৩৭তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মনিষা কর্মকারের সব বাধা জয়ের গল্পটি বাংলাদেশের নারীদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। সংসার, চাকরি, সামাজিক সংগঠন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা পেরিয়ে মনিষার ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট’ হয়ে ওঠার গল্প শুনবেন আজ। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আবদুর রহমান সালেহ-
স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ সংগীতশিল্পী অজয় কর্মকারের দ্বিতীয় কন্যা মনিষা কর্মকার। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদচারণার সুবাদে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা ছিল তার। সে সময়ে ছোট্ট মনিষা বাবাকে প্রশ্ন করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা পায়। মনিষার বাবা মনিষাকে বুঝিয়েছেন, ইউএনও-ম্যাজিস্ট্রেটদের অনেক ক্ষমতা। সমাজে তাদের স্থান অনেক উপরে।
সপ্তম শ্রেণির ইংরেজি ক্লাসে শিক্ষক সবাইকে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনা লিখতে দিলে গতানুগতিকভাবে বুঝে কিংবা না বুঝে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ‘বড় হয়ে আমি শিক্ষক হব’ লিখে দিল। একজন শিক্ষার্থী ছিল ব্যতিক্রম। সে ‘শিক্ষকের’ পরিবর্তে লিখলো ‘বড় হয়ে আমি ম্যাজিস্ট্রেট হব’। ‘সমাজের সর্বোচ্চ স্থানে ইউএনও-ম্যাজিস্ট্রেটদের অবস্থান’ বাবার বলা সেই কথাটিকে ধারণ করে দীর্ঘবছর পর ছোটবেলার ‘এইম ইন লাইফ’কে বাস্তবে পরিণত করলেন সেই সময়ের ব্যতিক্রমী শিক্ষার্থী মনিষা কর্মকার, এই সময়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
বৈরী সময়: মফস্বলে বেড়ে ওঠার কারণে নানামুখী সমস্যার অধ্যায় অতিক্রম করতে হয়েছে মনিষাকে। মাধ্যমিকের অর্ধেকটা সময় বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে পারলেও কলেজ জীবনের পর্ব ছিল আরও নাজুক। কলেজের আঙিনায় গিয়ে পড়াশোনার সুযোগ মনিষার একদমই হয়নি। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও মনিষার ক্ষেত্রে কলেজ জীবনের বাস্তবতা এমনই ছিল। মফস্বলের বিভিন্ন বৈরী পরিবেশে মনিষার ভাগ্যে কলেজে ক্লাস করাটা কোনোভাবেই হয়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পর্ব শেষ করতে হয়েছে তাকে।
বাধা: উচ্চমাধ্যমিকের পর্ব শেষ করে বন্ধুরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে, সেই সময়ে মনিষা কর্মকারের ব্যস্ততা ছিল বিয়ের পিঁড়িতে বসা নিয়ে। সদ্য এইচএসসি পাস করে বিয়ের পিঁড়িতে বসাটা মনিষার ইচ্ছা না থাকলেও এড়ানো যায়নি পারিবারিক পদক্ষেপ কিংবা সেই সময়ের সার্বিক সামাজিক পরিস্থিতির কারণে। আর তাই বন্ধুদের থেকে ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মনিষাকে। যে সময়টাতে তার বন্ধুদের চিন্তা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে, সেই একই সময়ে মনিষার দুশ্চিন্তা স্বামী-সংসার সামালানো নিয়ে। মনিষার বন্ধুরা এর-ওর কাছ থেকে প্রশ্ন করছে, কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া যায়। আর মনিষার প্রশ্ন ছিল- কিভাবে সংসারী হওয়া যায়! সংসার সামাল দিতে গিয়ে মনিষা কর্মকারের তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং করাটা আর হয়ে উঠলো না।
কোচিং না করেই ঢাবি: সংসারধর্মে ব্রতী হলেও পড়াশোনাটা বন্ধ করেনি মনিষা। সারাদিনের সাংসারিক কাজকর্ম সেরে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, মনিষার তখন পড়াশোনার উপযুক্ত সময় শুরু হতো। রাত দুটা-তিনটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে পরবর্তী দিনের সংসার সামলানোর প্রয়োজনে ঘুমাতে হয়েছে তাকে। প্রতিদিনের ধারাবাহিক নিয়মটা এমনই ছিল, গতানুগতিক। কখনো গভীর রাতে দৈনিক তিন ঘণ্টা, কখনো দুই ঘণ্টা পড়াশোনা। আবার কোনোদিন পড়াশোনাবিহীনই কাটাতে হয়েছে। সাংসারিক বাধা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও, অসম্ভব হয়ে ধরা দেয়নি মনিষার জীবনে। যার ফলস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে চান্স হয় তার।
বাধার পিঠে বাধা: সব সাংসারিক কাজকর্ম এবং এর অবসরে মধ্যরাতে পড়াশোনা চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করার সময়ে প্রথম বর্ষেই জন্মগ্রহণ করে মনিষার প্রথম সন্তান অন্তিক দাশ। এরপর মাস্টার্সে অধ্যয়ন করার সময়ে মৃত্যু হয় মনিষার বাবা বাংলাদেশ বেতার বরিশালের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাবু অজয় কর্মকারের। মনিষার গর্ভে তখন ৭ মাসের মেয়ে ধৃতিপ্রভা দাশ। বাবার মৃত্যু, গর্ভে ৭ মাসের সন্তান, মাস্টার্সের পড়াশোনা, সংসারের দায়বদ্ধতা সবগুলো দুশ্চিন্তা যেন একযোগে হানা দিল মনিষার চ্যালেঞ্জিং জীবনে। কোনটা রেখে কোনটা সামলাবেন এমন কঠিন মুহূর্তে মনিষার ধীরস্থিরতাই তাকে আজকের অবস্থানে আসতে সক্ষম করেছে।
চাকরি অধ্যায়: মাস্টার্সের পর ঢাকার খিলগাঁও মডেল কলেজে প্রভাষক পদে চাকরি হয় মনিষার। কলেজের পাঠদান, বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষার খাতা দেখা- এগুলো বাড়তি চ্যালেঞ্জ হিসেবে যুক্ত হয়। দায়িত্বের কাছে এসব চ্যালেঞ্জগুলোও হার মানতে থাকে ধীরে ধীরে।
বিসিএসের আগ্রহ: বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বন্ধুদের অনেকেরই প্রশাসন এবং পুলিশ ক্যাডারে চাকরি হয়ে যায়। এটা দেখে মনিষার আগ্রহ জন্মে বিসিএসে অংশ নেওয়ার। সেই থেকে বিসিএসের পড়াশোনার দিকে ঝুঁকতে থাকে মনিষা। কলেজের পাঠদানের বাইরে খাতা দেখা এবং অন্যান্য বাড়তি দায়িত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখি- এমন প্রত্যয়ে ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিলেও সেবার কৃতকার্য হননি মনিষা। এরপর ৩৬তম পরীক্ষায়ও আগের পুনরাবৃত্তি।
সফলতা: ৩৫ এবং ৩৬তম বিসিএসে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকের মত সে-ও কিছুটা হতাশ ছিল, কিন্তু মনোবল হারাননি। কিছুদিন আগে যখন ৩৭তম বিসিএসের অ্যাডমিন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তির সংবাদটি জানা হয়; তখন মুহূর্তের প্রাপ্তির সংবাদে অতীতের সব বাধা নিমিষেই ভুলে যায় মনিষা। প্রাপ্তির আনন্দ তাকে এতটাই উদ্বেলিত করেছে, সে ভুলে যায় নিকট অতীতের চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তগুলো। যে অতীতে তাকে সামলাতে হয়েছে দুই বাচ্চা, সাংসারিক কাজকর্ম, স্বামী, চাকরির নিয়মানুবর্তিতা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী।
পরিচয়: মনিষা কর্মকার বরগুনার আমতলী পৌরসভার সদর রোডের এবিএম চত্ত্বর সংলগ্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ২০০১ সালে আমতলী মফিজ উদ্দিন বালিকা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে তখন সর্বোচ্চ জিপিএ ৪.১৩ পেয়ে এসএসসি এবং ২০০৩ সালে আমতলী ডিগ্রি কলেজ থেকে একই বিভাগে ৩.৮০ জিপিএ নিয়ে এইচএসসি পাস করে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিভাগে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি। মনিষা কর্মকারের মা গৃহিণী, বড়বোন সুস্মিতা রাণী কর্মকার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এবং ছোট ভাই প্রকাশ কর্মকার কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। স্বামী সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাপস চন্দ্র দাশ।
অনুভূতি: সার্বিক বিষয়ে মনিষা কর্মকার বলেন, ‘মফস্বলের মেয়ে হওয়া এবং মেয়ে হয়ে জন্মানোয় যে সব বাড়াবাড়ি বা নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে উঠে এসেছি, বেশ জোরালোভাবেই বিশ্বাস করি- আমার মত মেয়ে এতগুলো বাধা অতিক্রম করে সফল হতে পারলে অন্য কারো পক্ষেই বিসিএস ক্যাডার হওয়া অসম্ভব কিছু না। এছাড়াও চোখের সামনে বন্ধুদের বিসিএস ক্যাডার হওয়া দেখে এবং ছোটবেলায় বাবার ম্যাজিস্ট্রেটদের অবস্থান সম্পর্কে বলা কথাগুলো আমার জন্য বাড়তি অনুপ্রেরণা ছিল। আমার শাশুড়ির ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত। বাচ্চাদের দেখাশোনা এবং সংসারে তার সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ভূমিকা এক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে। বাবা-মা এবং স্বামীর উৎসাহও ছিল সীমাহীন।
সোউজ্যে- জাগো নিউজ