সিউল, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩:
চলতি দশকে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হওয়ার পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বোধহয় রাজপথে মিছিল আর দেয়ালে চিকা মারার রাজনৈতিক ধারার অবসান ঘটেছে। মাঠের রাজনীতির প্রভাব কমিয়ে দিচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব। তবে এই প্রবণতার বিপরীতেই ইঙ্গিত করছে সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া হাতে লেখা পোস্টারগুলো।
ঘটনাটি শুরু করেছিলেন সিউলের ‘কোরিয়া ইউনিভার্সিটি’র ছাত্র জু হিউন উ। গত ১০ ডিসেম্বর ক্যাম্পাসের কয়েকটি জায়গায় সাদা কাগজে রঙিন সাইন পেন দিয়ে বড় বড় করে দেশ-সমাজের নানা অবক্ষয়সহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মনের সব ক্ষোভ উজাড় করে দেন। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘কদিন আগেই রেলের বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকায় একই সঙ্গে চার হাজার রেল শ্রমিককে ছাঁটাই করা হলো। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের অতিরিক্ত খুঁটি বসানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে একজন আত্মহত্যা করল। আপনার কি মনে হয়, এই অদ্ভুত সমাজে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে?’ জু হিউন উ তার পোস্টারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ করা, ভোগবাদ, দক্ষিণ কোরিয়ার উচ্চ আত্মহত্যা হার ইত্যাদি নিয়ে জনগণকে প্রশ্ন করে বলেন, ‘আমি কেবল এটাই জানতে চাই, আপনারা সবাই কেমন আছেন? যতক্ষণ না নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত এসবকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে কি আপনারা ঠিক থাকতে পারবেন?’
হিউনের এই পোস্টার ব্যাপক সাড়া ফেলে তার ক্যাম্পাসে। কয়েকজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করলে অন্য কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও পোস্টারটি দেখতে পান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তী এক সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পাসে জু হিউনের পোস্টারের প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসেবে অন্তত ৩০টি পোস্টার লেখা হয়। প্রতিটিতেই প্রায় একই উত্তর_ ‘না, জু। আমরা ভালো নেই!’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু হলেও হিউনের এই পোস্টার বর্তমানে ক্যাম্পাসের সীমা ছাড়িয়ে পুরো দক্ষিণ কোরিয়াতেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাসার গৃহিণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশা এবং বয়সের লোকজন নিজের কর্মস্থলে, বাসার সামনে অথবা ফেসবুকে সমাজের নানা সমস্যা তুলে ধরে তার নিচে লিখে দিচ্ছেন, ‘না, আমরা ভালো নেই’।
সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়াতে অনিচ্ছুক বা সময় পান না, এমন ব্যক্তিরাও এ ধরনের প্রতিবাদকে লুফে নিয়েছেন স্বদেশ নিয়ে নিজের উদ্বেগগুলো মানুষকে জানাতে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাবশালী পত্রিকা ‘হাংকিওরেহ’র দেয়া তথ্যমতে, কেবল বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজেই নয়, পোস্টারে লেখা প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির হাই স্কুলগুলোতেও। ‘আজকাল আপনি কেমন দিন কাটাচ্ছেন’ নামে প্রতিবাদকারীদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজটিতে ডিসেম্বরের ১৭ তারিখের মধ্যে ২ লাখ ৬১ হাজার লাইক পড়েছে।
ঠিক কী কারণে এত অল্প সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পেল এই পদ্ধতি? জবাবে ইয়ংইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চোই চ্যাং-রিউল বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ রাজনৈতিক ধারায় ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল কেউই জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। যেহেতু তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর সুনির্দিষ্ট কেউ নেই, তাই জনগণ সামষ্টিকভাবেই তাদের দাবি জানানো শুরু করেছে।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্লেষক কিম মান হা বিষয়টি দেখেন এভাবে_ ‘অনলাইনে কোনো কিছু পোস্ট করলে, তা সমালোচনা এবং অভিশম্পাতের পর্যায় এড়িয়ে কোনো গঠনমূলক কিছু সৃষ্টি করে না। এছাড়া সেখানে গোয়েন্দা নজরদারিও চলে। তাই নাগরিকরা বুঝতে পারল, অনলাইনের ক্ষুদ্র পরিসরে তাদের পোষাচ্ছে না। তাই হাতে লেখা পোস্টারের পুরনো অ্যানালগ পদ্ধতিতেই ফিরে গেল তারা।’
তবে রক্ষণশীলরা এরই মধ্যে পদ্ধতিটির সমালোচনা শুরু করেছেন। ফেসবুকে এ ধরনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার দৃশ্য পোস্ট করে অনেকেই বলছেন, ‘আমি এটা করেছি, কারণ আমি চাই না এই কমিউনিস্টরা স্কুলগুলোর সুনাম নষ্ট করুক।’ আর ছাত্রদের অনেকেই বলছেন, ‘রেল-শ্রমিকদের ধর্মঘটের বিরোধিতা আর বিদ্যুতের খুঁটি নির্মাণের সমর্থন করলেই কি আমি খারাপ ছাত্র হয়ে যাব?’ তথ্যসূত্র : বিবিসি, হাংকিওরেহ, কোরিয়া টাইমস।