Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গোপন রোগের জমজমাট ব্যবসা প্রকাশ্যে!

gopon rogচলতি পথে ১…

‘আচ্ছা মা, পুরুষের গোপন রোগ কী?’ গাড়িতে মহিলাদের সিটের সামনে লাগানো একটি পোস্টার দেখিয়ে স্কুল পড়ুয়া ৮ বছর বয়সী কন্যা শিশুর এমন প্রশ্নে হতচকিত মায়ের উওর, ‘একদম চুপ করে বসে থাকো। খালি বাঁদরামি আর বাঁদরামি’। মায়ের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আচরণে শিশুটি গাল ফুলিয়ে বলল, আমি কি বাঁদরামি করেছি? ওই যে পোস্টারে লেখা পুরুষের গোপন রোগ যা দেখেছি তা জানতে চেয়েছি। তুমি না আমাকে সবসময় বল যেটা বুঝতে পারবে না তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে। তাই তো আমি জিজ্ঞাসা করেছি।’ বেশ বিব্রত মা কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। মা চুপ করে থাকলেও প্রশ্ন করা শিশুটির চোখে-মুখে একরাশ প্রশ্ন। শিশুটি কি মায়ের কাছে জবাব না পেয়ে নিজের মত করে গোপন রোগ কি হতে পারে সে উওর খুঁজবে?

chardike-ad

চলতি পথে ২…

‘আচ্ছা, দোস্ত তোর কি কোন গোপন রোগ আছে? থাকলে ওই নাম্বারে কল দে।’ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজের প্রবেশ পথের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ৩টি ছেলের একজনের এমন মন্তব্য কলেজ থেকে বেরিয়ে আসা দুইছাত্রীর কানে যেতেই বেশ বিব্রত হয়ে পড়ল। চোখে-মুখে বিব্রত হবার পাশাপাশি লজ্জার আভাস।

সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটির সামনে কারেন্টের খাম্বায় ছোট-বড় ডজন খানেক পোস্টার লাগানো। ইচ্ছা করে মেয়েগুলোকে এমনটা শোনানোর জন্য বলা হয়েছে বুঝেও মেয়ে দু’টি নীরবে চলে গেল। কারণ,  ছেলেগুলোর কাছে অজুহাত আছে, ‘আমরা কাউকে শোনানোর জন্য না আমরা পোস্টার দেখেই আলোচনা করছি’।

গোপন রোগের প্রকাশ্য বর্ণনা…

ঢাকা-চট্টগ্রামের বেশির ভাগ লোকাল পাবলিক বাসে মহিলা সিটের সামনের জায়গাটুকু থেকে ড্রাইভারের মাথার উপর পর্যন্ত হরেকরকম গোপন রোগের মাঝারি সাইজের পোস্টার লাগানো। গোপন রোগের বর্ণনার পাশপাশি ক্যান্সার, শরীরের কঠিন রোগ সারিয়ে দেওয়ার ১০০% গ্যারান্টি সম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনগুলোর ভাষা এতটাই অশ্লীল যে সুস্থ রুচির যে কেউ বিব্রত হবে। শুধু যে কঠিন রোগ তা নয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ, জাদু-টোনা, স্ত্রী বশে আনা কিছুই বাদ যায়না এসব বিজ্ঞাপনে। না শুধু পাবলিক বাসেই নয়। ঢাকা-চট্টগ্রামের বেশির ভাগ এলাকার অলিতে-গলিতে এসব বিজ্ঞাপনে ভরা। কোমলমতি শিশুদের স্কুলের সামনে থেকে শুরু করে হাইস্কুল, কলেজের প্রবেশ মুখেও বিজ্ঞাপনগুলো লাগানো থাকে। কোথাও চলতি পথে মা-বাবার সঙ্গে থাকা সন্তান বিব্রত হচ্ছে কোথাও বিব্রত হচ্ছেন সন্তানের সঙ্গে থাকা মা-বাবা। আবার কোথাও ভাইয়ের সঙ্গে থাকা বোন, কোথাও বোনের সঙ্গে থাকা ভাই বিব্রত পরিস্থির শিকার হচ্ছেন।

গোপন রোগের সরব হানা টিভি রুমে…

চলতি পথের এসব অশ্লীল, ভুয়া বিজ্ঞাপনগুলোর উৎপাতে টিভি রুমেও হানা দিয়েছে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে ইদানিং ক্যাবল অপারেটরদের নিজস্ব চ্যানেলেও চলছে গোপন রোগের বিজ্ঞাপন। সরকার অনুমোদিত চ্যানেল ছাড়াও ডিস লাইনে থাকে স্থানীয় ক্যাবল অপারেটরদের একটি নিজস্ব চ্যানেল। দর্শক ধরতে এসব চ্যানেলে নতুন নতুন হিন্দি সিনেমা, বিভিন্ন বাংলাদেশি চ্যানেলের নাটক দেখানো হয়। এই কারণে অনেকেই ক্যাবল অপারেটরদের নিজস্ব চ্যানেলটি দেখে। প্রায় ২৪ ঘণ্টায় ক্যাবল অপারেটরদের এসব চ্যানেলেই স্ক্রল হতে থাকে গোপন রোগের বিজ্ঞাপন। পাশাপাশি সিনেমা নাটকের মাঝে মাঝে এসব বিজ্ঞাপন বর্ণনা সহকারে প্রচার হয়। বিজ্ঞাপনগুলোর ভাষা এতটাই খোলামেলা যে ক্যাবল অপারেটরদের নিজস্ব চ্যানেল দেখতে গিয়ে টিভি রুমে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

কয়েকশ কিংবা কয়েক হাজার টাকায় সব সমস্যার সমাধান দেওয়া এসব বিজ্ঞাপনগুলোর ভাষাই প্রায় একই রকম। ভিন্ন শুধু তাদের পরিচয়। ভিন্ন শুধু প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে বিশেষ করে বিভাগীয় শহরগুলোতে এসব কথিত ডাক্তার, কবিরাজদের উৎপাত সব চাইতে বেশি।

কী বলছেন ডাক্তাররা ?

পাবলিক মেডিকেলের বেশ কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোগ সারানোর ১০০ ভাগ চ্যালেঞ্জ দেওয়া চটকদার এসব বিজ্ঞাপনগুলো ১০০ ভাগই ভুয়া। এসব কথিত ডাক্তার, কবিরাজদের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা তো দূরে থাক এদের বেশির ভাগই ইংরেজিতে ডাক্তার বানান করতেই জানে না। মানুষের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এরা প্রতারণা করে কামিয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এদের কথিত ওষুধে রোগ ভাল হওয়া তো দূরে থাক উল্টো সাইড ইফেক্টের কারণ হয়ে শরীরে যোগ হচ্ছে আরো নতুন নতুন রোগ। ডাক্তারদের ভাষ্য মতে প্রায় এমন অনেক রোগী আসে যারা প্রতারকদের চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যৌন শক্তি হারিয়েছেন। এসব প্রতারকদের ফাঁদে পড়া বেশির ভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত। যাদের শারীরিক সমস্যার জন্য হাজার হাজার টাকার খরচ করার সামর্থ নেই। কিন্তু কয়েকশ টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপনের ভণ্ড ডাক্তার, কবিরাজদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেবার সামর্থ আছে।

গোপন রোগ সরব, নীরব শুধু প্রশাসন :

আইনশৃঙ্গলা বাহিনীর চোখের সামনেই দেয়ালে, পিলারে এসব অশ্লীল ভাষার বিজ্ঞাপনের পোস্টার লাগানো হয়। পাশে দাঁড়ানো পুলিশের সামনেই গাড়িতে থাকা যাত্রীদের উদ্দ্যেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয় গোপন রোগের বর্ণনা এবং সমাধানের জন্য কোথায় যেতে হবে এমন লিফলেট। কিন্তু পুলিশ দেখেও দেখে না। পুলিশ কি জানে না এসব অবৈধ ব্যবসা? নাকি এসব গোপন রোগের ভণ্ড প্রতারকদের কাছ থেকে ‘বিশেষ কমিশন’ পাওয়ার যে ব্যাপারটি প্রায় শোনা যায় তা সত্যি?

দেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে অনেক উদ্যোগ অনেক আশার কথা শোনা যায়। মন্ত্রী কি জানেন না প্রতিনিয়ত ভণ্ড ডাক্তার-কবিরাজদের খপ্পরে শত শত মানুষ নানা রোগের শিকার হচ্ছে? আমরা ধরে নিতে পারি মন্ত্রী জানেন না। কারণ, ভিআইপি গাড়িতে চড়া মন্ত্রীর পাবলিক বাসে না ওঠারই কথা। আমরা এটাও ধরে নিতে পারি যে দামি গাড়ির কাঁচ ভেদ করে মন্ত্রীর চোখ পড়ে না রাস্তার পাশের দেয়ালে, বিদ্যুতের পিলারে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার চোখেও কি ব্যাপারগুলো পড়েনি? এই প্রশ্নটি আমরা না করে পারছি না। শীর্ষনিউজের সৌজন্যে।