি যুবরাজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তো সেই বন্ধু কুশনার ও তাঁর স্ত্রী ইভাঙ্কা গত রোববার ইসরায়েলে ছুটে গেছেন। গত সোমবার জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানে তাঁরা অংশ নিয়েছেন। এদিন অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত প্রায় তিন হাজার। চারদিকে নিন্দার ঝড় বইছে। অথচ সৌদি যুবরাজ নিশ্চুপ।
অবশ্য সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ব্যাপারে মোহাম্মদ বিন সালমানের নীরবতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই তো সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি ইহুদিগোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে আলাপে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আলোচনার টেবিলে আসুন, শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করুন, তা না হলে অভিযোগ জানানো বন্ধ করে চুপ থাকুন।’
ফিলিস্তিনিদের মুখের ওপর এভাবে চুপ থাকতে বলে তাদের দীর্ঘদিনের স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকেই কার্যত অপমান করলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। একই সঙ্গে মার্কিন-ইহুদি চক্রকে সন্তুষ্ট করলেন তিনি।
মোহাম্মদ বিন সালমান আগ্রাসীভাবে ক্ষমতার খেলায় মেতেছেন। এই খেলায় জয়ী হতে তাঁর ফিলিস্তিনের প্রয়োজন নেই। প্রতিপক্ষ ইরানকে ঠেকাতে তাঁর দরকার ইসরায়েলকে। সেই লক্ষ্যে সব আয়োজন যে চলছে, তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চে ৭০ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ সৌদি আরবের আকাশ ব্যবহার করে ইসরায়েল যায়। কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে যোগাযোগের খবর গণমাধ্যমে আসছে। ইরান চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় সৌদি আরব ও ইসরায়েল বেজায় খুশি। এসব ঘটনা ও মোহাম্মদ বিন সালমানের নানান বক্তব্যে মনে হয়, ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ নীতি নিয়েছেন সৌদি যুবরাজ।
মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এই অবস্থার জন্য মোহাম্মদ বিন সালমানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। শত্রুতা ও অশান্তির মধ্যপ্রাচ্যে ‘রক্ত গরম’ যুবরাজের উচ্চাভিলাষ অর্জন দুরূহই হবে। -প্রথম আলো থেকে