Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যে ছবি কাঁদাল বিশ্ব

ailanভূমধ্যসাগরের বাতাসে তুরস্কের উপকূলে এসে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের পর ঢেউ। সেই সমুদ্র উপকূলের বালুতে নিথর পড়ে আছে প্রাণহীন ছোট্ট একটি শিশু। ছোট দুটি পায়ে জুতা, পরনে কালো প্যান্ট আর গায়ে লাল সুপারম্যানের টি-শার্ট। শিশুটির নাম আইলান কুর্দি। বয়স তিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে তার পরিবার গ্রিসে পাড়ি জমিয়েছিল আশ্রয়ের আশায়; কিন্তু মেলেনি আশ্রয়।

ভূমধ্যসাগরের বালুকাবেলায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শিশু আইলানের মৃতদেহের মর্মস্পর্শী ছবি কাঁদাল বিশ্বের মানুষকে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ইউরোপীয়দের নিষ্ঠুরতা আর উদাসীনতা। এ ছবি প্রকাশের পর ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ। তাদের প্রশ্ন, এর পরও কি জেগে উঠবে না বিশ্ববিবেক?

chardike-ad

গ্রিসের উপকূলের কস দ্বীপের কাছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহন করা নৌকাটি ডুবে ছোট্ট আইলানের দেহটি তলিয়ে যায়। ১৩ মাইল দূরে তুরস্কের উপকূলে এসে পৌছায় মৃতদেহটি। ওই নৌকাডুবিতে মারা যান তার মা এবং বড় ভাই পাঁচ বছরের গালিবসহ ১২ আশ্রয়প্রার্থী। বেঁচে আছেন কেবল বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি। শোকে বিহ্বল আবদুল্লাহ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি স্ত্রী ও সন্তানের হাত ধরে রেখেছিলাম; কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারিনি। আমার স্ত্রী-সন্তান সবই গেছে। আর কিছুই নেই।’ তিনি বলেন, আমার সন্তানের মৃত্যুই যেন এ ধরনের শেষ মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর আগে ফেসবুকে আবদুল্লাহ কুর্দি লিখেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই।

তুরস্কের উপকূলরক্ষীরা জানান, বুধবার বদ্রাম উপদ্বীপ থেকে দুটি নৌকা গ্রিসের কস নামের একটি দ্বীপের উদ্দেশে পাড়ি দেয়। পথে দুটি নৌকাই ডুবে যায়। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে পাঁচ শিশু ও একজন নারী ছিলেন। এ পর্যন্ত ১৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। আইলানকে উদ্ধার করেন তুর্কি বাবুর্চি আদিল দেমিরতাস। তিনি জানান, তুরস্কের গোল্ডেন বিচে যখন শিশুটিকে উদ্ধার করেন, তখন তার চোখ দুটি খোলা ছিল। আলতো করে তিনি সেগুলো চিরতরে বন্ধ করে দেন।

ব্রিটেনের প্রায় সব গণমাধ্যম প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে ছোট আইলানের মর্মান্তিক ছবিসহ খবর প্রকাশ করেছে। ফেসবুক-টুইটারসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শত শত মানুষ শেয়ার করেছে সমুদ্রতীরের বালুতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ছোট আইলানের নিথর দেহের ছবি।

ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা নিজেদের সম্পাদকীয় নীতিতে অটল থাকতে পারেনি। মৃতদেহের ছবি না ছাপলেও সৈকতে পড়ে থাকা আইলানের মৃতদেহের ছবি ছেপেছে তারা।

দ্য মিরর শিরোনাম দিয়েছে একটি মাত্র শব্দে :’অবিশ্বাস্য’। ডেইলি মেইল লিখেছে_ ‘মানবীয় বিপর্যয়ের শিকার ছোট্ট শিশুটি’। মেট্রো পত্রিকার শিরোনাম :’ইউরোপ তাকে বাঁচাতে পারল না’। দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে :’এই সিরীয় শিশুটির মৃতদেহও যদি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে ইউরোপীয়দের মনোভাব পাল্টাতে না পারে, তাহলে আর কিসে পারবে?’ পত্রিকাটি শরণার্থীদের দায়িত্ব গ্রহণে ‘ব্রিটেনের ন্যায্য ভূমিকা’ বিষয়ক একটি আবেদন তৈরি করে। ওই আবেদনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর পড়ে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে জনমত গঠন করতে প্রচার শুরু করেছে ইনডিপেন্ডেন্ট।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে ব্রিটেন। এ জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সরকার। দ্য সান বলেছে, ‘ক্যামেরন সরকারকে আমরা বলতে চাই, এই সমস্যা শরণার্থীদের তৈরি নয়।’

সুইডেন-ইতালিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের গণমাধ্যমগুলো সরব হয়ে উঠেছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে ইউরোপের উপেক্ষা ও নেতিবাচক মনোভাবের বিরুদ্ধে। ইতালির ‘লা রিপাবলিকা’ লিখেছে_ ‘একটি ছবি স্তব্ধ করে দিয়েছে ইউরোপকে।’ এই ঘটনাকে ইউরোপের ‘ডুবে যাওয়া’ হিসেবে দেখছে স্পেনের বিভিন্ন গণমাধ্যম।
টনক নড়েছে বিশ্বনেতাদের।

ব্রিটেনের ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার উদ্যোগে শরণার্থীদের ইউরোপে স্বাগত জানানোর দাবি উঠেছে। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে শুরু করেছেন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ। ব্রিটেনের সাবেক কেবিনেট মন্ত্রী ব্যারনেস সাইয়েদা ওয়ার্সি অন্য অনেকের সঙ্গে ক্যামেরনকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আরও বেশি কিছু করার কথা ভাবুন।’ লেবার পার্টির ভারপ্রাপ্ত নেতা হ্যারিয়েট হারম্যান লিখেছেন, ‘দয়া করে গোয়ার্তুমি ছাড়ূন।’

লেবার, দ্য লিবারেল ডেমোক্র্যাট, এসএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা সরকারকে সিরিয়ান অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। লেবার পার্টির নেতা ডেভিড মিলিব্যান্ড বলেছেন, ‘এই ছোট্ট শিশুটির মৃতদেহের ছবিও যদি ইউরোপের মন পাল্টাতে না পারে, তাহলে আর কিসে তা পাল্টাবে?’

ছোট্ট আইলানের মৃতদেহের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর সোচ্চার হয়ে উঠেছে মানবাধিকারভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রধান নির্বাহী জাস্টিন ফোরসিথ বলেছেন, ‘সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা একটি পরিবারের ছোট এই শিশুর মৃতদেহ আমাদের স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, আমাদের শিশুরা ভীষণ বিপদের মধ্যে রয়েছে। এই অপমৃত্যু অবশ্যই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করা উচিত। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বুঝতে হবে, আশ্রয় পাওয়া শরণার্র্থীদের মানবিক অধিকার। এ অধিকার ক্ষুণ্ন করার অধিকার কারও নেই।’

বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ করা হয়েছে এভাবে_ #মানবতা ভেসে গেছে ভূমধ্যসাগরে। টুইটারে সর্বোচ্চ মন্তব্য এসেছে এই হ্যাশট্যাগে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি মানুষই লুফে নিয়েছে এই স্লোগানটিকে। আইলানের জন্য প্রার্থনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন ছবি।

সিরিয়ার কোবানি শহরে থাকত আইলান কুর্দির পরিবার। গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত অভিশপ্ত দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও বেঁচে থাকতে চেয়েছিল তারা। এজন্য তাদের প্রথম পছন্দ ছিল কানাডা। কানাডার কাছে আশ্রয়ও চেয়েছিলেন আইলানের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি। কিন্তু কানাডা কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি তাদের আবেদনে। আইলানের মৃত্যুর পর এখন প্রশ্ন উঠেছে_ আদৌ কি পশ্চিমাদের বরফ শীতল হৃদয় গলবে?

তুর্কি কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার সন্দেহভাজন চার মানব পাচারকারীকে আটক করেছে। গত বুধবার শিশু আইলানসহ ১২ সিরীয় অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যুর পর গতকাল তুরস্কের নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের গ্রেফতার করে। আটকদের চারজনই সিরিয়ার নাগরিক। বৃহস্পতিবার বিকেলে তাদের আদালতে হাজির করা হয়।
দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স, দ্য মেইল ও দি ইনডিপেন্ডেন্ট।