Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শিক্ষিত কৃষকদের অন্য রকম হাট

prazog1সে অন্য রকম এক হাট! কী কী আছে? চেনা ফলপাকড় আর শাকসবজি তো আছেই, আছে কিছু অপ্রচলিত জিনিসও। ওই তো পাকা পেঁপে। তার পাশে শবরি আর চাঁপা কলা। সঙ্গে আছে হনুমানজটা কলা। তাকটা লেগে গেল তো? দাঁড়ান, আরও আছে সরিষার মধু, নদী শিম, কাঁটাওয়ালা বেগুন, মস্তফাপুরী বেগুন আর টক পালং। হাতে ভাজা ভেজালমুক্ত মুড়ি আর পাহাড়ি হলুদের গুঁড়া দৃষ্টি কাড়বেই।

রাজধানীর লালমাটিয়ার ২/৮, ব্লক-এফের ছোট একটি ঘরে এই হাট বসে প্রতি শুক্রবার। উদ্যোক্তা একদল শিক্ষিত তরুণ। তবে দিনভর চলে না এই হাট। বসতে না বসতে ক্রেতার ভিড়ে জমে ওঠে। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বিকিকিনি শেষ। হাটের সব খাদ্যপণ্যের গুণ একটাই‍—এগুলো সার ও কীটনাশকের বিষক্রিয়ামুক্ত।
এই হাটের খোঁজ মেলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্টে। এতে ১২ ডিসেম্বর শুক্রবার ওই প্রাকৃতিক কৃষি বিপণনকেন্দ্রে যা পাওয়া যাবে, তার বিবরণ ছিল।

chardike-ad

ওই দিন সকালে গিয়ে দেখা গেল হাট বেশ জমে উঠেছে। শহুরে তরুণ উদ্যোক্তারা দাবি করলেন, এটি রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত ফসলের হাট। শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য বসে এ হাট।

জানা গেল, সপ্তাহে শুধু বৃহস্পতিবার দুপুরে এ ধরনের আরেকটি হাট বসে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নিয়ামতপুর ইউনিয়নের পূর্ব-বলরামপুর গ্রামে। সে হাট থেকে কিনে আনা সবজি ও ফলই তুলে দেওয়া হচ্ছে শহুরে ক্রেতাদের হাতে। তরুণেরা এই আন্দোলনের নাম দিয়েছেন ‘প্রাকৃতিক কৃষি’।

গ্রামের কৃষকদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কৃষকদের সহায়তায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত চাষাবাদ করাই মূল লক্ষ্য।

দলের সদস্যরা নিজেদের কৃষক হিসেবে পরিচয় দেন। ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়তে পড়তেই তরুণদের মধ্যে এমন স্বপ্ন বাসা বাঁধে। বাংলাদেশে বসে কেন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের যোগাযোগ পড়তে হবে, এ নিয়ে আপত্তি জানান শিক্ষার্থী দেলোয়ার জাহান। তাঁর সঙ্গে সমমনা ব্যক্তিরা বাংলার মানুষের যোগাযোগের পাঠ উদ্ধারের অভিযানে নামেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে রাজধানীতে ফিরে যে যার মতো বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলতেই থাকে। ২০১২ সালে ঢাকায় গড়ে তোলেন প্রান্তজনীয় যোগাযোগ গবেষণাকেন্দ্র (প্রাযোগ)। দলটির অধিকাংশই গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়ে। তাই গ্রামে গিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি কমিয়ে কৃষিকাজ করার পরিকল্পনা নেন তাঁরা।

prazog2
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের-বলরামপুর গ্রামের এই হাট থেকে কিনে আনা শাকসবজি ও ফল তুলে দেওয়া হয় রাজধানীর ক্রেতাদের হাতে।

কৃষক ও প্রাযোগের পরিচালক দেলোয়ার জাহান জানান, ২০১৩ সালে ঢাকার কাছেই মানিকগঞ্জে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের শুরু। প্রতি সাপ্তাহিক ছুটিতে মানিকগঞ্জে গিয়ে খেতে কাজ করতে থাকেন দলের সদস্যরা। তবে নদীভাঙনে সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। পরে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড নামের সংস্থা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে জমি বর্গা দিতে রাজি হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দলের আরেক সদস্য তপু রায়হান সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে কালীগঞ্জে আগমুন্দিয়া প্রাকৃতিক কৃষি খামারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। রাজধানীতে ২৪ অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় প্রাকৃতিক কৃষি বিপণনকেন্দ্র। এখন পর্যন্ত এ বিপণনকেন্দ্রে কী কী ফল ও সবজি আসছে, কার কতটুকু লাগবে, এসব আলাপ আলোচনা চলছে ফেসবুকে।

দেলোয়ার জাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে যৌথভাবে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, আর অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান দখল করেন। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছেন যাত্রা, গম্ভীরা, গ্রামীণ মেলার মতো গ্রামীণ যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নয়ন নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার ইচ্ছা থাকলেও দলাদলির রাজনীতির কাছে হার মেনেছেন। সিঙ্গাপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার একটি চাকরির অফার পান। তবে ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ তখন মাত্র হাঁটি হাঁটি পা পা করছিল। দেলোয়ার জাহানের স্ত্রী ডালিয়া আক্তারও কাজ করছেন দলটির সঙ্গে।
দেলোয়ার জাহান বলেন, ‘জমিতে রাসায়নিক সার না দিলে প্রথম দিকে ফসলের উৎপাদন কম হয়। এ ধরনের সবজি দেখতে আকর্ষণীয় হয় না। পোকা ধরা থাকে। ফলে বিক্রি কম হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ ক্ষেত্রে কৃষককে ন্যায্য মূল্য দিতে না পারলে তাঁরা উৎসাহী হবেন না। এ চিন্তা থেকেই প্রাকৃতিক কৃষি বিপণনকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। তবে কালীগঞ্জ থেকে সবজি ও ফল ঢাকা পর্যন্ত আনাই বিরাট ঝক্কিঝামেলার কাজ।’

prazog
সার ও কীটনাশকের বিষক্রিয়ামুক্ত শাক-সবজি কিনতে হাটে ক্রেতাদের ভিড়।

দেলোয়ার জাহানের ভাষ্য, এখন পর্যন্ত নিজেদের তদারকিতেই রাসায়নিকমুক্ত চাষ হচ্ছে। কোনো ক্রেতা পণ্য রাসায়নিকমুক্ত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে সেই কৃষকের মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে সেই কমিউনিটির একটি কমিটিই এ পণ্যগুলো যে রাসায়নিক বিষমুক্ত, তার সনদ দেবে।

তপু রায়হান জানান, কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের নয়টি গ্রাম, রায় গ্রাম ইউনিয়নের দুটি গ্রামে ১৫০ জন নারী ও ১০০ জন পুরুষ কৃষক এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক কৃষির খামারে নয় বিঘা জমি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের আওতায় এসেছে। শুরু হয়েছে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি, স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণসহ অন্যান্য কাজ। এতে কৃষকদের আগ্রহেরও কমতি নেই।

দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত তরুণও এ ধরনের কাজে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি বিজ্ঞানী নাজিম উদ্দিনসহ অনেকেই সম্পৃক্ত হয়েছেন তরুণদের দলটিতে।

তথ্য সূত্রঃ প্রথম আলো