Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ক্রিকেটের মরু গোলাপ

cricket moru-‘আপনার জন্য বলিউডি গানের সুব্যবস্থা আছে।’

-‘ওসব হামেশাই শোনা হয়। আমার পশতুও চলে’

chardike-ad

-‘তা হয় কীভাবে? আপনি আমাদের মেহমান। এ দেশকে যেন নিজের ঘর মনে করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব’—সাইদ রহমান আহমেদজাইয়ের কণ্ঠে প্রতিবাদের স্বর। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সহসম্পাদক সিদ্ধার্থ মঙ্গা তার অতিথি। কাবুল থেকে গাড়িতে জালালাবাদ যাচ্ছেন তারা। পাকিস্তানের সীমান্ত তখনো ২০ কিলোমিটারের দূরত্ব। ওপারে পেশোয়ার, এপারে জালালাবাদ। আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এখান দিয়ে অবাধে প্রবেশ করে পাকিস্তানের সব শিল্প ও কৃষিজাত পণ্য। তার পর ছড়িয়ে পড়ে গোটা আফগানিস্তানে। জালালাবাদ তাই আফগানদের সব সামাজিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের হূেকারক।

পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগোলিক নৈকট্যই যে তার নেপথ্য কারণ, তা আর কারো অজানা নেই। কিন্তু যে কথাটা কেউ জানে না তা হলো, জালালাবাদ আফগানিস্তান ক্রিকেটের রাজধানী। এর নেপথ্য অনুঘটকও ডুরান্ড লাইন, যেখান দিয়ে দুই দেশের ক্রিকেটারদের অবাধ ভাব বিনিময়ের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের যাতায়াতও একেবারে খোলা বইয়ের পাতার মতো! এ অঞ্চলে বিদেশীদের সঙ্গ দেয়া মানে পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটা হাতে নিয়ে ঘোরা। আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাডেমির কোচ ও গ্রাউন্ড ইনচার্জ সাইদ রহমান রাজি হওয়ার আগে ঠিক এ কারণে আরো দুজনকে জালালাবাদ যাওয়ার অনুরোধ করেও প্রত্যাখ্যাত হন সিদ্ধার্থ মঙ্গা।

কাবুল ভারত ও পাকিস্তানের প্রাচীন শহরগুলোর মতোই জনবহুল। সড়কগুলো ভীষণ ব্যস্ত। মার্কেট থেকে ফুটপাত পর্যন্ত বর্ণিল পণ্যের সমারোহ। বেশকিছু শপিংমলও গড়ে উঠেছে। টয়োটার আধিক্য চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এমন ব্যস্ত জনজীবনে বোমা ফাটার আওয়াজ শুনে এখন আর কেউ চমকে ওঠে না। হোটেলগুলোয় প্রতি সপ্তাহে রুটিনমাফিক তল্লাশি চলে। রাস্তায় সশস্ত্র প্রহরীর কড়া চোখ। কিন্তু তার পরও বোমা ফাটছে খইয়ের মতো! কাবুলের দৈনন্দিন জনজীবনে ‘তালেবান আতঙ্ক’ এখনো জীবিত। গত বছরের জুন থেকে আফগানিস্তানে কোচের দায়িত্ব নেয়া সাবেক কিউই অ্যান্ডি মোলসের অভিজ্ঞতাটা এ রকম, ‘কোচিংয়ের মাঝে আশপাশে কোথাও বোমা ফাটার আওয়াজ সবার কানে সয়ে গেছে। ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারগুলো মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। মিশন শেষ করে ফিরে আসে। এসব দেখে মাঝে মধ্যে নিজেকে মনে হয়, যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানানোর কোচিং করছি! ব্যাপারগুলো একেবারেই গা-সওয়া হয়ে গেছে। এ কারণে রাস্তায় বের হলে এখন আর ভয় লাগে না।’

জালালাবাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিদেশী পর্যটকরা রসিকতা করে বলে থাকেন, ‘এখানে বোমার চেয়েও ড্রাইভিং বেশি বিপজ্জনক!’ সিদ্ধার্থদের ড্রাইভারও বেশ রসিক মানুষ, ‘এখানে ড্রাইভিং আর বুজকাশির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ বুজকাশি? পোলো খেলার ধারণা থাকলে ‘বুজকাশি’র মর্ম উদ্ধার সম্ভব। ঘোড়ায় চড়ে গোলাকার আকৃতির একটি বল পিটিয়ে পোলো খেলা হয়। বাকি সব ঠিকঠাক, শুধু বলের জায়গায় একটা মৃত ছাগল! তাই খেলাটির নাম ‘বুজকাশি’! ঘোড়ায় চড়ে মৃত ছাগল দখলের এ লড়াই আফগানদের জাতীয় খেলা।

ড্রাইভারের রসিকতা, আফগান মরুভূমির বিরান সৌন্দর্য ও পথের দুই ধারে অগণিত ভেড়ার পাল দেখার ক্লান্তিতে খিদে পায় সিদ্ধার্থের। সম্বল বলতে আফগান নান রুটি ও ঘি। অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। খাবারটা দীর্ঘ সময় পেটে মজুদ থাকে বিধায় আফগানদের ভীষণ প্রিয়। একেকটি প্রমাণ সাইজের নান রুটি দোকানগুলোয় জামাকাপড়ের মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়। আফগানরা তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে সবসময় একটি জিনিস সঙ্গে রাখে— ‘সেঞ্চা’। সবুজ চায়ের মতো পানীয়টি খেতে ভালোই লাগে সিদ্ধার্থের। এই সুযোগে নির্লজ্জের মতো দায়িত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন দেখান সাইদ রহমান। চালিয়ে দেন কিছু বলিউডি চটুল গান। সিদ্ধার্থের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নিতে সাইদ রহমান টোপ ফেলেন, ‘আপনার জন্য দুধপট্টির (দুধ-চা) ব্যবস্থা করতে হবে। অতিথি বলে কথা!’

-না, আমি চায়ে দুধ কিংবা চিনি পছন্দ করি না।

-আপনি খাঁটি ভারতীয় তো!

-সাইদ রহমানের কণ্ঠে সন্দেহ।

পশতু সঙ্গীত ও বলিউডি গানের মল্লযুদ্ধ চলতেই থাকে। কোনো পক্ষই হার মানতে রাজি নয়। একজন সৌজন্যতাবোধ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর, আরেকজন তার অতিথিসেবা প্রমাণে মরিয়া। শেষ পর্যন্ত জয়ী অন্য কেউ। গুলাম আলী! পাকিস্তানের কিংবদন্তি গজল শিল্পী। সিদ্ধার্থ ও সাইদ দুজনই ভালো উর্দু জানায় পেনড্রাইভে নিয়ে আসা গুলাম আলীই মল্লযুদ্ধ থামিয়ে দেন। সাইদের শৈশব কেটেছে পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে। গুলাম আলীকে দ্বৈরথে ঠেলে দিয়ে সে বলে, ‘পাকিস্তানি সঙ্গীতশিল্পী ও কৌতুকাভিনেতারা ভারতীয়দের চেয়ে অনেক ভালো।’ সিদ্ধার্থ গানের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। স্পিকারে দরাজ কণ্ঠে গেয়ে চলেন গুলাম আলী ‘আওয়ার্গি’ (ভ্রমণক্ষুধা)। একেবারে খাপে খাপ!

গুলাম আলী প্রশ্ন করেন, ‘ইস দ্যশত ম্যেইন এক শেহের থা, ও ক্যায়া হুয়া আওয়ার্গি’? সাইদ রহমানের দৃষ্টি সামনের ঊষর মরুভূমিতে। ‘দ্যশত’ পারস্য ভাষার শব্দ, যার অর্থ মরুভূমি। শেহের মানে নগর। অর্থাৎ ‘একসময় এ মরুভূমিতে প্রাণ ছিল। তার কী হলো?’ সিদ্ধার্থ ভাবে, হাজার বছর ধরে জবুথবু হয়ে বসে থাকা পাহাড়গুলোর কাছে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে। ওরাই তো সবকিছুর নীরব সাক্ষী! যুদ্ধবিগ্রহ, গোঁড়ামি, জাতিগত বৈষম্য, রাশিয়ান, আমেরিকান, জিহাদি— এ সবকিছুর সাক্ষী ওই পাহাড়গুলো, এসব ভাবতে ভাবতে তাদের গাড়ি মাহিপুর পেরিয়ে যায়। মাহি অর্থ মাছ, ‘পার’ অর্থ উড়ন্ত। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাবুল নদী মাছে গিজগিজ করে। তখন লাফ দিয়ে পানির ওপর ওঠা মাছগুলোকে উড়ন্ত বলেই মনে হয়! জালালাবাদ যত নিকটবর্তী হচ্ছে, গুলাম আলীর প্রশ্নের সত্য ততই বিবসনা হয়ে পড়ছে সিদ্ধার্থের সামনে। তার চোখের সামনে চারপাশ ঘেরা সুবিশাল বিরান প্রান্তরটি একসময় গোটা এশিয়ার মধ্যে সেরা জলপাই প্রসব করত। উর্বর কাদামাটি ও শীতকালে তুষারপাত হয় না, যে কারণে জলপাই আবাদের জন্য জায়গাটা ছিল আদর্শ। বছরের পর বছর ধরে চলমান যুদ্ধবিগ্রহে জলপাই বাগানগুলোর কবর রচিত হয়েছে সেই একই মাটিতে! একসময়ের সবুজ ভূমি তাই এখন বিরান মরুভূমি।

সিদ্ধার্থ একেবারে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে, এ ঊষর কোথাও বন্ধুর, কোথাওবা সমতল। তার বুকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শহর! এ শহরে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তুলকালাম হয় না। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য কিছুই লাগে না, যে কোনো উচ্চতার সামান্য তিনটি পাথর পাশাপাশি দাঁড় করালেই চলবে। উইকেট! ছাল-চামড়া হারানো টেনিস বলগুলোর আব্রু রক্ষা করছে প্যাঁচানো টেপ। কারো হাতে বল, কারো হাতে ব্যাট। কিন্তু বেশির ভাগের পায়েই স্পঞ্জের স্যান্ডেল। অসংখ্য ক্ষুদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ক্রিকেট! সিদ্ধার্থ খেয়াল করে, বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানই অপরিণামদর্শী, কিন্তু বোলাররা দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং অ্যাকশন নিখুঁত।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন চলাকালীন অসংখ্য স্থানীয় পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। দেশে ফেরার সময় তাদের ঝুলিতে ছিল ক্রিকেটও। মোহাম্মদ নবীকে মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থের। বেড়ে ওঠা পেশোয়ারের শরণার্থী শিবিরে। সেখানেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। দীর্ঘ ১৭ বছর পর কাবুলে ফেরেন মোহাম্মদ নবী। মরুভূমিটা তার অদেখা নয়— ধ্বংসপ্রায় বাড়িঘর, রাস্তার আনাচে-কানাচে অবিস্ফোরিত শেল, দেয়ালে অসংখ্য বুলেটের ক্ষতচিহ্ন! কিন্তু তার পর থেকে এ পর্যন্ত আফগানদের অর্জন কি এতটাই তুচ্ছ যে, নেহাত ক্রিকেটের স্বার্থেও তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেললে জায়ান্টদের মান-মযার্দা ধূলিসাৎ হয়?

ক্রিকেট রাজনীতির এসব হালচাল বোঝা বড় কঠিন ব্যাপার। চার্চের সঙ্গে নানদের যে সম্পর্ক, আফগানদের সঙ্গে ক্রিকেটের বন্ধনও এখন ঠিক ততটাই গভীরে প্রোথিত। ইতিহাস মনে রাখবে, শুরুতে ‘সে’ ছিল ভিনদেশী এক লাজুক বধূ, যে কিনা খুব সহজেই আফগানদের মোহাবিষ্ট করে সীমান্ত পাড়ি দেয় তাদেরই সঙ্গে! এত দিনে বেশ ডাগর হয়ে ওঠায় ‘তার’ প্রেমে মশগুল এখন ছেলে থেকে বুড়ো! আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহজাদা মাসুদ স্বীকার করে নিলেন সে সত্য, ‘বিমানে করে বেশ নিচু দিয়ে আফগানিস্তান পাড়ি দিলে আপনি শুধু ক্রিকেট খেলাটাই দেখতে পাবেন।’

আফগানিস্তানে অ্যান্ডি মোলসের আগমনের পটভূমিও মনে পড়ে সিদ্ধার্থের। ওয়ারউইকশায়ায়ের এ সাবেক ব্যাটসম্যান কেপটাউনের গোছালো জীবন ছেড়ে চলে আসেন এ যুদ্ধবিধ্বস্ত ঊষর মরুভূমির দেশে। তার ভাই ব্রিটেনের অ্যান্টিটেররিজম ইউনিটে কাজ করেন। সহোদরের বিরোধিতা ও ব্রিটিশ সরকারের হাজারো যুক্তিকে পায়ে ঠেলে আফগানিস্তানে নতুন ঠিকানা করে নেন মোলস। এ দেশে পা রাখার আগে কেপটাউনে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্রিকেট দীক্ষা দিতেন এ কিউই। সে অভিজ্ঞতা থেকে মোলস বুঝতে পারেন, কেপটাউনের সেই শিশুদের তুলনায় আফগানদের জীবন আরো দুর্বিষহ। অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণুতা এবং জীবনের প্রতি খিদে না থাকলে এখানে বেঁচে থাকাই দায়!

মোহাম্মদ নবীদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে দেশপ্রেমের প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই। সবাই বেড়ে উঠেছে আফগানিস্তানে। ফরিদ আহমেদ তাদেরই একজন। গত জানুয়ারিতে পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়ে একাই ছিঁড়েখুঁড়ে দেন এ পেসার। নয় মাস পর তার ডাক পড়ে জাতীয় দলের ক্যাম্পে। নবীদের সঙ্গে তার অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। ফরিদের বাবা জালালাবাদেরই নিকটবর্তী একটি এলাকায় বাস করেন। তথ্যটা জানার পর সিদ্ধার্থের আগ্রহ দেখে সাইদ রহমান ফরিদের বাবাকে ডাকার ব্যবস্থা করেন। সম্পূর্ণ বিনা নোটিসে ফরিদের বাবা অতিথি আপ্যায়নের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা ভুলতে সময় লাগবে সিদ্ধার্থের। সে নিরামিষাশী কথাটা জানার পর একেবারে ভোজবাজির মতো টেবিলে খাবারের মেনু পাল্টে গিয়েছিল! ফিরে আসার সময় অতিথিসেবার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে সিদ্ধার্থের হাতে নিজের বন্দুকটা তুলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন ফরিদের বাবা, ‘আফগানিস্তানে থাকতে হলে এটার প্রয়োজন আছে।’

-অতিথিসেবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তার পর আর এটার দরকার কী?

-অতিথিসেবার অর্ধেকও আপনার কপালে জোটেনি। এক কাজ করুন, আমাদের গ্রামে আজকের রাতটা থেকে যান। তাহলে বুঝতে পারবেন।

ফরিদের বাবাকে সবাই ডাকে ‘মালিক কাকা’। ছেলে ঝাঁপ দেয়ার পরই ক্রিকেটপাড়ে বাবার আবির্ভাব। এখন দুজনই হাবুডুবু খাচ্ছেন। একজন খেলোয়াড় হিসেবে, আরেকজন মজা লুটছেন তার ভক্ত হয়ে। ফরিদ যে ম্যাচে ৭ উইকেট পায়, মোবাইলে তার ভিডিও সিদ্ধার্থকে দেখান মালিক কাকা। তার দেখার ফাঁকে মালিক কাকা বলে চলেন, ‘সাতটি আউটের মধ্যে পাঁচটি উইকেটের পেছনে। বাকি দুটি এলবি ও বোল্ড। ব্যাটসম্যানরা কোনো ভুল করেনি।’

সিদ্ধার্থ আড়চোখে খেয়াল করে, কথাগুলো বলার সময় মালিক কাকার চোখের ভাষা পাল্টে যায়। ?‘প্রশান্তি’ শব্দটাই সে চাহনির সঙ্গে সবচেয়ে ভালো মানায়।

হাজি আমানুল্লাহ।

ইজাতুল্লাহ দৌলতজাইয়ের গর্বিত পিতা। ছেলে তার উঠতি প্রতিভা। আমানুল্লাহ সামান্য দোকানদার। বছরের শেষ নাগাদ সম্ভাব্য তুষারপাতের সঙ্গে লড়াইয়ে ছাদটা যে হেরে যাবে, তা আন্দাজ করে নিতে অসুবিধে হয় না সিদ্ধার্থের। কিন্তু তার আন্দাজে ছিল না, অমন কাকডাকা ভোরে আফগানরা কীভাবে আতিথ্যসেবার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে পারে! কেটলিভর্তি দুধ চা, নান ও হরেক রকম পিঠা!

কাবুল স্টেডিয়ামের বিকালগুলো অসাধারণ!

ডাক্তারি বিদ্যায় ট্রেনিং নিয়েছেন আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নুর মোহাম্মদ। স্টেডিয়াম স্টাফদের চোখে ডক্টর সাহিব। খেলোয়াড়দের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবকিছুর দেখভালের দায়িত্ব তার কাঁধে। নুর মোহাম্মদই কাবুল স্টেডিয়ামের সর্বেসর্বা। ধোপদুরস্ত স্যুট পরে অফিসে আসেন। বের হন ট্রাকস্যুট পরে। ইনডোরে গিয়ে ফুটবল খেলেন। কোচ, স্টাফ, ইলেকট্রিশিয়ান, পিওন কোনো ভেদাভেদ নেই। খেলাটার জন্য শুধু ইচ্ছার প্রয়োজন। শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে নিয়মটা আলাদা। অনুশীলনের ক্লান্তি চেপে না ধরলেই কেবল তারা খেলতে পারেন। কোনো বাঁধাধরা সময় নেই। শরীর যতক্ষণ সায় দেবে ততক্ষণ খেলা চলে। এর পর কুলডাউন ও চা-বিস্কুট। সিদ্ধার্থের কাছে মনে হয়, স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় বন্ধুদের সঙ্গে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলার পর মায়ের ডাকে ঘরে ফেরার আগে শরীরে প্রচণ্ড অবসাদ সত্ত্বেও বাতাসে ঘুষি মেরে চলা চঞ্চল ছেলেটির মতোই এরা সবাই।

হঠাৎ একজনের ডাকে সিদ্ধার্থের ভাবনা টুটে যায়। বদলি হয়ে মাঠে নামতে হবে। টাচলাইনের ভেতরে পা রাখার পরই খেলা নিয়ে আফগানদের খোলতাই আবেগের গোপন কুঠরির দরজাগুলো এক এক করে খুলে যায় তার সামনে। কাবুল স্টেডিয়ামে ঢোকার পর থেকে প্রায় ৫ মিনিট পর পর ‘তার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা’ এমন প্রশ্ন করে বিরক্ত করেছে যে লোকটি, সে তার বিপক্ষ গোলকিপার। শুধু এজন্যই ডিফেন্সের নামে সিদ্ধার্থকে কষে লাথি মারতে লোকটি দ্বিতীয়বার ভাবেনি! তার সতীর্থদের কাছে পর্যন্ত ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। অথচ খেলাটা নাকি প্রীতি ম্যাচ! মোলসের কথাগুলো মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থের,? ‘আফগানদের আবেগ নির্ভেজাল। ওদের মুখ দেখেই সব বলে দেয়া যায়। আমরা এখন ওদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাই করছি।’

-‘আমার কাছে মারাঠি সিনেমা খুব পছন্দের’—রাতের খাবারে সিদ্ধার্থের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে সেই গোলরক্ষক দৌলত আহমেদজাই। অবসর নেয়ার পর এখন একাডেমির কোচ।

সিদ্ধার্থ ভীষণ অবাক হয়। মারাঠি মানে তো মহারাষ্ট্র? সিদ্ধার্থ আরেকটু খোলাসা করে জানতে গিয়ে বুঝতে পারে, দক্ষিণের ছবির কথা বলছেন দৌলত আহমেদজাই। আফগান ছবি সম্পর্কে তার কাছ থেকে সিদ্ধার্থ একটা ধারণা পায়, ‘আমাদের নায়করা কালাশনিকভের অজস্র গুলি ঠেকায় সামান্য একটা কোদাল দিয়ে!’

বর্ষীয়ান আফগানের চোখের মণি দিলীপ কুমার ও কাদের খান। বলিউডের এ দুই তারকার শিকড় প্রোথিত আফগানিস্তানে। এখানকার সেলুনের দেয়ালে রাজত্ব করেন শাহরুখ খান। ফুটবল খেলায় ফাউল করলে নুর তাকে ডাকেন অমরেশ পুরি! সিদ্ধার্থ জানে, এ চিত্র সীমান্তের দুই পাড়ের মিথস্ক্রিয়ারই অংশ। সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার তো থাকছেই। প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য দিল্লি ছুটে যায় অসংখ্য আফগান নর-নারী। ভারতকে তারা সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট কি তাদের পাত্তা দেয়? নাকি নাক সিটকাতে পারলে বাঁচে? সিদ্ধার্থ নুরের কাছ থেকে জেনেছে, গত বছর এক মিটিংয়ে বিসিসিআই সভাপতি শ্রীনিবাসন তাকে সরাসরি বলেন, ‘১০ মিনিট সময় পাবে। এর মধ্যে যা বলার বলো।’

আফগান জাতীয় দল কখনো ভারতের বয়সভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গেও খেলার সুযোগ পায়নি। ভারতের অত্যাধুনিক ট্রেনিং একাডেমিগুলোয় সময় কাটানো তো অনেক দূরের ব্যাপার!

ভারতের ঠিক বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান। দেশটিকে বলা যায়, আফগান ক্রিকেটের ‘পালক পিতা’। আফগান ‘এ’ দল এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার পাকিস্তান সফর করেছে। লাহোরের জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি মোহাম্মদ নবীদের নখদর্পণে। আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় আফগানদের প্রথম প্রতিপক্ষও পাকিস্তান। যদিও এ মুহূর্তে পাকিস্তানকে খুব একটা পছন্দ করতে পারছে না আফগানরা। ভূরাজনীতি আসলে খুবই জটিল বিষয়। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের ভৌগোলিক নৈকট্য অস্বীকার করার উপায় নেই। হামিদ কারজাই একবার বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তান ও পাকিস্তান দুই অবিচ্ছেদ্য সহোদর।’

ডুরান্ড লাইন সীমান্তের এপার-ওপারের পশতু জনগোষ্ঠীকে শুধু ভৌগোলিকভাবেই আলাদা করতে পেরেছে। কিন্তু তাদের শরীর ও মনের মিথস্ক্রিয়া থামানো সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান এখনো আফগান মাটিতে প্রতিনিয়ত রক্তের হোলি খেলে চলা তালেবানের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সিদ্ধার্থের মনে ঘা মারে বেশ প্রচলিত একটি কৌতুক, ‘ভারত হলো আফগানিস্তানের সেই প্রেমিকা, যাকে তারা কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তাই সুবিধা বুঝে পাকিস্তানকে বিয়ে করেছে আফগানিস্তান!’

ফোর হুইল ড্রাইভের পশমি সিটে গা এলিয়ে দিয়ে সিদ্ধার্থ তার ভাবনার পাখা মেলে দেয়— আচ্ছা, সে চলে যাওয়ার পরও তো সাইদ রহমান ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকবেন? লন্ডনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও তো সামান্য ফুরসত পেলেই ইজাতের ওপর নজর রাখবেন তার চাচা? ফরিদ উইকেট পেলে আনন্দের আতিশয্যে নিশ্চয়ই আকাশপানে কয়েক রাউন্ড একে-৪৭-এর গুলি খরচ করবেন তার গর্বিত পিতা? আগামী শীতে আরেকটু ভালো ঘরের আশায় বুক বেঁধেছেন আফসার। এত সব আশার মাঝে কেউ কেউ হয়তো আরো এক ধাপ এগিয়ে নেবে তাদের পেশাদারিত্বকে। বাকিরা ভুলে যাবে জাতিগত সহিংসতা। ঐক্যবদ্ধ হবে একই সীমানার ছায়াতলে। স্বপ্নের চারাগাছে এখন থেকেই জল সিঞ্চন করছেন অনেকে, ‘আমার সন্তানকেও যদি মোহাম্মদ নবী বানাতে পারতাম!’ ব্যবসায়ীরা দিন-রাত খেটে চলছেন। নবী-শেহজাদদের মুখ বেচে কীভাবে আরো দুই পয়সা বেশি রোজগার করা যায়? প্রশাসকদের লক্ষ্যও অভিন্ন। সত্যিই এ বিশ্বকাপ তার বাকি সন্তানদের কাছে হতে পারে মহাগুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আফগানদের কাছে তা বাঁচা-মরার লড়াই। প্রাগৈতিহাসিক কালের অতিকায় হস্তী লোপ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই একই কালের ক্ষুদ্র তেলাপোকা তো আজো টিকে আছে স্বমহিমায়? আফগানরা তেলাপোকা নয়, গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভস্ম থেকে উড়াল দিতে চায়। আর তাই বিশ্বকাপ চলাকালীন রোজ প্রত্যুষে ধূমায়িত ‘সেঞ্চা’র সৌরভে ম-ম করবে প্রতিটি আফগান কুঁড়েঘর। কান পাতলে হয়তো ভেসে আসবে নান রুটির দেহ কয়েক টুকরো হওয়ার শব্দও! তখন এ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাটি কি কেবল শুধুই ঊষর মরুভূমি? নাকি ‘ইস দ্যশত ম্যেইন এক শেহের হ্যায়?’

‘দ্য ক্রিকেট মান্থলি’ অবলম্বনে, বণিকবার্তার সৌজন্যে।