Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দক্ষিণ কোরিয়ার ফিরে দেখা বিশ্বকাপ

মো. মহিবুল্লাহ, সিউল, ৬ জুন ২০১৪:

দক্ষিণ কোরিয়াকে বলা হয় এশীয় ফুটবলের ‘পাওয়ার হাউস’। ফুটবল বিশ্বকাপে গোটা এশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশী ন’ বার অংশগ্রহণকারী তেগুক শিবিরের নামকরণটাকে অযৌক্তিক মনে করার কোন কারণ নেই। ১৯৫৪ সালে প্রথম বিশ্বকাপ যাত্রাটা থমকে গিয়েছিল দীর্ঘ ৩২ বছরের জন্য। তবে ছিয়াশি থেকে শুরু হওয়া পুনর্যাত্রায় বিগত আটাশ বছরে আর কোন ছেদ পড়ে নি। প্রথম পাঁচটি অংশগ্রহণে জয়শুন্য দক্ষিণ কোরিয়া ২০০২ সালে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে একেবারে সেমিফাইনালে! এশিয়ার কোন দেশের পক্ষে ওটাই এ যাবতকালের সর্বোচ্চ সাফল্য। বিশ্ব ফুটবলের মর্যাদার লড়াইয়ের আরও একটি আসরের সামনে দাঁড়িয়ে একটু ফিরে দেখা যাক সময়ে সময়ে কেমন ছিল তেগুক যোদ্ধাদের পারফর্ম্যান্স।

chardike-ad

20140430T020522Z_1_LYNXMPEA3T01M_RTROPTP_3_SOCCERWORLD১৯৫৪ (সুইজারল্যান্ড)

ঠিক ষাট বছর আগে এই জুন মাসেই বিশ্বকাপের মাঠে প্রথমবারের মতো নেমেছিল দ্য রেডরা। ১৭ জুন হাঙ্গেরির বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচটা মোটেও সুখকর কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সেদিন কোরিয়ার জালে বল গিয়েছিল ন’ বার। সে কি আর আজকের বিবর্ণ হাঙ্গেরি? ওই দলে তখন খেলতেন পুস্কাস, কচসিস, যিবর, পালোটাসের মতো মাঠ কাঁপানো তারকারা। ২০০৯ সাল থেকে ফিফা যে বর্ষসেরা গোলের জন্য পুরস্কার দিয়ে যাচ্ছে সেতো ওই পুস্কাসের নামেই! সেদিন পুস্কাস দু’ গোল করেছিলেন, হ্যাট্রিক করেছিলেন কচসিস। তুরস্কের সাথে দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচটায়ও হজম করতে হয় ৭ গোল, হ্যাট্রিক করেন তুর্কি ফরোয়ার্ড বুরহান। দুই ম্যাচে মোট ১৬ গোলের বিপরীতে একটাও শোধ দিতে পারে নি তেগুকরা।

১৯৮৬ (ম্যাক্সিকো)

এরপরের সাতটা বিশ্বকাপের কোনটায় বাছাইপর্ব খেলার সুযোগ হয় নি, কোনটা নিজেরাই ইচ্ছে করে বর্জন করেছে আর বাকিগুলোতে বাছাইপর্ব পেরুনো সম্ভব হয় নি। পুরো ৩২ বছর পর ১৯৮৬ সালে নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ মিশনে নামে দ. কোরিয়া। আর্জেন্টিনা আর ইটালির কাছে যথাক্রমে ৩-১ ও ৩-২ গোলে হারতে হলেও বুলগেরিয়ার সাথে ১-১ ড্র নিয়ে দেশে ফেরে পার্ক ছাং-সুনের দল। বিশ্বকাপের মাঠে কোরিয়ার হয়ে প্রথম গোলটা করেন তৎকালীন অধিনায়ক পার্ক ছাং-সুন, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে।

১৯৯০ (ইটালি)

তৃতীয় যাত্রায় গ্রুপ পর্বে কোরিয়ার সঙ্গী হয় স্পেন, বেলজিয়াম, উরুগুয়ে। তিনটি ম্যাচেই পরাজয় দেখেন ছুং ইয়ং-হানরা। স্পেনের জালে হোয়াংবো কানের একটি গোলই সেবারের একমাত্র অর্জন।

১৯৯৪ (যুক্তরাষ্ট্র)

প্রথম ম্যাচেই স্পেনকে রুখে দেয় তেগুক শিবির। দ্বিতীয়ার্ধের দশ মিনিটের মাথায় ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ কোরিয়া একেবারে শেষ মুহূর্তের দু’ গোলে যে ড্রটা করলো সেটা জয়ের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। ৮৫ ও ৯০ মিনিটে রেডদের পক্ষে গোলদুটো করেন হং মিউং-বো এবং সিও জুং-উওন। পরের ম্যাচে বলিভিয়ার সাথেও গোলশূন্য ড্র সামান্য সময়ের জন্য দ্বিতীয় পর্বের আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু শেষ ম্যাচে জার্মানির কাছে ৩-২ ব্যবধানের হারে সে আশা আর আলোর মুখ দেখে নি।

১৯৯৮ (ফ্রান্স)

মেক্সিকোর সাথে ৩-১, ন্যাদারল্যান্ডের কাছে ৫-০ হারের পর সান্ত্বনা ছিল কেবল শেষ ম্যাচে বেলজিয়ামের সাথে ১-১ ড্র। যথারীতি পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থেকে গ্রুপ পর্বেই শেষ কোরিয়ার পঞ্চম বিশ্বকাপ।

২০০২ (কোরিয়া-জাপান)

২০০২, দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবল ইতিহাসে আজতক সবচেয়ে সফল বছর। পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগাল…গ্রুপমেটরা কেউই সহজ প্রতিপক্ষ ছিল না। কিন্তু ঘরের মাঠ আর দর্শক সবকিছুই যেন সরল অঙ্ক বানিয়ে ছেড়েছিল! প্রথম ম্যাচে হোয়াং সুন-হং, ইয়ো সাং-ছুলের গোলে পোল্যান্ডকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে দারুণ সূচনা করে স্বাগতিকরা। পরের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১-১ ড্রয়ের পর গ্রুপের হিসেব-নিকেশে কোরিয়ার ইতিহাস গড়তে প্রয়োজন ছিল পর্তুগালের সাথে স্রেফ আরেকটা ড্র। কিন্তু ড্র নয়, পার্ক জি ছুংয়ের গোলে ফিগোদের হারিয়ে দিয়েই বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় পর্বে উন্নীত হয় দক্ষিণ কোরিয়া। রাউন্ড অব সিক্সটিনে ইটালিকে ২-১ আর কোয়ার্টার ফাইনালে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে স্পেনকে টাইব্রেকারে ৫-৩ ব্যবধানে হারিয়ে শেষ চারে…পুরো সময়টা যেন স্বপ্নের মতোই কাটতে লাগলো। ২৫ জুন সিউল ওয়ার্ল্ড কাপ স্টেডিয়ামে জার্মানির বিপক্ষে সেমিফাইনাল, কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারীতে ষাট সহস্রাধিক রেড ডেভিলের সাথে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিম দে জুংও। শুরু থেকেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে সমানে সমানে লড়ছিলেন হং মিউং-বোরা। পার্ক জি ছুংদের দু’ দুটো আক্রমণ ঠেকিয়ে দেন জার্মান গোলরক্ষক অলিভার কান। ৭৫ মিনিটের মাথায় বাঁ দিকের উইং ধরে বল পায়ে ছোটেন জার্মানির অলিভার নিউভিলে, গোলমুখে তাঁর আড়াআড়ি পাস থেকে মাইকেল বালাকের শট প্রথম দফায় ফিরিয়ে দিলেও উপর্যুপরি দ্বিতীয় শটে পরাস্ত হন কোরিয়ার গোলকিপার লি উওন-যে। জার্মানি ১-০ দক্ষিণ কোরিয়া; ইতিহাসের আরও একটা ধাপ পেরুনোর স্বপ্নটা সিউলের স্তব্ধ গ্যালারীতে কান্না হয়ে ঘুরে ফিরলো। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তুরস্কের কাছে ৩-২ ব্যবধানে হেরে চতুর্থ স্থান নিয়েই নিজেদের সবচেয়ে সফল বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া।

২০০৬ (জার্মানি)

টোগোর বিপক্ষে ২-১ জয় আর ফ্রান্সের সাথে ১-১ ড্র, টানা দ্বিতীয়বার গ্রুপ পর্ব উৎরানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছিল লি উওন-যে বাহিনী। কিন্তু শেষ ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের কাছে ২-০ হারে পয়েন্ট টেবিলের তৃতীয় স্থান আর ৩২ দেশের মধ্যে ১৭তম থেকেই সিউলের বিমান ধরে তেগুক যোদ্ধারা।

২০১০ (দক্ষিণ আফ্রিকা)

গ্রীসকে ২-০ গোলে হারিয়ে শুরু, পরের ম্যাচে আর্জেন্টিনার কাছে ৪ গোল খেয়ে শোধ দেয়া গেলো কেবল একটি। ২ ম্যাচ থেকে ৩ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ পর্ব পেরোতে নাইজেরিয়ার সাথে শেষ ম্যাচে একটা ড্রই চলতো…২-২ স্কোরলাইন কাঙ্ক্ষিত ফলটা এনে দিল। দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে খেলার সুযোগ পেলো কোরিয়া। রাউন্ড অব সিক্সটিনে উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে সুয়ারেজের গোলে খেলার ৮ মিনিটেই পিছিয়ে পড়তে হয় পার্ক জি সুংয়ের দলকে। ৬৮ মিনিটে সমতা আনেন লি ছুং ইয়ং; কিন্তু ৮০ মিনিটের মাথায় আরও একটা গোলে কোরিয়ার অষ্টম বিশ্বকাপ ওখানেই শেষ করে দেন লুইস সুয়ারেজ।

১২ জুন থেকে ব্রাজিলে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপের কুড়িতম আসরে নবমবারের মতো এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাচ্ছে তেগুক ওয়ারিওর্স। টাচলাইনে থাকবেন ২০০২ বিশ্বকাপ দলের অধিনায়ক হং মিউং-বো। পার্ক ছু-ইয়ং, লি ছুং-ইয়ংয়ের মতো পরিণত ফরোয়ার্ডদের সাথে দলে আছেন সন হিউং-মিন, কি সুং-ইয়েংয়ের মতো উঠতি তারকারা; আর্ম ব্যান্ড থাকবে মধ্যমাঠের কারিগর কো জা-ছলের বাহুতে। বেলজিয়াম, রাশিয়া, আরজেরিয়ার গ্রুপটা আরও একবার গ্রুপ পর্ব পেরুনোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়াকে…অন্তত সাম্প্রতিক এক জরিপে এমন আশার কথাই জানিয়েছেন আশি ভাগ কোরিয়ান। বয়সের গড়ে আসরের সবচেয়ে নবীন দলগুলোর একটিকে নিয়ে কোরিয়ার সবচেয়ে সফল দলের অধিনায়ক এ যাত্রায় কতদূর যেতে পারবেন? ধারণা পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৭ জুন (কোরিয়ান সময় ১৮ জুন) পর্যন্ত…রাশিয়ার বিপক্ষে সেদিনই প্রথম ব্রাজিলের মাঠে নামবে তেগুক তরুণরা।