Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

রিপন একাই বাঁচালেন নৌকার ১১৫ যাত্রীর প্রাণ

ripon১৪ মে বিকেল চারটা। কক্সবাজার আদালত প্রাঙ্গণ। বছর পঁচিশের এক যুবককে ঘিরে আছেন জনা বিশেক মানুষ। তাঁর নাম মো. রিপন। মুখে দাড়ি। পরনে মলিন কাপড়। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পরও চোখে–মুখে আনন্দের ঝিলিক। এ আনন্দ, বাঁচার আনন্দ। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এই যুবক শুধু নিজে বাঁচেননি, বঁাচিয়েছেন আরও ১১৫ যাত্রীকে। যাঁরা দালালদের খপ্পরে পড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে।

কী ঘটেছিল সেদিন? শুনুন রিপনের মুখে—‘দিনটি ছিল ৯ মে। সকালে আমাদের রাখা ইঞ্জিনচালিত বড় কাঠের নৌকাটি মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডের দিকে যেতে থাকে। যাত্রী ছিল তিন শতাধিক। এর মধ্যে নারী ছিল ৩৫ জন। থাইল্যান্ডের দিকে কিছুদূর যাওয়ার পর সেখানকার সীমান্তরক্ষী বাহিনী গুলি করে নৌকা লক্ষ্য করে। এরপর নৌকাটি আবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি চলে আসে। এর মধ্যে দালালেরা মোবাইলে বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারে পরিস্থিতি ভালো নয়। তারা মিয়ানমারের ১৭টি পয়েন্টে ৩৫ নারীসহ ২৪০ জনকে নামিয়ে দেয়। নৌকায় ছিলাম আমরা ১১৬ জন। এদিকে আমাদের রেখে আরেকটি নৌকায় করে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় দালালেরা। ওই সময় যাত্রীরা কান্নাকাটি শুরু করলে দালালেরা ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। এরপর পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে তারা চলে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে।’

chardike-ad

কিছুক্ষণ বলার পর থামলেন রিপন। দম নিলেন। আবার শুরু করলেন। বললেন, ‘চালক ছাড়া নৌকাটি ভাসতে থাকে সাগরে। সবাই বাঁচার আশা ছেড়ে িদয়েছিলেন। আমার আগে বালু তোলার ড্রেজার চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল। মাঝেমধ্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকাও চালিয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বসলাম চালকের আসনে। আমি স্টিয়ারিং ধরার পর সবাই আবার আশায় বুক বাঁধলেন। কিন্তু চালাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। দিক ঠিক করতে পারছিলাম না। মনে সাহস রাখলাম। কারণ, যেকোনোভাবেই বাঁচতে তো হবে। এভাবে চলল সারা রাত। ১০ মে সকালে এসে বিকল হয়ে গেল ইঞ্জিন। জ্বালানিও নেই, খাবার নেই। বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়। আবার শুরু হলো কান্নাকাটি। তবে চালকের আসনে ছিলাম আমি। এভাবে সাগরে ভাসলাম আরও দুই দিন। অবশেষে ১২ মে সকালের দিকে দেখা মিলল মাছ ধরা আরেকটি নৌকার। নিশানা উড়িয়ে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর নৌকাটি কাছে এল। দেখলাম সবাই বাংলাদেশি। তখন বুঝলাম আমরা বাংলাদেশের সীমানায় আছি। বাঁচার আশা জিইয়ে রইল। এরপর তাঁরা গিয়ে কোস্টগার্ডকে খবর দিলে আমাদের উদ্ধার করা হয়।’

আপনি কীভাবে নৌকায় উঠলেন? বললেন, ‘আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জের রতনকান্তি উপজেলার একঢালা গ্রামে। আমি থাকতাম নরসিংদীর কাউলিয়াপাড়ায়। আমার বন্ধু জাকির (বাড়ি সিরাজগঞ্জ) গত ২ এপ্রিল সমুদ্রসৈকত ভ্রমণের কথা বলে আমিসহ তিনজনকে কক্সবাজার নিয়ে আসে। এরপর ৩ এপ্রিল নিয়ে যায় টেকনাফ। ওই দিন রাতেই আমাদের তুলে দেওয়া হয় দালাল হামিদ কায়সারের হাতে। তিনি ওই দিন রাতেই আমাদের নৌকায় তুলে দেন। এর পর থেকে সাগরে ভেসেছি।’

নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া যাত্রী নরসিংদীর মো. শফিক ও কামাল মোল্লা বলেন, রিপন না থাকলে ১১৬ যাত্রীর সবাইকে সাগরে ডুবে মরতে হতো। কারণ, রিপন ছাড়া বোট চালানোর অভিজ্ঞতা অন্য কারও ছিল না। আল্লাহর রহমতে রিপনের কারণেই তাঁরা প্রাণে রক্ষা পান। এ জন্য তাঁরা রিপনের কাছে কৃতজ্ঞ। এ জীবনে আর মালয়েশিয়ার নাম মুখে আননে না তাঁরা।

১২ মে উদ্ধার করা ১১৬ জন যাত্রী কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ১৪ মে জবানবন্দি দেন। এ সময় ভয়ংকর সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিচারকের সামনে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনেকে প্রতিজ্ঞা করেন, এলাকায় ফিরে গিয়ে তাঁরা মানব পাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন।

তবু থামছে না মানব পাচার: কক্সবাজার উপকূলে পুলিশের অভিযানের পরও থামছে না মানব পাচার। ১৪ মে সকালে টেকনাফের শাহপরীর ঘোলাপাড়া থেকে পাচারের সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা মালয়েশিয়াগামী ১১ জন যাত্রীকে আটক করেছেন।

আটক ব্যক্তিরা বলেন, কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক এলাকার একজন দালাল তাঁদের একটি মাইক্রোবাসে করে টেকনাফ নিয়ে আসেন। এরপর টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের আছারবুনিয়া গ্রামের দালাল মফিজের হাতে তুলে দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৬ জন হুন্ডি ব্যবসায়ীর তালিকায়ও এই মফিজের নাম রয়েছে।

টেকনাফ ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ জানান, মানব পাচার ও মিয়ানমারের নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে উপকূলে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। তার পরও মানব পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেওয়ান আবুল হোসেন জানান, ১৩ মে সন্ধ্যায় কক্সবাজার শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় মানব পাচারের মুক্তিপণের টাকা নিতে এসে ধরা পড়েন রাশেদা বেগম ও মামুনুর রশিদ নামের দুই দালাল।

পুলিশের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারের ৪১টি পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচার হচ্ছে। ২০১৪ সালে কক্সবাজার উপকূল দিয়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া পাচার হয়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। ২৩০ দালাল ও ২৬ জন হুন্ডি ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে এই মানব পাচার।

প্রথম আলোর সৌজন্যে