
বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হরমুজ প্রণালীতে যদি কোনো সংকট তৈরি হয়—যুদ্ধ, অবরোধ বা সামুদ্রিক সংঘর্ষ—তাহলে তার প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই সংকটের আঁচ এসে লাগবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও।
হরমুজ প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ব্যারেলের বেশি তেল রপ্তানি হয়, যা বিশ্বের মোট তেল বাণিজ্যের প্রায় এক পঞ্চমাংশ। যদি কোনো কারণে এই রুটে বাধা তৈরি হয়, তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে এমন বৈশ্বিক সংকট দ্রুত ‘ঘরোয়া সমস্যা’তে পরিণত হতে পারে। শুধু জ্বালানিই নয়, আন্তর্জাতিক শিপিং ব্যাহত হলে রপ্তানি ও আমদানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার ফলে তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু করে ওষুধশিল্প পর্যন্ত সবকিছুই চাপে পড়তে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “এই ধরনের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার জের আমাদের মতো দেশের ভোক্তা ও অর্থনীতিতে খুব দ্রুত পড়ে। তাই শুধু বড় শক্তিগুলোর নয়, আমাদেরও এসব সংকট ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।”
সার্বিকভাবে, হরমুজ প্রণালীর দূরবর্তী সংকট বাংলাদেশের মতো দেশেও যে প্রভাব ফেলতে পারে, তা কেবল আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয় নয়—এটি আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।
এই প্রণালী কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোকে ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে। ফলে এই রুটে কোনো ধরনের বিঘ্ন বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে।
আর যখন সরবরাহ কমে, দাম বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
বিশ্লেষকরা জানান, যদি ইরান সত্যিই প্রণালীটি বন্ধ করে, তাহলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের ওপরে উঠে যেতে পারে। এই দামের ঊর্ধ্বগতি সরাসরি প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশে—পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প, কৃষি এমনকি সাধারণ মানুষের ঘরোয়া বাজেটেও।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ আমদানিকৃত তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে গেলে সরকারকে হয় করদাতাদের পকেট থেকে ভর্তুকি দিতে হবে, নয়তো সরাসরি ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে। দুই অবস্থাতেই সাধারণ মানুষের জীবনে বাড়তি খরচের চাপ আসবে—বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও রান্নার গ্যাসের খরচ বাড়বে।
পরিবহন ও কৃষি খাত—বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি প্রধান স্তম্ভ—তেল-গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাস, ট্রাক, লরি—সবই ডিজেল কিংবা অকটেনচালিত, ফলে ভাড়া ও পরিবহন খরচ বাড়বে। ডিজেল দিয়ে চলে সেচ পাম্প, ফসল পরিবহণের যানবাহনও চলে জ্বালানির ওপর। এর প্রভাব সরাসরি পড়বে চাল, ডাল, শাকসবজি ও নিত্যপণ্যের দামে।
শুধু তাই নয়, শিল্প খাতেও উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর মানে হলো—নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরও বাড়বে। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য, যারা এমনিতেই সীমিত আয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, এই চাপ অসহনীয় হয়ে উঠবে। এক মাসে ২০,০০০ টাকা আয় করা একটি পরিবার হয়তো ২৫,০০০ টাকা খরচ সামলাতে বাধ্য হবে—যা তাদের জন্য কঠিন সমন্বয়ের কারণ হবে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কাতারের মতো গালফ অঞ্চলের প্রধান এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) রপ্তানিকারক দেশগুলোর গ্যাস পরিবহনের পথও এই প্রণালী। ফলে হরমুজ প্রণালীতে সমস্যা হলে বাংলাদেশের রান্নার গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও অনিশ্চয়তায় পড়বে।
যেখানে বিশ্ব ইতোমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে—সেখানে আরেকটি জ্বালানি সংকট বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আরও গভীর সমস্যায় ফেলতে পারে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতির কারণে বাংলাদেশ হয়তো সংকটের ধাক্কা প্রথমেই অনুভব করবে এবং সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেও বেশি সময় লাগবে। তবে এই ধাক্কা কতটা গভীর হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের নীতি, রিজার্ভ অবস্থা, বিকল্প জ্বালানি উৎস এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার ওপর।
ইরান নিশ্চয়ই জানে, এই প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কী ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। দেশটি নিজেও একটি বড় তেল রপ্তানিকারক এবং আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাই আশাবাদী হওয়া যায়, ইরান এটিকে কৌশলগত চাপের মাধ্যম হিসেবে দেখবে, তাৎক্ষণিক প্রতিশোধের অস্ত্র হিসেবে নয়।
যদি পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়, তাহলে জাপান, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং ইউএই-এর মতো শক্তিধর দেশগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন হবে। তাদের উচিত হবে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথটি উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিশ্ব জ্বালানি বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের অনেকের কাছেই হয়তো হরমুজ প্রণালীর সম্ভাব্য অবরোধ একটা দূরের কল্পনা বা কেবল আরেকটি আন্তর্জাতিক হেডলাইন মনে হতে পারে। কিন্তু একবার যদি এই রুট বন্ধ হয়, তাহলে খুব বেশিদিন লাগবে না—আমাদের রান্নাঘরেও সেই ধাক্কা অনুভব করতে।



































