Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কী খাচ্ছে মানুষ?

ICE_CREAMভেজাল নিয়ে আর কত লেখা যায়? মাস কয়েক আগে দেশের ভেজালবিরোধী অভিযান নিয়ে লিখেছিলাম। বিষয়টি প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আবারো লিখতে হচ্ছে। ভেজাল নিয়ে মাঝে-মধ্যেই পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয় ভেজাল খাদ্যদ্রব্য নিয়ে।

ফলে মানুষ জানতে পারছে খাবারের নামে তারা কী খাচ্ছে! কারণ এর সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ার ফল হতে পারে মারাত্মক। ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাহীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের।

chardike-ad

শুধু তাই নয়, ক্যানসার ও কিডনি সমস্যাসহ নানা ধরনের রোগ বিস্তারের পেছনেও রয়েছে ভেজাল খাদ্য গ্রহণ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে গড়পড়তা প্রতিটি মানুষের কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে অন্তত শতকরা ৪৫ ভাগ, ক্রমশ তা কমতেই থাকছে এবং কুখাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যুর দরুন জনগণের গড়ে আয়ু হ্রাস পাচ্ছে আট থেকে ১২ বছর।

ফলে ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য থেকে মুক্ত থাকতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের কর্মক্ষমতা অনেক বেশি অটুট থাকত, গড়পড়তা আয়ু বৃদ্ধি পেত আরো অন্তত আট থেকে ১২ বছর এবং গড় চিকিৎসা ব্যয় কমে যেতো বর্তমানের তুলনায় কমপক্ষে ৭০%। আরো মারাত্মক ব্যাপার যে, নারীরাও সব সময় এসব ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য খাচ্ছেন, এমনকি গর্ভাবস্থায়ও তা খেতে বাধ্য হচ্ছেন- হয়তো না জেনেই।

ভেজালবিরোধী অভিযানে বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশস্যে অরিজিনাল কালার করার জন্য ফুটগ্রেড কালারের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় সাধারণ ব্যবহার্য রং। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমাদের দেশের ক্রেতারা কষ্টার্জিত অর্থে ক্রয় করা খাদ্যদ্রব্য দ্বারা যেমন রোগে ভুগছেন, তেমনি অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নতমানের সামগ্রী ক্রয় করে হচ্ছেন প্রতারিত। যত্রতত্র ভেজাল মিষ্টি তৈরির চিত্র দেখে অনেকে মিষ্টি আর খাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করছেন। পাউরুটির মধ্যে পচা ডিমের মিশ্রণ, হোটেলে মরা মুরগির ফ্রাই, ফাস্টফুডের খাদ্যের ভেজাল অখাদ্য মিশ্রণ, আগোরা, মীনাবাজার কিংবা স্বপ্নের মতো মেগাশপেও পচা মাছ সংরক্ষণের যেসব দৃশ্য টিভিতে দেখানো হয়েছে তা প্রত্যক্ষ করে বমির উদ্রেক হয়। সতেজ রাখার জন্য মরা মুরগির মাংস, দুধ, মাছ, মাংসেও ফরমালিন, সালফার ডাই অক্সাইড ব্যবহার করা হচ্ছে অহরহ।

সাধারণ যে সব খাদ্যদ্রব্য সহজে পচে যায় কিংবা খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায় এ সব খাদ্যদ্রব্য যাতে না পচে কিংবা খাওয়ার অযোগ্য না হয় সে লক্ষ্যেই সেগুলোকে ফ্রিজে রাখা হয়। ফলে দেখা যায় যে, ফ্রিজে রাখা এসব পচনশীল খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘদিন ভালো থাকে। নষ্ট হয় না। যেমন, মাছ, মিষ্টি, পায়েস, সেমাই কিংবা পিঠা বাইরে রাখলে একদিনেই পচে খাবার অযোগ্য হয় কিন্তু সেই মাছ, মিষ্টি, পায়েস, সেমাই কিংবা পিঠা ফ্রিজে রাখলে ১০ দিন ২০ দিন এমনকি তারও অধিক সময় ভালো থাকে। অর্থাৎ পচে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন এই ভালো আসলে ভালো নয়। এগুলো প্রকৃত অর্থেই পচা খাবার।

বলা হয়েছে, পচনশীল খাবার একদিনের বেশি সময় রেফ্রিজারেটরে রাখা হলেই তা জীবাণু আক্রান্ত হবে। এতে বলা হয়, ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়া। উন্নত এবং অনুন্নত ও নোংরা উভয় পরিবেশেই সানমোনেনা মিউরিয়াম, ব্যাসিলাস চিরিয়াম, সেইফাইনে কককাস ও রিয়াম, ক্লসট্রিডিয়াম, ব্রটনিনাশ ইত্যাকার জীবাণু আক্রান্ত হয়।

এর মধ্যে সানমোনেনা ও মিউরিয়াম এ দুটি জীবাণু খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য সরাসরি দায়ী। বাকিগুলো জৈব ক্রিয়ার জন্য সৃষ্ট বিষাক্ত পদার্থের (টক্সিন) মাধ্যমে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে থাকে।

এখানে যেসব টক্সিনের কথা উল্লেখ করা হলো সবগুলোই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তবে বুটুলিনগি টক্সিন ব্রেনের জন্য বেশি ক্ষতিকর। তা প্রধান উপসর্গের মধ্যে ঢোক গিলতে অসুবিধা হওয়া, এক বস্তুকে চোখে দ্ইু বস্তু দেখা, চোখ ঝাপসা মনে হওয়া, পেশীর দুর্বলতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য টক্সিনের কারণে প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে। ফ্রিজের কোনো খাবারের কিছু অংশ খেয়ে বাকি অংশ পরের দিন খাবার জন্য রেখে দেওয়াও যে অস্বাস্থ্যকর সে বিষয়েও নিশ্চিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে ভেজালকারীরা সতেজ খাবার জন্য মরা মুরগির মাংস, দুধ, মাছ, মাংসেও ফরমালিন, সালফার ডাই অক্সাইড ব্যবহার করছে অহরহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ। তারা বুঝে-শুনে নির্দ্বিধায় বিস্কুট, ব্রেড, টোস্ট, কেক, বনরুটি এবং মুড়ি এগুলো ফুলানো-ফাঁপানোর জন্য ইউরিয়া সার ব্যবহার করে যার মধ্যে এমোনিয়া থাকে। যে উপাদান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কলা থেকে শুরু করে সব ধরনের ফল কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হয়। অনুমোদিত পানির বোতল, রাস্তার ধারের রেস্তোরাঁগুলোতে বিভিন্ন রং মেশানো খোলা খাবার যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফেরিওয়ালারা রাস্তাঘাটে গাড়িতে এবং বিভিন্ন জনবহুল স্থানে অননুমোদিত চানাচুর-মুড়ির এবং বাদাম প্যাকেট ফেরি করে হরহামেশা বিক্রি করে যার পুরোটাই ভেজাল। এরা মোবাইল কোর্টের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এরাও খাদ্যে বিষ ছড়াচ্ছে। এসব জনস্বাস্থ্যের হুমকিস্বরূপ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়া বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। তাদের বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ লোপ পাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী এসব রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি গ্রহণে মানবদেহে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে মানুষের দেহে মারাত্মক ও জটিল রোগের সৃষ্টি করে। ফলে মানুষের কিডনি ও লিভারকে অকেজো করে দেয়। হেপাটাইসিস, টাইফয়েড, আমাশায়, প্যারালাইসিস এবং ক্যানসারসহ নানাবিধ জটিল রোগের সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় যে, প্রতিদিন রাজধানীর হাসপাতালে বিপুলসংখ্যক শিশু হাত-পা ও মুখ ফোলা ও পেটে পানি ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। কিছুদিন পূর্বেও চিকিৎসায় এসব রোগী সুস্থ হয়ে ফিরে যেতো। বর্তমানে বিদেশি ওষুধ দিয়েও এসব রোগী সহজে সুস্থ হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবদেহে ওষুধের কার্যকারিতাও নষ্ট হচ্ছে। ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের টক্সিন মানবদেহে অক্ষত থেকে যায় এবং ধীরে ধীরে কিডনি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট করে ফেলে। নীরবে এ কিডনি ধ্বংসের জন্য ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারই সিংহভাগ দায়ী। ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের আর্সেনিক, লেড, মার্কারি, গোল্ড ও কপারের মতো পদার্থ মানুষের রক্তে মিশে যায়। কিডনি ফিলটার করে আবর্জনা, কিন্তু এসব বিষাক্ত পদার্থ থেকেই যায়। আর এগুলোই কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আঘাত করে।

শিশুদের কাছে অধিকতর পছন্দনীয় ও লোভনীয় খাদ্যসামগ্রী যেমন চকলেট, বিস্কুট, মিষ্টি, ফলের রস, বেভারিজ, আইসক্রিম, গুঁড়োদুধ এসব কিছুই অতিমুনাফালোভী বিবেকবর্জিত মানুষের চক্রান্তে ভেজাল খাবার বাজারে পরিবেশিত হচ্ছে।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ফলের রসের মধ্যে প্রকৃত ফলের বিন্দুমাত্র নির্যাস নেই। শুধু সুগন্ধি আর সিরাপ দিয়ে এসব জিনিস বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এমনকি ঘি, মাখন, সয়াবিন তেলের গন্ধ নেই খাদ্যসামগ্রীতে। এসবের পরিবর্তে কডওয়েল বহু ব্যবহৃত মবিল ব্যবহৃত হচ্ছে।

আসলে ভেজালের ব্যবসা এতো জেঁকে বসছে যে, সহজে এতো লাভ আর কোথায়? এ লাভের ব্যবসা সহজে কি কেউ ছাড়তে পারে? মানুষ ঠকানোর কারবারে হাত পাকাতে পাকাতে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে। ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর কোনো আইন না থাকায় এসব খাদ্যসন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

ফলত ভেজালবিরোধী অভিযান দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ অতীতে আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায়নি। কালেভদ্রে শোনা যায়। এ উদ্যোগে দৃষ্টিগোচর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মহানগরের বড় বড় অভিজাত রেস্তোরাঁ ও মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে অভিযান চালানো হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর যাবত ভেজালবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে বেশ বড় আকারে। সারা দেশেই এ অভিযান চলছে। এ অভিযানে পর্যন্ত যেটুকু কাজ করা হয়েছে তার কিছুটা সুফল পাওয়া গেছে, ভালো প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। এ কথা সত্য যে, অভিযান ব্যাপক করা যাচ্ছে না, লোকবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে ভেজাল কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমেছে বলা যাবে না। তারপরও অভিযান দেশব্যাপী যে সাড়া জাগিয়েছে তা একটি ইতিবাচক দিক। অন্তত ভেজালকারীদের টনক নড়েছে- অন্যদিকে সচেতন হয়েছে জনগণ।

এখানেই শেষ নয়, এ অভিযানের ফলে ভেজাল ও নিম্নমান খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রি রোধে ‘বাংলাদেশে পিওর ফুড (সংশোধন) বিল ২০০৫’ সংসদে পাস হয়েছে। এতে ভেজাল খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রি করলেই সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদ- ও সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ভেজাল রোধে কর্তব্যরত ব্যক্তিকে বাধা প্রদান করা হলে তিন লাখ টাকা জরিমানাসহ তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে।

খাদ্যদ্রব্য ভেজাল বা নিম্নমানের খাবার উৎপাদন ও বিক্রির মতো জঘন্য অপরাধের তুলনায় এ শাস্তি খুব কঠোর কিছু নয়। সামান্য জরিমানা দিয়ে যদি পার পাওয়া যায় তবে তারা পরিবেশ উন্নত করার উদ্যোগ নেবে কেন? খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশিয়ে ও নোংরা পরিবেশে আজেবাজে খাবার বিক্রি করে তারা যে মুনাফা আয় করে, সে তুলনায় এ জরিমানা খুবই সামান্য।

বর্তমানে পরিচালিত ভেজালবিরোধী অভিযান ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ভেজাল দূর হবে না- তবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হতে পারে মাত্র। ভেজালের মূলোৎপাটনে আরো পরিকল্পিত উপায়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভেজাল রোধে শুধু আইনই যথেষ্ট নয়, ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক: রিশিত খান (জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী)