টাঙ্গাইলের ‘খান’ ও ‘সিদ্দিকী’ পরিবারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতারা আবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। এই দুই পরিবারের বাইরে থাকা নেতারা এত দিন চুপ থাকলেও এখন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ মনে করছেন, দুই পরিবার নতুন করে চাপে পড়ায় জেলার রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে। তবে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপির উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা তাঁরা কম দেখেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার সঙ্গে জেলার প্রভাবশালী খান পরিবারের চার ভাই সাংসদ আমানুর রহমান খান (রানা), পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহিদুর রহমান খান (মুক্তি), ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান (কাঁকন) ও ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানিয়াত খানের (বাপ্পা) নাম জড়িয়ে পড়েছে। এর পর থেকেই সহিদুর রহমান ছাড়া অপর তিন ভাই আগের মতো আর এলাকায় থাকছেন না। তবে সাংসদ আদালত থেকে গ্রেপ্তারে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মাঝেমধ্যে এলাকায় যান। আর লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কারের পর ‘সিদ্দিকী’ পরিবারের আর কেউই এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেই। ফলে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সিদ্দিকী পরিবারের নিয়ন্ত্রণ শেষ হয়ে গেছে। এত দিন এই পরিবারের সঙ্গে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারাও তাঁদের অবস্থান পরিবর্তন করছেন।
তবে খান পরিবারের মেজো ভাই সহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে তাঁদের কাছে পরাজিত একটি মহল মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এতে তাঁদের পাশাপাশি টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নীরব নেতারা সক্রিয় হচ্ছেন: টাঙ্গাইলে খান পরিবারের বিপক্ষে কোনো নেতাকেই সেভাবে কথা বলতে দেখা যায় না। তবে সম্প্রতি দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও নিহত ফারুক আহমেদের স্ত্রীর বড় ভাই খন্দকার আশরাফুজ্জামান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামের অনুসারীরা জেলার রাজনীতিতে খান পরিবারের বাইরে একটি রাজনৈতিকবলয় গড়ে তুলছেন বলে দলের নেতারা বলছেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এই নেতারা এখন নিজেদের মধ্যে সভা ও অনুসারীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করছেন। খান পরিবারের চার ভাই শেষ পর্যন্ত হত্যা মামলায় আসামি হলে এঁরাই জেলার রাজনীতির নতুন নিয়ন্ত্রক হতে পারেন।
তা ছাড়া খান পরিবার মামলায় জড়ালে তাঁদের পক্ষের কিছু প্রভাবশালী ও জেলার রাজনীতিতে দায়িত্বশীল নেতাও এই পরিবার থেকে পিছু হটতে পারেন। ২০১২ সালে সাংসদ আমানুর রহমান উপনির্বাচন করার সময় তাঁর পক্ষে অবস্থান না নেওয়ায় আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মামুনুর রশিদকে এলাকা ছাড়া হতে হয়। এরপর তিনি দেশের বাইরে চলে যান। তবে সম্প্রতি দেশে আবারও সক্রিয় হওয়ার চিন্তা করছেন তিনি।
গত ১৩ অক্টোবর নিহত ফারুকের স্ত্রী নাহার আহমেদকে গণভবনে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সাক্ষাতের পর তাঁকে নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য নাহার এখনই রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে নাহার আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংগত কারণেই কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকীর মতো নেতাদের দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কোনো নেতাই দলের চেয়ে বড় নয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার আশরাফুজ্জামান বলেন, পরিবারতন্ত্রের হাত থেকে মুক্ত হয়ে সুষ্ঠু পরিবেশে নেতা-কর্মীরা রাজনীতি করতে চান। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম বলেন, খান পরিবারের ওপর মানুষের কোনো আস্থা নেই।
তবে খান পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেশি বিব্রত হওয়ার ঘটনা হলো, টাঙ্গাইলের সাংসদ ও নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় সাংসদ আমানুর রহমানকে না রাখা।
জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, কয়েক দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী পৃথক পৃথক সময়ে নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি নেতাদের ব্যর্থ ও ভীতু বলেছেন। ফারুক হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত সে ব্যাপারে জেলার নেতারা তথ্য দিতে না পারা এবং ফারুকের পরিবারের পাশে না দাঁড়ানোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও টাঙ্গাইল-১ আসনের সাংসদ আবদুর রাজ্জাকের কাছেও একই কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁর সঙ্গে গত ১৪ অক্টোবর কথা বলেন। সেখানে উপস্থিত একজন নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাককে বলেছেন, আপনারা কি ভয়ে গুটিয়ে থাকেন। এত ভয় কিসের? রাজ্জাকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় সেখানে আওয়ামী লীগের দুজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে আলোচনার বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী টাঙ্গাইলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন।’
সিদ্দিকী পরিবারের কেউই নেই: সিদ্দিকী পরিবারের সদস্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী অনেক আগেই দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তিনি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে নতুন দল করেছেন। লতিফ সিদ্দিকীর বহিষ্কারের পর টাঙ্গাইল শহরে তাঁর দুই ভাই মুরাদ সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকীর যেটুকু আধিপত্য ছিল, তা-ও শেষ হয়ে গেছে। এই দুই ভাইয়ের কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। শুধু ভাইয়ের দাপটে এলাকায় দাপট দেখাতেন। ফলে রাজনীতিতে সিদ্দিকী পরিবারের অবস্থান শেষ হয়ে যাওয়ায় কালিহাতী উপজেলার এখনকার প্রভাবশালী নেতারা সেই জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কালিহাতী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান ইমাম খান (সোহেল হাজারী) এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, লতিফ সিদ্দিকী সব সময় একক সিদ্ধান্তে দল চালাতেন। এখন তাঁর বহিষ্কারে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হবে না। নতুন নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে।