রবিবার । জুন ১৫, ২০২৫ । ৮:৩৭ অপরাহ্ন
বাংলা টেলিগ্রাফ ডেস্ক আন্তর্জাতিক ১৫ মে ২০২৫, ৪:২০ অপরাহ্ন
শেয়ার

অফিসের কর্মীদের অতিরিক্ত পরিশ্রম না করতে উৎসাহিত করছেন চীনা কর্মকর্তারা


অফিসের কর্মীদের অতিরিক্ত পরিশ্রম না করতে উৎসাহিত করছেন চীনা কর্মকর্তারা

 

পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে সাপ্তাহিক দুই দিনের ছুটি কর্মীদের একটি স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু চীনে এখনো প্রতি সপ্তাহে দুই দিন বিশ্রামের নিশ্চয়তা নেই। অনেক শিক্ষার্থী হাই স্কুলে উঠতেই এই ধারণা থেকে সরে আসে। বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতের কর্পোরেট কর্মীদের জন্য অতিরিক্ত সময় কাজ করা প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।

২০১৯ সালে আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা ‘৯৯৬’ সংস্কৃতির পক্ষে মত দেন—অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, সপ্তাহে ছয় দিন কাজ। তিনি এটিকে আখ্যা দেন ‘একটি বিরাট আশীর্বাদ’ হিসেবে।

তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিন্ন এক ধারা দেখা যাচ্ছে। এখন অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের নির্ধারিত সময়ে অফিস ছাড়তে উৎসাহিত করছে।

হোম অ্যাপ্লায়েন্স নির্মাতা মিডিয়া অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি অভিযান শুরু করেছে। এর আওতায় প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে কর্মীদের অফিস ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বলেন, ‘৯৫ শতাংশের বেশি ওভারটাইম আসলে শুধুই লোক-দেখানো।’

ড্রোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ডিজেআই, যারা আগে দীর্ঘ কর্মঘণ্টার জন্য পরিচিত ছিল, তারাও এখন রাত ৯টার মধ্যে অফিস খালি করার নির্দেশ দিচ্ছে। যদিও এই সময়সীমাও অনলাইন জগতে সমালোচিত হয়েছে। অনেকের মতে, এটি এখনও অত্যধিক দীর্ঘ কর্মঘণ্টা।

এই নতুন নীতিমালাগুলো চীনের বর্তমান দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যকে সামনে রেখে নেওয়া হয়েছে।

প্রথম লক্ষ্য হলো ‘নেইজুয়ান’ নামের একটি সামাজিক প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আনা। অনেক সময় একে ‘অভ্যন্তরীণ অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা’ বা ‘অভ্যন্তরীণ অবনমন’ বলা হয়। এই শব্দটি এমন পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে অতিরিক্ত শ্রমের পরও উন্নতি হয় না একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ানো এর একটি সহজ উদাহরণ।

চীনা সরকার এই আত্মবিধ্বংসী, চরম প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি থেকে দেশটির জনগণকে বিরত রাখতে চায়।

এই নতুন নীতিকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। ‘নেইজুয়ানে’ আটকে পড়া কর্মজীবীরা অনলাইনে নানা ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করছেন। একটি সংবাদপত্র তাদের মন্তব্যের সারাংশ তুলে ধরে জিজ্ঞেস করেছে, ‘যে প্রতিষ্ঠানগুলো এত দিন নির্মম ওভারটাইম চালু রেখেছিল, তারাই কি এখন নেইজুয়ানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেবে?’

অনেকে মনে করছেন, ইউরোপের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞাই হয়ত এই পরিবর্তনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। সেখানে অতিরিক্ত ওভারটাইম বা জোরপূর্বক শ্রমে তৈরি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, যা রপ্তানিমুখী চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপের মুখে ফেলেছে।

দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, মানুষের ছুটি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে রপ্তানি ও অবকাঠামোগত নির্ভরতা থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ব্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া।

চলতি বছরের মার্চে চীনা সরকার ‘বিশেষ কর্মপরিকল্পনা’ ঘোষণা করে, যেখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়। সেখানে ‘ওভারটাইম সংস্কৃতির তীব্রতা’কে একটি ‘প্রধান সংকট’ হিসেবে উল্লেখ করে কর্মীদের ‘বিশ্রাম, ছুটির অধিকার ও স্বার্থ’ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

এ বছর সরকার দুটি অতিরিক্ত সরকারি ছুটিও ঘোষণা করেছে। কারণ, মানুষ যদি সারাক্ষণ ডেস্কে বসে থাকলে বাইরে খাওয়া-দাওয়া বা কেনাকাটায় অর্থ ব্যয় করানো কঠিন হয়ে পড়ে।

এই পরিবর্তনগুলোকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখছেন। পিনডুওডুও ও বাইটড্যান্সের মতো প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত কাজের চাপে কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করেছে। প্রযুক্তি খাতের কর্মীরা নিজেদের আখ্যা দিচ্ছেন ‘নিউমা’ বা ‘বোঝা বহনকারী জন্তু’ হিসেবে।

২০২১ সালে চীনের সর্বোচ্চ আদালত ‘৯৯৬’ কর্মসূচিকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল। তবে এই রায় বাস্তবায়নে বেশ অনীহা দেখা গেছে। এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানে ‘বড় সপ্তাহ, ছোট সপ্তাহ’ পদ্ধতি চালু আছে—অর্থাৎ এক সপ্তাহে পাঁচ দিন, পরের সপ্তাহে ছয় দিন কাজ।

এই প্রবণতাগুলোর স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় বেইজিংয়ের হাইডিয়ান জেলায়, যা চীনের সিলিকন ভ্যালি হিসেবে পরিচিত।

একটি ক্লাউড-কম্পিউটিং প্রতিষ্ঠানের কর্মী ট্যাং বলেন, একসময় রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত অফিসে থাকা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হতো। কিন্তু এখনকার তরুণ সহকর্মীরা এ বিষয়ে অনেক কম সহনশীল। তবে কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বিকল্পের অভাব রয়েছে।

ট্যাং বলেন, ‘অর্থনীতি ভালো থাকলে কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বলা যায়।’

তিনি সম্প্রতি চাকরি পরিবর্তন করেছেন, কারণ নতুন চাকরিটিতে চাপ তুলনামূলকভাবে কম এবং তিনি প্রায়ই সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই বাসায় ফিরতে পারেন।

একসময় একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে পুড়ে যাওয়ার পর, ৩৬ বছর বয়সী লি ছয় মাসের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। পরে আবার একটি ইন্টারনেট ফার্মে যোগ দেন তিনি।

গত বছর তাঁর ১৫ দিনের বার্ষিক ছুটির মধ্যে মাত্র ছয় দিন ছুটি নিতে পেরেছিলেন। তার বয়সী অনেকে সন্তান নেওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন—কারণ তাঁরা নিজেরাই ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারছেন না, ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও আশাবাদী নন।

লি বলেন, ‘এটা শুধু আর্থিক চাপ নয়। আপনি নিজেই যদি ভালো জীবন কাটাতে না পারেন, তাহলে সন্তান নেওয়ার মানে কী?’

চীনের সেবা খাতের কর্মীদের অবস্থা আরও কঠিন। মাসে হাতে গোনা কয়েক দিনের বেশি ছুটি মেলে না—অনেক সময় সেটুকুও না।

সানলিতুন শপিং এলাকায় একটি নুডলস রেস্তোরাঁর এক শেফ ধূমপানের বিরতিতে বলেন, মালিক ছুটি নিতে দিলেও বেতন কেটে রাখেন। তাই বেশিরভাগ সহকর্মীই ছুটির চেয়ে পূর্ণ বেতনকেই বেছে নেন। আসলে চীনা জনগণকে কাজ থেকে দূরে রাখা খুব সহজ বিষয় নয়।