Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাংলাদেশের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে

wb‘অতিদারিদ্র্য বিমোচনের দিক থেকে বাংলাদেশের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এমন নিত্যনতুন  পদক্ষেপ।’ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উপলক্ষে এক গণবক্তৃতায় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম গতকাল এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রতি বছর ১৭ অক্টোবরকে ‘এন্ড ওয়ার্ল্ড পভার্টি ডে’ বা বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিশ্বব্যাংক। দিবসের কর্মসূচিতে প্রতি বছর দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য অর্জনকারী একটি দেশকে ‘শোকেস’ হিসেবে বেছে নেয়া হয়। ওই দেশেই দিবসের মূল কর্মসূচি পালন করে বিশ্বব্যাংক। এ বছর ‘শোকেস কান্ট্রি’ হিসেবে বেছে নেয়া হয় বাংলাদেশকে। এর আগে গত বছর  ঘানায় এ কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। সেখানেও গণবক্তৃতা দিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম।

chardike-ad

বক্তৃতায় বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমাদের সর্বশেষ বৈশ্বিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে গোটা পৃথিবীতে দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্টের চেয়ে কম আয়ের মানুষ ছিল ৮০ কোটি। অর্থাত্ এ সময় ২০১২ সালের তুলনায় বিশ্বব্যাপী অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১০ কোটি। বর্তমানে পৃথিবীর অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে অর্ধেকই বাস করেন সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোয়। বাকি অর্ধেকের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা।’

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে জিম ইয়ং কিম বলেন, ‘দেশটির অনেক মানুষ এখনো খুবই অল্প আয়ে জীবনধারণ করছেন। কিন্তু নাটকীয়ভাবে অতিদারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনায় বাংলাদেশের সাফল্য আমাদের আশা দেয়, এ অগ্রযাত্রা সামনের দিনগুলোয়ও অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে বিশ্বের অন্য দেশগুলোও দারিদ্র্য বিমোচনে একই রকম সফলতা দেখাবে।’

দেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘অতিদারিদ্র্য বিমোচনে নারীর ক্ষমতায়নের ভূমিকা বাংলাদেশ কয়েক দশক আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিল। আপনাদের নেতারা খুব ভালোভাবেই এ যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, জনসংখ্যার অর্ধেকাংশের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে কোনো দেশই তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে না।’

তিনি বলেন, ‘১৯৮০ সালে একটি জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি হাতে নেয় বাংলাদেশ। ওই সময়ে একদল নারী স্বাস্থ্যকর্মী দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বাড়ির মহিলাদের জন্মনিরোধক বিতরণ শুরু করে। এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নাটকীয়ভাবে কমে আসে। এ জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন হয়ে ওঠে উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সহায়ক। এর পর ’৯০-এর দশকে মাধ্যমিক স্কুলগুলোর ছাত্রীদের বৃত্তি দেয়া শুরু করে বাংলাদেশ, যা গোটা পৃথিবীর প্রথম দিককার শর্তসাপেক্ষ নগদ বিতরণ কর্মসূচির অন্যতম।’

এসব উদ্ভাবনী কর্মসূচি নারীর ক্ষমতায়নে কার্যকরভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছে উল্লেখ করে জিম ইয়ং কিম বলেন, ওই সময়ে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার ছিল পৃথিবীর নিম্নতম দেশগুলোর অন্যতম। বর্তমানে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি এবং ভারতের সমপর্যায়ের।

এ সময় বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে বড় এনজিও ও বেসরকারি খাতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে জিম ইয়ং কিম বলেন, ‘ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকসহ বড় এনজিও ও বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণ, নারীর মালিকানায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়সহ নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে সহায়তার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রেখেছে।’

তিনি বলেন, ‘অন্য অনেক দেশের মতো বহু বছর আগেই বাংলাদেশ অনুধাবন করতে পেরেছিল, জনগণের স্বার্থে বিনিয়োগের বিষয়টি তথাকথিত বৃহত্ অবকাঠামোগত উন্নয়নের পেছনে ব্যয় করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিনিয়োগের মাধ্যমেই একটি শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, যারা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে সক্ষম করে তুলেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের বিষয়টি অনস্বীকার্য। এ কারণেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা গেছে। বেড়েছে স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা। শিশুদের টিকাদানের হারও বেড়েছে। একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থারও ব্যবহার বেড়েছে। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নারী কর্মসংস্থানের সংখ্যা ৭০ লাখ থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করছেন ৪০ লাখ নারী, যার অধিকাংশই এসেছেন গ্রামীণ অঞ্চল থেকে। চীন থেকে আরো সুলভ স্থানে শিল্প স্থানান্তরের কারণে এ সংখ্যা আরো বাড়বে।’

অর্থনৈতিক অর্জন ও জনশক্তিতে বিনিয়োগের পথে বাংলাদেশকে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে মন্তব্য করে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘বাংলাদেশকে সব সময় ভয়ঙ্কর সাইক্লোনের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। কিন্তু সর্বসাধারণের অংশীদারিত্বে পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা, সাইক্লোন শেল্টার, নিরাপদ স্থানান্তর পরিকল্পনা, উপকূলীয় বাঁধ ও বনায়ন কর্মসূচির প্রয়োগে এরই মধ্যে জলবায়ুগত হুমকির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ।’

তিনি আরো বলেন, ‘অতিদারিদ্র্য নির্মূল প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মৌলিক অনেক বিষয় সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে পেরেছে বাংলাদেশ। ২০০৬ সাল থেকে দেশটির অর্থনীতি স্থিতিশীলভাবে প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বেড়েছে।  চলতি মাসের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ বাংলাদেশী। ১৯৯১ সালের ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে দারিদ্র্যের হার ২০০০ সালে নেমে এসেছিল ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে। গৃহস্থালি পর্যায়ের এক জরিপে দেখা যায়, ২০১০ সালেও বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ।

২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ওঠার পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে অতিদারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখার পাশাপাশি আরো নতুন ও উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও অগ্রগতি বজায় রাখা এবং দুর্নীতি দমনে শক্তিশালী পদক্ষেপসহ গোটা শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন বলে মনে করেন জিম ইয়ং কিম।

শাসনব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি ঘটানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোয় বিশ্বব্যাংকের আগ্রহের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ মোট জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশেরও কম, যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের তুলনায় কম। শাসনব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ ঘটলে একই সঙ্গে অবকাঠামো খাতে আরো কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানির বহুমুখিতা এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার দিকগুলো নিশ্চিত করা যাবে।’

তিনি বলেন, ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিকে আরো গভীরতায় নিয়ে যেতে চাই। সহযোগীদের সহায়তার ভিত্তিতে শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণে ১০০ কোটি ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগে আগ্রহী বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে এখানকার দারিদ্র্য বিমোচন অভিজ্ঞতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে একাধিক দাতানির্ভর একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

সবশেষে তিনি বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতা যে অতিক্রম করা সম্ভব, তা গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। এখানকার জনগণ দেখিয়েছে— উদ্ভাবনী ক্ষমতা, অঙ্গীকারবদ্ধতা, লক্ষ্য নির্ধারণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের মাধ্যমে এমন কৃতিত্ব অর্জন করা যায়, যা খুব কম লোকেই কল্পনা করতে পারে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ এ অগ্রযাত্রা বজায় রাখার পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে অতিদারিদ্র্য বিমোচন ও সমৃদ্ধির আরো জোরদার বণ্টন নিশ্চিত করতে পারবে।’