Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ব্যবসায়িক বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন চ্যানেল মালিকরা

base_1480534637-tv-front-converted

বর্তমানে দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলায় ডাব করা বিদেশী সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমান’। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রচারিত অন্য জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মধ্যেও বেশির ভাগই বিদেশী। জনপ্রিয়তা বেশি হওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারাও ঝুঁকছেন সেদিকেই। ফলে ব্যবসাও বেশি যাচ্ছে এসব অনুষ্ঠান সম্প্রচারকারী টেলিভিশন চ্যানেলে। এ নিয়ে আপত্তি তুলেছে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের একাংশ।

chardike-ad

এছাড়া জনপ্রিয়তার কারণে দেশের টিভি চ্যানেলের বড় বিজ্ঞাপনদাতারাও এখন বিদেশী চ্যানেলমুখী। এতেও ব্যবসা হারাচ্ছে দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো। এ নিয়েও আপত্তি রয়েছে টিভি চ্যানেল মালিকদের অনেকের।

বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া আয়ই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মূল ব্যবসা। অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এএএবি) হিসাবে, দেশে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের বাজার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে এ বাজারের আকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিজ্ঞাপন পেতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে শরণাপন্ন হতে হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষ বিজ্ঞাপনদাতারা এখন বিদেশী চ্যানেল ও অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি। এতে সংকুচিত হচ্ছে দেশীয় চ্যানেল ও অনুষ্ঠানের বাজার।

বিদেশী চ্যানেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন প্রচারের বিরোধিতায় ‘মিডিয়া ইউনিটি’ তৈরি করেছে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের একাংশ। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে নিজেদের জোরালো অবস্থান তুলে ধরে তারা। ওই সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও ৭১ টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোজাম্মেল বাবুর বিরুদ্ধে গতকাল একটি মানহানির মামলা করেছেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর। আর এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের ব্যবসায়িক বিবাদ প্রকাশ্য রূপ পেল।

জানতে চাইলে মোজাম্মেল বাবু বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার কোনো সীমা নেই। প্রতিযোগিতা ও এর তীব্রতা থাকবেই। এর মধ্যেও মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান দিয়ে আমাদের টিকে থাকতে হবে।

দেশের বাইরে বিজ্ঞাপন প্রচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি অবৈধ। অবৈধ কর্মকাণ্ডকে অবৈধ বললে কী করে মানহানি হয়, তা বোধগম্য নয়। তাছাড়া প্রক্রিয়াটি খতিয়ে দেখতে রাজস্ব বোর্ডের তদন্তও চলছে।

দেশীয় ও বহুজাতিক দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনই স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় প্রচার হয়। ক্যাটালিস্টের সমীক্ষা ও বাজার সূত্র অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার হয় বহুজাতিক ভোগ্যপণ্য ও সেবার। প্রথম ১০ বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষস্থানটি দখলে রেখেছে ইউনিলিভার। মোট বিজ্ঞাপনের ৩৩ শতাংশ এ প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া বিজ্ঞাপনদাতা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্কয়ার, কোহিনূর, পারটেক্স, প্রাণ-আরএফএল, ট্রান্সকম, মেঘনা, আবুল খায়ের, এস আলম ও আকিজ গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সমন্বিতভাবে মোট বিজ্ঞাপনের ৫৬ শতাংশ। পিক টাইমে প্রচারিত এসব বিজ্ঞাপনই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আয়ের মূল উত্স।

বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মূলত এসব বিজ্ঞাপন পায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। দেশে বিজ্ঞাপন সংস্থা রয়েছে প্রায় ৫০০টি। শীর্ষ বিজ্ঞাপন সংস্থার মধ্যে আছে এশিয়াটিক এমসিএল, অ্যাডকম লি., গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ লি., ইন্টারস্পিড, বিটপি অ্যাডভার্টাইজিং, মাত্রা, ইউনিট্রেন্ড লি., ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লি., এক্সপ্রেশনস ও বিন্দু।

বিদেশী অনুষ্ঠান ও টেলিভিশন চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপনদাতাদের বিজ্ঞাপন ্প্রচার নিয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ রয়েছে তাদেরও। এএএবির সভাপতি রামেন্দু মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রক্রিয়াটি অবশ্যই আইনসম্মত হতে হবে, যাতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ রোধ করা যায়। সেজন্য নজরদারিও যথাযথ হতে হবে। বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলো মূলত হুজুগে চালু হয়েছে। হাতেগোনা চার-পাঁচটি ছাড়া কেউ ব্যবসাসফল নয়। তার পরও চ্যানেল আসছে। এতে এটাই প্রমাণ হয় যে, ব্যবসা ছাড়াও অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বেসরকারি টিভি চ্যানেল চালু করা হচ্ছে।

১৯৯৭ সালে এটিএন বাংলার মাধ্যমে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ব্যবসার যাত্রা হয়। খাতটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় একুশে টিভির হাত ধরে। এরপর গত প্রায় দুই দশকে আরো অনেক বেসরকারি চ্যানেল সম্প্রচারে এসেছে। বর্তমানে অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে ৪৩টি। এর মধ্যে সম্প্রচারে আছে ২৬টি। সম্প্রচারের অপেক্ষায় আছে আরো ১৩টি চ্যানেল।

সীমক্ষা অনুযায়ী, টেলিভিশন দর্শক প্রতি বছর ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর এ দর্শক আকৃষ্ট করতে নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন অনুষ্ঠানের দিকেও ঝুঁকছেন চ্যানেল মালিকরা। অনুষ্ঠানের মানোন্নয়ন না ঘটিয়ে উল্টো বাজার দখলের মানহীন প্রতিযোগিতায়ই বেশি মনোযোগী তারা। এতে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন দেশীয় অনুষ্ঠান নির্মাতারা।

বিজ্ঞাপনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিচে নামাটা মোটেই কাম্য নয় বলে মনে করেন আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক রহমান। তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করলে আমাদেরই ক্ষতি। আর যারা সিনিয়র, তাদের কাছ থেকেই সবার শেখার কথা। কিন্তু তারাই যদি আজ এমন করেন, তবে এ সেক্টরের জুনিয়ররা কী শিখবেন? আমি মনে করি, নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো একসঙ্গে বসেই সমাধান করা উচিত। বিজ্ঞাপনের বাজার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। তবে বাজার দখলের জন্য বিজ্ঞাপনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নীতি বিসর্জন দেয়া মোটেও কাম্য নয়। অনুষ্ঠান প্রচারের মান বাড়িয়ে দর্শক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারলে বিজ্ঞাপনদাতারা এমনিতেই বিজ্ঞাপন দেবেন।

বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মান পড়ে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবারই দায় রয়েছে বলে মনে করেন চ্যানেল নাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিদেশী চ্যানেল বাংলাদেশে প্রচার হচ্ছে হোক। কিন্তু একই সুযোগ সহজ শর্তে আমাদেরও পাওয়া দরকার। যেকোনো পরিস্থিতিতেই অসুস্থ পরিবেশ কাম্য নয়।

এদিকে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে বিদেশী সিরিয়াল দেখানো বন্ধের দাবি তুলেছেন বাংলাদেশের নাট্যশিল্পীরা। গতকাল রাজধানীতে বিদেশী টিভি সিরিয়ালের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সমাবেশে তারা বলেন, বিদেশী টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে চলেছে। বণিকবার্তার সৌজন্যে।