Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দালাল ও অসাধু চক্রের হাতে জিম্মি এমআরপি পাসপোর্ট

মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ইস্যু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড আবদ্ধ হয়ে আছে দালাল চক্র ও অসাধু কর্মকর্তার সিন্ডিকেটে। অধিক নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও সহজপ্রাপ্যতার জন্য যন্ত্রে পাঠযোগ্য এমআরপি ইস্যুর কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও গ্রাহক হয়রানি রয়েছে প্রায় আগের মতোই। দালাল চক্রের নানামুখী হয়রানি যেন পাসপোর্ট অফিসের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজের দ্রুততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়া হলেও বছরের পর বছর অপরাধী চক্র রয়েছে বহাল তবিয়তে। বরং এমআরপি পাসপোর্ট এখন অহরহ অনেকের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ভুল এবং তা সংশোধন করতে গিয়ে ব্যাপক হয়রানি ও আমলাতান্ত্রিকতার কারণে।

এমআরপি পাসপোর্টে নির্ভুল তথ্যসহ যথাসময়ে পাসপোর্ট সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা হয়ে উঠছে না একটি অসাধু চক্রের কারসাজিতে। গ্রাহকদের থেকে বাড়তি সুবিধা নিতে ইচ্ছাকৃত ভুল করার অভিযোগ রয়েছে। তাদের এ ভুলের মাশুল গুণতে হচ্ছে গ্রাহকদের বাড়তি টাকা দিয়ে। কিন্তু অপরাধীরা থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

chardike-ad

রাজধানীর আগারগাঁওস্থ পাসপোর্ট অফিস সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে,  সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন, জরুরি পাসপোর্ট গ্রহণ, সংশোধন এবং নবায়ন সব কাজেই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। দালালের খপ্পর থেকে বাঁচতে চাইলে পোহাতে হচ্ছে আরেকটু বেশি ঝামেলা। স্থানীয় প্রশাসনের নানা (লোক দেখানো) পদক্ষেপে কমছে না দালালদের তৎপরতা। দিনের পর দিন হয়রানি যেন বাড়ছেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকাল সাতটা থেকে পাসপোর্ট অফিসের সামনে বিশাল লাইন। এর বাইরে কিছু লোক ঘুরাফিরা করছে সতর্ক দৃষ্টিতে। তাদের টার্গেট নতুন মক্কেল। সুযোগ মত জানতে চাইছে কার কি সমস্যা। সেই সাথে দিচ্ছে লোভনীয় অফার। এ চক্রে রয়েছে কয়েকজন ধূর্ত মহিলা। যারা প্রাথমিক টার্গেট ঠিক করে।

কুমিল্লা থেকে এক মহিলা এসেছেন তার এবং দুই সন্তানের পাসপোর্ট করতে। কিন্তু তিনি জানেন না, তাকে কি করতে হবে। এই সুযোগ গ্রহণ করে দালাল শিপু। সে জানায়, একটি পাসপোর্টের জন্য তাকে দিতে হবে দশ হাজার টাকা। অথচ, এই পাসপোর্টের সরকারি ফি প্রতিটি তিন হাজার করে নয় হাজার টাকা। এক পর্যায়ে তিনটি পাসপোর্ট একুশ হাজার টাকায় তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে প্রায় ৩০ জন দালালের একটি চক্র নিয়মিত কাজ করে। এদের বড় একটি অংশ মহিলা, যারা পাসপোর্ট অফিস গেইটের বিপরীতের ফুটপাতে অবস্থান করে। সকাল সাতটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত তারা এই জায়গায় অবস্থান করে। এই সংঘবদ্ধ চক্রের সিন্ডিকেটে রয়েছে খোদ পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা। এ চক্রটি ঢাকার বাইরে এবং ভিতরের কিছু অনিয়মিত দালালের মাধ্যমেও গ্রাহক সংগ্রহ করে।

দালালদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট থাকায় এই চক্রের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করারও সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে পুলিশ দু’একজনকে আটক করলেও কোন ফল নেই। পরের দিন ঠিকই তারা একই কাজে যোগ দেয়। শেরে বাংলানগর থানার তিনটি টিম পাসপোর্ট অফিসের কাজে নিয়োজিত থাকলেও প্রয়োজনে তাদের দেখা পাওয়া যায় না।

কাজের সুবিধার্থে দালালদের রয়েছে কয়েকটি গ্রুপ। এদের একটি চক্র কাজ করে আবেদনকারীর ফরম পূরণ ও কাগজপত্র সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে। একটি চক্র খুঁজে খুঁজে লাইনে দাঁড়ানো গ্রাহকদের কাগজপত্র সত্যায়নের কাজ করে। এরা ভোরে এসে লাইনে দাঁড়ায়। পরে টাকার বিনিময়ে স্থান পরিবর্তন করে। এরা হচ্ছে ছোট দালাল। এছাড়া রয়েছে নবায়ন ও চুক্তিভিত্তিক পাসপোর্ট করে দেয়ার জন্য বড় (অভিজ্ঞ) দালাল। তারা একে অন্যের যোগসাজশে কাজ করে। ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজের জন্য এরা চুক্তি করে থাকে।

অনেক সময় এ দালালদের টাকা দিলেই গ্রাহকের সমস্যার সমাধান হয় না। পরবর্তীতে পোহাতে হয় বিভিন্ন অজুহাতে বিলম্বে পাসপোর্ট পাওয়া এবং তথ্য ভুলের ঝামেলা। তখনই বাঁধে বিপত্তি। নামের বানান অথবা ঠিকানায় কোন ভুল হলে আরেক দফায় গুণতে হয় বড় অংকের টাকা। এ নিয়ে দালালদের সাথে মাঝেমধ্যে ঝগড়া-ঝাটির ঘটনাও ঘটে বলে জানা যায়।

অন্যান্য হয়রানির মধ্যে আরেকটি হয়রানি হচ্ছে ভুল তথ্য সংশোধন। নিয়ম অনুযায়ী সংশোধন করতে হলেও নতুন পাসপোর্টের পূর্ণাঙ্গ ফি দিতে হয়। যা অমানবিক বলেও মনে করছেন গ্রাহকরা।

bangladesh-passportমিরপুরের বাসিন্দা ইমরান গত মাসে পাসপোর্টের আবেদন করেন। পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর দেখেন, তার পিতার নামের বানান ভুল। সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সত্যায়িত কপি ও ব্যাংকে ফি জমা দেয়ার রসিদসহ সংশোধনের আবেদন করতে হবে।

এ বিষয়ে ইমরান শীর্ষ কাগজকে বলেন, ‘আমি ফরম পূরণ করেছি অনলাইনে। এতে ভুল হওয়ার কোন কারণ নেই। সব তথ্য অনলাইনেই আছে। তবু কীভাবে ভুল হল তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার সামান্য ভুলের জন্য দিতে হবে নতুন পাসপোর্টের সমপরিমাণ ফি। ডিজিটালের নামে নাগরিক হয়রানির নতুন পদ্ধতি খোলা হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুল সংশোধন করতে সামান্য সময় লাগলেও এতে বেশি লাভবান হয় দালাল চক্র। তারা সহজেই হাতিয়ে নিতে পারে গ্রাহকের টাকা। অন্যদিকে ভিতরের অসাধু চক্রের সাথে রয়েছে এদের নির্দিষ্ট চুক্তি। যার শিকার অসহায় ভুক্তভোগী গ্রাহক। এ সমস্যার কোন প্রতিকার বা অভিযোগের জায়গাও নেই গ্রাহকদের।

হয়রানির শিকার কয়েকজন পাসপোর্ট আবেদনকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ এবং নিয়মকানুন না জানায় তারা দালালের খপ্পরে পড়েন। ৭দিন এবং ১৫ দিনে পাসপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও পুলিশ প্রতিবেদনের কারণে পাসপোর্ট পেতে একমাস লেগে যায়। এই সুযোগ নিয়ে দালালরা দাবি করে তারা দ্রুত পাসপোর্ট করে দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিতরাই বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় এবং অধিক নিরাপত্তার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা প্রাপ্তি সহজ করতে ২০১০ সালে সরকার মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ও ভিসা বিতরণ প্রকল্প হাতে নেয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দু’টি প্রকল্পের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে দেশের অন্যান্য স্থান থেকেও এমআরপি পাসপোর্ট ইস্যু করা হচ্ছে। ৭ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে ছয় হাজার টাকা এবং ১৫ দিনের মধ্যে সাধারণ পাসপোর্ট পেতে তিন হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

সেনাবাহিনী এ প্রকল্প শুরু করার পর পাসপোর্ট অফিসে দালালদের উৎপাত কমলেও ক্রমান্বয়ে তা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। আবেদনকারীদের অজ্ঞতা এবং সরকারি অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে দালালরা হয়রানি করে যাচ্ছে আবেদনকারীদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা শীর্ষ কাগজকে বলেন, প্রতিদিন আমরা দুই হাজারের অধিক পাসপোর্ট গ্রহণ করি। কিন্তু আবেদনকারীর সংখ্যা অনুযায়ী তা অনেক কম। এই সুযোগ নেয় কিছু অসাধু চক্র। তবে আমরা সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখি।

গ্রাহক পরিচয় দিলে একজন দালাল এ প্রতিবেদককে জানায়, এখানে আমরা কয়েকজন মামাদের সাথে কাজ করি। মামারা অফিসের ভিতরে গিয়ে কাজ করে। পাসপোর্ট তৈরির যাবতীয় সব কাজই আমরা করে দিতে পারি। কাস্টমারের কাজ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা টাকা নিই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও আনসার সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এ দালাল চক্রের। তাদের মাধ্যমে দালালরা কাজ করে থাকে। টাকা লেনদেনও করা হয় সরাসরি। পাসপোর্ট অফিসের পুরনো ও নতুন দুই ভবনেই দালালদের অবাধ যাতায়াত। এদের সাথে সহজে কথা বলা যায় না। সাধারণ মানুষ হিসেবে কথা বলতে চাইলে তারা কোন প্রশ্নের জবাবও দিবে না। শুধুমাত্র গ্রাহক হলে একপাশে নিয়ে তাদের যাবতীয় সুবিধার কথা জানাবে। সাংবাদিক পরিচয় দিলে তারা অন্যদিকে চলে যায়।

পাসপোর্ট তৈরির তথ্য যাচাই ও পুলিশি তদন্তে উপেক্ষিত হয়ে আসছে জাতীয় পরিচয় পত্র। বাধ্যতামূলক না হলেও বিভিন্ন কাজকর্মে জাতীয় পরিচয়পত্র চাওয়া হয়। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ব্যবহার না করে গ্রাহক হয়রানি করা হয় নিয়মিত। যে তথ্য বা ঠিকানা পুলিশ যাচাই করতে পনের দিন সময় লাগে তা সহজে যাচাই করা যায় জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ভাণ্ডার থেকে। পাসপোর্ট বিভাগের জন্য এটা সহজ এবং কম সময়ের কাজ।

ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম শীর্ষ কাগজকে বলেন, ‘নিরাপত্তার কারণে পাসপোর্ট পেতে দুই-তিন দিন দেরি হলেও আগের মত দালালদের দৌরাত্ম্য নেই। কিছু দালাল থাকলেও নিয়মিত পুলিশি অভিযানে তারা সুবিধা করতে পারে না।’ দালালদের থেকে বাঁচতে হলে জনগণকে সচেতন হতে হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

এছাড়া পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের অবহেলায় পাসপোর্টে ভুল হয় এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করি। নাগরিক হয়রানি নয়, সেবা করাই আমাদের কাজ।’

এই দালালদের সাথে পুলিশের গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠছে। তাই আটকের পরই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। গত কিছুদিন আগে ফারুক ও সুমন নামে দুই দালালকে আটক করে শেরে বাংলা নগর থানা পুলিশ। পরদিন আদালতে নেয়ার কথা থাকলেও পরে রাত দশটায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। থানার একজন এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

শেরে বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শীর্ষ কাগজকে জানান, দালালদের সাথে পুলিশের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। পাসপোর্ট অফিসে দালালদের তৎপরতা রোধে পুলিশের দু’টি মোবাইল টিম নিয়মিত কাজ করছে। এছাড়া রয়েছে র‌্যাবের টহল ইউনিট। তবুও দালালদের তৎপরতা রয়েছে এটা সত্য। আইন-শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি জনগণ সচেতন হলে এই অপতৎপরতা বন্ধ হবে।

পাসপোর্ট নাগরিকের ব্যক্তিগত ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। অথচ এ পাসপোর্ট তৈরি হচ্ছে খুবই অনিরাপদ পরিবেশে। প্রশাসনের অবহেলায় এবং অসাধু কর্মকর্তাদের নীরবতায় দালালদের দৌরাত্ম্য চলছে বছরের পর বছর। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন খোদ পাসপোর্ট অফিসের কর্তারা। তারা মনে করেন, সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তি অনুযায়ী এ বছর তারা দায়িত্ব হস্তান্তর করলে এ সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। নাগরিক সেবা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।

-শীর্ষ কাগজের সৌজন্যে