বুধবার । জুন ১৮, ২০২৫
বাংলা টেলিগ্রাফ ডেস্ক আন্তর্জাতিক ৪ জুন ২০২৫, ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী লি জে-মিয়ং


দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী লি জে-মিয়ং

দক্ষিণ কোরিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী লি জে-মিয়ং। গত ডিসেম্বর মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের স্বল্পস্থায়ী সামরিক আইন জারির ঘটনার পর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

ন্যাশনাল ইলেকশন কমিশনের (এনইসি) তথ্য অনুযায়ী, শতভাগ ভোট গণনা শেষে লির ভোট ছিল ৪৯.৪২ শতাংশ, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির কিম মুন-সু পেয়েছেন ৪১.১৫ শতাংশ।

নিজের বাড়ির বাইরে সংবাদ সম্মেলনে লি ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার প্রতি যারা বিশ্বাস রেখেছেন, তাদের আশা ভর করে আমি দায়িত্ব ও মিশন সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করবো। আমাদের জনগণের প্রত্যাশাকে আমি কখনো ভুলবো না।’ তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের প্রধান কর্তব্য হলো দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, এবং আমি সেই দায়িত্ব ভুলবো না।’

৬১ বছর বয়সী লি বুধবার (৪ জুন) দেশটির ১৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিবেন। তিনি রক্ষণশীল পিপল পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) কিম মুন-সুকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট একবারের জন্য পাঁচ বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন; পুনর্নির্বাচনের সুযোগ নেই।

পিপিপির ইউন চলতি বছরের শুরুতে সামরিক আইন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে এপ্রিলের শুরুতে অভিশংসিত হন এবং পদচ্যুত হন। এই বিস্ময়কর ঘটনাটি দেশজুড়ে কয়েক সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ ও তদন্তের সূচনা করে এবং ইউনকে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে স্বল্পমেয়াদি প্রেসিডেন্টে পরিণত করে।

দেশটির ৪৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন (৪ কোটির বেশি) যোগ্য ভোটারের প্রায় ৮০ শতাংশই এবারের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। ১৯৯৭ সালের পর এটি সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি বলে জানিয়েছে এনইসি।

এর আগে, দক্ষিণ কোরিয়ার তিন প্রধান টিভি চ্যানেল—কেবিএস, এমবিসি ও এসবিএসের এক্সিট পোলের ফলাফলে দেখা যায়, লি সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। ওই জরিপে বিরোধী প্রার্থী লির পক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট এবং কিমের পক্ষে ৩৯ শতাংশ ভোট পড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়।

তাদের পেছনে ছিলেন রক্ষণশীল নিউ রিফর্ম পার্টির লি জুন-সক। বিশ্লেষকেরা জানান, কিম প্রত্যাশার তুলনায় খারাপ করেছেন, যা আংশিকভাবে রাষ্ট্রপতি ইউন সুক-ইওলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ডানপন্থি ভোট এক করতে লি জুন-সককে রাজি করাতে ব্যর্থতার কারণেই ঘটেছে। মঙ্গলবার রাতের দিকেই পরাজয় স্বীকার করে নেন লি জুন-সকও।

দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট কে এই লি জে-মিয়ং?

দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ কিয়ংগি-র সাবেক গভর্নর এবং রাজধানী সিউলের কাছাকাছি সঙনাম শহরের সাবেক মেয়র লি জে-মিয়ং একজন বহুল আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মানবাধিকার আইনজীবী থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া লির জন্য এটি ছিল প্রেসিডেন্ট পদে তৃতীয়বারের মতো লড়াই।

দেশটির গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সবচেয়ে কম ব্যবধানে তিনি বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইউন সুক ইওলের কাছে হেরে যান। পরে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে গত বছরের সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেন এবং ইউনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী দল পরিচালিত অভিযানের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখেন।

ছয় ঘণ্টার সামরিক আইন চলাকালে লি সামরিক বাহিনীর অবরোধ এড়িয়ে জাতীয় পরিষদের দেয়াল বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং তা সরাসরি সম্প্রচার করেন। তিনি সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য বাধা ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারে সর্বসম্মতভাবে ভোট দেন।

সমালোচকরা তাকে বিপজ্জনক জনতাবাদী বলে আখ্যা দিলেও, লি বাস্তবভিত্তিক কূটনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতাকে বর্ণনা করেছেন এবং সিউল-ওয়াশিংটন-টোকিও অংশীদারিত্বকে আরও দৃঢ় করার অঙ্গীকার করেছেন; যা মূলত রক্ষণশীলদের অবস্থানের সঙ্গে খুব একটা ভিন্ন নয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিষয়ে লি ধৈর্য ধরার উপদেশ দিয়েছেন। তার মতে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে দ্রুত চুক্তির আশায় তড়িঘড়ি করে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া একটি ভুল হবে ।

প্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে অঙ্গীকারবদ্ধ লি। তিনি সংলাপ পুনরায় শুরু, সামরিক হটলাইন চালু এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আলোচনার পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে প্রোথিত অর্থনৈতিক বৈষম্যও লি-র অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপের জন্য পরিচিত দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনি সাড়ে চার দিনব্যাপী কর্মসপ্তাহ চালুর পক্ষে মত দিয়েছেন।

লি বর্তমানে দুর্নীতি ও অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধসংক্রান্ত পাঁচটি মামলার মুখোমুখি। নির্বাচন পর্যন্ত এসব মামলার অধিকাংশই মুলতবি রাখা হয়েছে। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন, এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

যেভাবে লি-র জয় হলো

বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে নিজের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে লি প্রেসিডেন্ট ইউনের সামরিক শাসন প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইউন নিজেও দলীয় বিভক্তির মাধ্যমে পিপিপিকে (পিপল পাওয়ার পার্টি) সংকটে ফেলে দেন। দলটি যখন তার উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত হয়ে পড়ে।

যদিও কিম দলীয় প্রাথমিক নির্বাচনে বিজয়ী হন, পিপিপি নেতারা তাকে সরিয়ে দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সুকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। দলের প্রচার-অভিযান শুরু হওয়ার ঠিক আগের রাতে কিমের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের প্রবল আপত্তির মুখে পরে আবার তা পুনর্বহাল করা হয়।

সিউলের ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইয়ংশিক বং বলেন, ইউনের ঘোষণাকে ঘিরে রক্ষণশীল রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পিপিপি জনগণের সমর্থন হারিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘কিম মুন-সু এখনো স্পষ্ট করে বলেননি তিনি সামরিক শাসনের ঘোষণার বিষয়ে কী অবস্থান নিচ্ছেন।’

বং আরও বলেন, ‘তিনি ইউনের উত্তরাধিকারের সঙ্গে নিজেকে আলাদা করেননি, আবার এটাও পরিষ্কার করেননি যে তিনি মনে করেন কি-না এই সামরিক শাসন ঘোষণা সংবিধান লঙ্ঘন ছিল। ফলে পিপিপি কার্যত তাদের সমর্থকদের সংগঠিত করতে যথেষ্ট শক্তি জোগাড় করতে পারেনি।’

নির্বাচনের মূল বিষয়গুলো কী ছিল?

ভুলভাবে আরোপিত সামরিক আইন গোটা নির্বাচনের ওপর ছায়া ফেলেছিল। ২০২২ সালে ইউন সুক-ইওলের কাছে পরাজয়ের পর এই বিষয়টি আবার লিকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে ফিরিয়ে আনে।

‘ইউন সুক-ইওলের সামরিক আইন ঘোষণা ও তার পরবর্তী অভিশংসন না হলে এই নির্বাচন হতো না,’ মন্তব্য করেন বং। ‘এই দুটি বিষয়ই সবকিছুকে এক ধরনের ঘূর্ণির মধ্যে টেনে নিয়েছে। অন্য সব বিষয় গৌণ হয়ে গেছে।’

নির্বাচনী প্রচারে লি প্রতিশ্রুতি দেন, ইউনের ব্যর্থ সামরিক আইন প্রয়োগে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট যেন ইচ্ছেমতো সামরিক আইন জারি করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।

অর্থনীতি ধীরে ধীরে দুর্বল হওয়া, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে যেসব সমস্যা হয়েছে, আর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি—এসবই ছিল ভোটারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

লি-র জয়ের তাৎপর্য কী? পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

লি বুধবার সকালেই শপথগ্রহণ করবেন। শপথগ্রহণের প্রক্রিয়া সাধারণত ১০ মিনিটের বেশি সময় নেয় না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাধারণত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও শপথগ্রহণের মধ্যে প্রায় দুই মাসের ব্যবধান থাকে। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই সময়সূচি বাতিল হয়েছে।