Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সব হারালেন লতিফ সিদ্দিকী

পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত, সাংবাদিক, প্রবাসী ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে নিয়ে চরম আপত্তিকর মন্তব্য করায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব হারানোর পাশাপাশি এবার দল থেকেও বহিষ্কার হচ্ছেন। বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে দেশে পা রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন।  ইতিমধ্যে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

লন্ডন থেকে দেশে ‍ফিরে বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতিকালে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “লতিফ সিদ্দিকীকে আর দলে রাখা হবে না।”

chardike-ad

সিলেট আওয়ামী লীগের নেতা মেসবাহ উদ্দিন সিরাজ এবং সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বক্তবে ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত।

লতিফ সিদ্দিকীর বহিষ্কার নিয়ে বিএনপি যে অভিযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরিষ্কার হয়েছে, শুধু মন্ত্রী থেকেই নয়, দলের প্রেসিডিয়ামসহ সব পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা কার্যকর হলে লতিফ সিদ্দিকী সংসদ সদস্য পদও হারাবেন।

Latifপ্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, সরকার লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ধর্মভিত্তিক বা অন্য কোনো দলকে কোনোভাবেই রাজপথে আন্দোলনে নামার সুযোগ দিতে চান না।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে কটূক্তি করার অভিযোগে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর হাকিম আতিকুর রহমানের আদালতে এ মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী। মামলাটি গ্রহণ করে আসামিকে আগামী ২৯ অক্টোবর আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিতে তার বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন আদালত। লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টেও রিট করা হয়েছে।

বুধবার দুপুরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটের ওপর শুনানি হবে আগামী ১২ অক্টোবর। বুধবার লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ঢাকাতে দুটি, চট্টগ্রামে চারটি এবং সিলেট ও বরিশালে একটি করে মামলা হয়েছে।

এদিকে লতিফ সিদ্দিকীকে এখনই দেশে না ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। দেশের মধ্যে যেকোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ এড়াতে দলের একাধিক নেতা বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে এ পরামর্শ দিয়েছেন। দলের নেতারা বলেন, লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফিরলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তাই তাকে আপাতত দেশে না ফেরার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ২১ সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত সফরে আমেরিকায় যান। তার সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী ও ছেলে। রোববার নিউ ইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির সংবর্ধনা সভায় লাগামহীন বক্তৃতা দিয়েই তিনি ডালাস চলে যান। সেখানে স্ত্রীকে রেখে নিউ ইয়র্কে ফিরে বুধবার তার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা থাকলেও তিনি রওনা হননি।

বিভিন্ন ধরনের বেফাঁস মন্তব্য আর উদ্ভট ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ সব কর্মকাণ্ড করে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীএই নেতা। এ জন্য দল মাঝে-মধ্যে বিব্রত-বেকায়দায় পড়লেও এরকম শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি তাকে।

গত সংসদের বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আর কখনো নির্বাচন করবেন না জানিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নেন বিতর্কিত এ ব্যক্তি। কিন্তু সেই অঙ্গীকারেও তিনি অটল থাকতে পারেননি। ক্ষমতার লোভে এবারো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনে দলের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে গত সরকারের সময় পাওয়া পাট মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় এবার তাকে সরিয়ে স্থানান্তর করা হয় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে। সবকিছুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যেন ছিল এ মন্ত্রীর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তার লাগামহীন এসব কর্মকাণ্ড শুধু বিরোধী মতেরই নয়, নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও বিব্রত করেছে বারবার।  তবে এবার শেষ রক্ষা হলো না তার।

লতিফের যত বেফাঁস মন্তব্য

গত বছর ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে এক সভায় লতিফ সিদ্দিকী জামায়াতের হরতালে দলীয় নেতাকর্মীদের তৎপর না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আর বসে থাকার সময় নেই। আর কেউ হরতাল করলে তাদের বাড়িতে ঢুকে হত্যা করতে হবে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত হরতাল করে। আর রাস্তায় শুধু পুলিশ থাকে। আমাদের নেতাকর্মীরা নেতার হুকুমের অপোয় বসে থাকেন। তিনি বলেন, সব কিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ লাগবে কেন? যখন বাড়ি-গাড়ি করেন তখন কোথায় থাকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। আমি বলছি, এটিই আমার শেষ বক্তৃতা।

ওই মাসের শেষ সপ্তাহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন তা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে এত দিন তাকে (ড. ইউনূস) কারাগারে থাকতে হতো।

গত ২৮ মার্চ টাঙ্গাইলে নিজ বাড়িতে পিডিবির উপসহকারী প্রকৌশলী পুনয় চন্দ্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে গাজীপুরের হাইটেক পার্কের উপসহকারী প্রকৌশলীকে পানিতে ভিজিয়ে শাস্তি দেন। চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রী হাইটেক পার্কে প্রবেশের সময় ফোয়ারা অপরিষ্কার দেখেন। সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য গাজীপুর হাইটেক পার্কের সামনে ফোয়ারা তৈরি করা হলেও তা অপরিষ্কার থাকায় প্রকৌশলীকে পানিতে নামান মন্ত্রী। পরে ফোয়ারার পানিতে তাকে ভিজিয়ে শাস্তি দেন তিনি।

২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদা না দেয়ার অভিযোগ তুলে পাট নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আয়োজকদের কঠোর সমালোচনা করেন তখনকার বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে লতিফ সিদ্দিকী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অর্থমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা। আর আমি কি উড়ে এসেছি?

এর কিছু দিন পরই খামারবাড়িতে এক অনুষ্ঠানে কুরআন ও আজানের সমালোচনা করে বিতর্কিত এ মন্ত্রী বলেন, আজানের সময় মাইক বন্ধ রাখতে হবে কেন? আর কোনো অনুষ্ঠান কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে শুরু করতে হবে কেন? কুরআন তিলাওয়াতের সঙ্গে গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটকও পাঠ করতে হবে।

গত বছর ১১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনায় দাঁড়িয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনী রাজনীতিতে আর অংশ নেবো না। তবে দলীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনা যে নির্দেশ দেবেন, তা সম্পন্ন করার চেষ্টা করবো।

২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর সংসদে দেয়া এক বক্তব্যে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদের সমালোচনা করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, স্পিকার হচ্ছেন সংসদের সেবক। তিনি প্রভু নন। আবদুল হামিদকে উদ্দেশ করে তিনি আরো বলেন- প্রতিভা ও প্রগলভতা এক নয়।

তবে গত রোববার নিউ ইয়র্কের অনুষ্ঠানে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘চিনতে না পারলেও’ গত ১১ মার্চ ঢাকায় জয়ের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী জয়কে নিজের মাস্টার হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে জয় কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, তা পথপ্রদর্শক হবে। কারণ তিনি যার (শেখ হাসিনা) উপদেষ্টা, তার সৃষ্টি মননশীল।

গত ৩১ আগস্ট সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের বক্তব্যে উষ্মা প্রকাশ করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছে, তা শুনলে আমি হাসি। আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তিনি পড়েছেন কি না। তিনি কিন্তু পড়েননি। কেবল নীতিমালা পড়লেই হবে না, টেলিভিশনগুলো যেসব শর্তে লাইসেন্স পেয়েছে, সেগুলোও জানা থাকতে হবে। ওরা কী কী শর্তে দস্তখত করে লাইসেন্স নিয়েছে সেই শর্তটা একবার বের করে দেখুন। ওই কাবিননামায় দস্তখত করেই কিন্তু লাইসেন্স পেয়েছে।

চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে অংশ নিয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমার স্বভাব খারাপ, এ জন্য মাঝে মধ্যে একটু লাঠিপেটা করি। সাপকে যদি মারতে হয়, তাহলে লাঠিপেটা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাংবাদিকেরা আমার বিরুদ্ধে লাগে উক্তি করে সমালোচিত এই মন্ত্রী বলেন, এ দেশের ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া, ব্যবসায়ী, কথিত সুশীলসমাজের সদস্যরা বেতনভুক ক্রীতদাস।

গত ২০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতা সংগঠনকে গতিশীল ও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। তাদের থামিয়ে দিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, সংগঠন-টংগঠন দিয়ে কিছু হবে না নেত্রী। আপনি (শেখ হাসিনা) বেঁচে থাকলে সবঠিক থাকবে। দল দিয়ে কিছু হয় না। আপনিই আমাদের সব।

এ সময় তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদকে উদ্দেশ করে বলেন, তারা বিভিন্ন সময় দলের নেতাদের চ্যালেঞ্জ করে বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ান। এটি মেনে নেয়া যায় না। কারণ তারা এত দিন সাইড লাইনে ছিলেন। নেত্রী (হাসিনা) পাঁচ বছর পর আবার তাদের মূল স্রোতে নিয়ে এসে মন্ত্রী বানিয়েছেন। তাদের সেটি মনে রাখা উচিত। একই সঙ্গে এ থেকে আমাদের অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতাদেরও শিক্ষা নিতে হবে।

এ বছরের ২৯ মে রাজধানীর শিল্পকলায় যুবলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে আমরা কী করব? নবম জাতীয় সংসদে মোট সাতটি দল ছিল। দশম সংসদেও সাতটি দল আছে। দল তো কমে নেই। ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়নি। প্রার্থীবিহীন নির্বাচন হয়েছে।

এর আগে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার ধানাইদহ ও লালপুর উপজেলার দাঁইড়পাড়া এলাকায় নাটোর-পাবনা মহাসড়কে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এক হাতে পিস্তল উঁচিয়ে ও অন্য হাতে দা নিয়ে সড়কে অবরোধকারীদের ফেলে রাখা গাছের ডালপালা কেটে গাছ সরান।

 লতিফের দুর্নীতির সাতকাহন

বিতর্কিত ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর অব্যাহত দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর

কার্যালয়।

মতিঝিলে চট্টগ্রাম সমিতিকে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে জমি ইজারা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়াসহ নানা বিষয়ে তার দুর্নীতির সাতকাহন রূপকথাকে যেন হার মানিয়েছে।

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর মিডিয়াতে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসব বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তার দুর্নীতির সত্যতা পায়।

টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রী হওয়ার পর ‘ভিওআইপি’ কেলেঙ্কারির সঙ্গেও জড়িয়ে যান লতিফ সিদ্দিকী। এ কারণে খোদ মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ধমক দেন লতিফ সিদ্দিকীকে। এরপর থেকে সব সময় মন্ত্রিসভা বৈঠকে সরব থাকা লতিফ সিদ্দিকী চুপসে যান।

২০০৮ সালের মহাজোট সরকারের আমলে লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এ মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময়ে ২০১৩ সালে ক্ষমতা ছাড়ার চার দিন আগে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঢাকার মতিঝিলে চট্টগ্রাম সমিতিকে জমি ইজারা দেন।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় জমির ইজারা দেয়ার বিষয়ে এখন বলছে, তখনকার মন্ত্রীর ইচ্ছায় এটা হয়েছিল এবং এটি ছিল মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১১ জুন চট্টগ্রাম সমিতি হাসপাতাল বানানোর কথা বলে জমির জন্য আবেদন করে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার চার দিন আগে গত বছরের ২০শে অক্টোবর তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী তাতে সম্মতি দেন।

পরদিন ২১ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নীলরতন সরকার চট্টগ্রাম সমিতির তখনকার সভাপতি রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাককে একটি চিঠি দিয়ে জমিটি ইজারা দেয়ার কথা জানান। ইজারা মূল্য প্রতি বছর এক লাখ এক হাজার ১০১ টাকা হিসেবে ৯৯ বছরের জন্য এক কোটি এক লাখ এক হাজার ১০১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নেয়। তার তিন দিনের মাথায় ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সমিতিকে জমিটি ইজারা দলিল করে দেয় মন্ত্রণালয়। দলিলে দেখা যায়, জমিদাতা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফণীভূষণ চৌধুরীকে দাতা এবং গ্রহীতা চট্টগ্রাম সমিতির পক্ষে এর ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ও নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি লায়লা সিদ্দিকী এবং সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দীন খান এবং ট্রাস্ট সেক্রেটারি এম এমদাদুল ইসলাম। জমিটি ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার আড়াই মাস পর চট্টগ্রাম সমিতির দ্বিবার্ষিক নির্বাচন হয়।

এতে ২০১৪-১৫ সালের জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হন লায়লা সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দীন খান। জমিটি ইজারা অনুমোদনের নথিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী লেখেন, মেজবান চট্টগ্রাম সমিতির একটি আকর্ষণীয় বার্ষিক অনুষ্ঠান।

ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলা কন্যার পাণি গ্রহণ করেছি। ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। তাদের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় এই ভূমি খণ্ডটির প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার সেবায় তাদের সহযোগিতা করার নৈতিক দায়িত্ববোধ মনে করছি।

লতিফ সিদ্দিকীর এ অনিয়মতান্ত্রিক ইজারার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব নীলরতন সরকারের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, এই প্লটটি বিক্রির কোন এখতিয়ার বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নেই। এই মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর লিখিত নির্দেশে ওই ইজারা দেয়া হয়।

এতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শর্তও মানা হয়নি। এই জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অবমুক্ত করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। অবমুক্ত করার ক্ষেত্রে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দু’টি শর্ত দেয়। তা হলো, প্লটটি কখনও বিক্রয় ও হস্তান্তর করা যাবে না এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে এটি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর কোনটিই মানা হয়নি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের এমন ভূমিকার কারণে চট্টগ্রাম সমিতি এখনও জমিতে দখলে যেতে পারেনি।

লতিফ সিদ্দিকীর আচরণে মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছিলেন অতিষ্ঠ। যখন তখন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আক্রমণ করতেন তিনি। মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে বিতর্কে জড়ান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় অনেক বিতর্ক নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে কয়েকবার ধমকের সুরে কথা বলেন।

অর্থমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর কথা শুনে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে যান। যদিও প্রধানমন্ত্রী বাদ সাধার কারণে বিষয়টি বেশি দূর এগোয়নি। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কয়েকটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে সরব থাকলেও এরপর চুপসে যান।

একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০ জুন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে অবৈধভাবে ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) ব্যবসা পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ধমক খান লতিফ সিদ্দিকী।

ওই দিন প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বলেন, কারা ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তা আমার নলেজে আছে। কার ছেলে, কার মেয়ে, কার জামাই এ ব্যবসা করেন সবই আমার জানা আছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় কাউকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী যখন এসব কথা বলছিলেন তখন লতিফ সিদ্দিকী চুপ করে বসেছিলেন। তিনি কোনো শব্দ করেননি।

এছাড়া, লতিফ সিদ্দিকীর কিছু টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে নেয়া হয়েছিল। ওই সব রেকর্ড নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৩০শে জুনের মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর অনেকটা চুপসে যান লতিফ সিদ্দিকী। মন্ত্রিসভা বৈঠকে এসে চুপ মেরে বসে থাকতেন। এরপর থেকেই নিজের অবস্থান দুর্বলের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন সরকারের এ মন্ত্রী।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে গাড়ি- ও ফ্ল্যাট কেনা এবং ব্যবসা  করার জন্য ঋণ দেয়া হয়। ঋণগ্রহীতা দু’জন ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং একজন নারী উদ্যোক্তা। ঋণ দেয়ার জন্য সুপারিশ ও অনুমোদন দু’টোই করেছেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।

এমনকি নারী উদ্যোক্তাকে দেয়া ঋণ মওকুফও করেন তিনি। সরকারের তরফে এর তদন্তে বলা হয়, এভাবে টাকা দেয়ার কোন বিধান নেই। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এ সংস্থাকে কেউ ঋণ দিতে পারে না।

সব সময় অস্থির অবস্থায় রয়েছেন লতিফ সিদ্দিকীর দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি অস্থিরতায়। টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানালেন, মন্ত্রণালয়ে অনেকটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। নয় মাসের মধ্যে তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভয়-ভীতির জন্ম দেন। ওদিকে মোবাইল ফোন অপারেটর সংস্থার কাছে অর্থ চাওয়া নিয়ে টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ে নানা কথা চালু রয়েছে। সম্প্রতি টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমি চাঁদা নিই। কারণ রাজনীতি করতে আমাকে চাঁদা নিতে হয়। তবে কমিশন খাই না। নতুনবার্তা।