Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ট্রাম্পের দাজ্জালিপনা ও বিশ্বায়নকে ধর্ষণ

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর মনে হচ্ছে তিনি তাঁর সব নির্বাচনী ওয়াদা যে কোন মূল্যে পালন করবেন। এতে তিনি পাহাড়কেও বাধা হিসাবে মানতে নারাজ। শত বাধা-বিপত্তির পরও বৈশ্বয়িক নিরাপত্তা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোকে তিনি মানতে চাচ্ছেন না। বিশ্বায়নের উল্টো পথে হেঁটে তিনি এমন এক আমেরিকা গড়তে চান যেখানে সর্বাগ্রে খৃষ্টান শ্বেতাঙ্গরা বিশেষ মর্যাদা পাবে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে যে ভাগ্যান্বেষী অভিবাসীরা মিলেমিশে মার্কিন জাতিকে বিশ্বের চালকের আসনে পৌঁছে দিয়েছে তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতে চায় ট্রাম্প। নিজের ধ্যান-ধারণাগুলো প্রতিষ্টা করার জন্য মার্কিন প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোকেও মোকাবেলা করতে ট্রাম্প শতভাগ প্রস্তুত। ক্ষমতার ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ বলতে কিছু থাকছে না। তিন হাউস ট্রাম্পের হাতে রয়েছে, সেই সাথে আগামীতে নতুন তিন বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টও তাঁর হস্তগত হবে।
rahat

ইসলামে বর্নিত কিয়ামতের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হল দাজ্জালের আবির্ভাব। এক চোখা দাজ্জাল তার ক্রিয়া-কলাপ দ্বারা তামাম বিশ্বের মানুষের চিন্তাচেতনাকে ওলট-পালট করে দিবে। যুক্তরাষ্ট্রের শত বছরের মূল্যবোধ বিরোধী আগ্রাসী ট্রাম্পকে বলা চলে আসল দাজ্জালের প্রতিচ্ছবি। দাজ্জালি চরিত্রের জন্য তিনি বিশ্বময় বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ব্যক্তি যার রাজনৈতিক উত্থানকে রাজনৈতিক ভূমিকম্পের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামরিক পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১৬ জন বাঘা বাঘা প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন পাওয়াটাই ছিল বিস্ময়কর। নারী ও মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য, অভিবাসন, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ট্রাম্পের পাগল-প্রলাভ দেখে সবার ধারণা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন হিলারী ক্লিনটন। মার্কিন মিডিয়াগুলোও হিলারীর জয়ের (৮০-৯০)% সম্ভবনার ইঙ্গিত দেয়। পূর্বাভাস ও জরিপ ভুল প্রমাণ করে ট্রাম্পের ভূমিধস বিজয়ের ফলে বরং মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

chardike-ad

দাজ্জালের অনুসারীদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী থাকবে ইহুদীরা। এখন দেখা যাচ্ছে ইজরাইলের সাথে ট্রাম্পের সম্পর্ক সবচেয়ে মজবুত হতে চলছে। ইহুদীর মত তিনিও মনে করেন সাদারা ঈশ্বরের মনোনীত। ফিলিস্তিনে ইজরাইলি বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিশরের প্রস্তাবকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল ট্রাম্প। যদিও ওবামা প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপে আবার এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ভোট প্রদানে বিরত থাকায় প্রস্তাবটি সহজে পাশ হয়। এরপরেও ট্রাম্প জোর গলায় বলছে, তিনি ইজরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে আসবেন। এইদিকে ইজরাইলি মন্ত্রীসভা ট্রাম্পের সমর্থন পেয়ে জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনে আবার বসতি নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।

ট্রাম্পের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কেউ হিসাব মেলাতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কথা বললেও বিশ্লেষকদের ধারণা মুক্তবাজার নীতি থেকে সরে এসে রক্ষণশীল অর্থনীতি প্রণয়ন করলে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের নিজের দেশই ক্ষতিগ্রস্থ হবে বেশী। বিশ্বময় যুক্তরাষ্ট্র ইমেজ সংকটে পড়বে, সেই সাথে মার্কিন আধিপত্য আরো কমবে। অনেকে ট্রাম্পের স্লোগান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন যুক্তরাষ্ট্র এখনো মহান জাতি হিসাবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত আছে। যে বিশ্বায়ন তাদেরকে মহান করেছে ট্রাম্প সেই বিশ্বায়নকে এখন ধর্ষণ করতে উদ্যত। তাই তিনি অমেরিকাকে “আবার মহান করা” বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা কারো কাছে বোধগম্য নয়। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে আমেরিকার পতন শুরু হয়েছে। আর ট্রাম্পের বিশ্বায়ন বিরোধী কট্টর নীতি সেই পতনকে তরান্বিত করবে।

ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমদিনেই বাতিল করে দেন ওবামাকেয়ার। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ম আয়ের ২ কোটিরও বেশী মানুষ এই স্বল্প মূল্যের স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা পেয়ে আসছিল। যে নিম্ম আয়ের মনে আশার সঞ্চার করে ট্রাম্প দৈত্যের মত ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হলেন, তাদের স্বার্থে প্রথম আঘাত হানা হল। অনেকে মনে করছেন স্বাস্থ্য ঘাতের মাফিয়াদের স্বার্থে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ। এমনও হতে পারে ওবামার নাম ওবামাকেয়ারের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্প চান না কৃষ্ণাঙ্গ কোন প্রেসিডেন্টের নাম আমেরিকায় স্বরনীয় হয়ে থাকুক।

nafta
নাফটার ভবিষ্যত এখন অনেকটাই অনিশ্চিত

ট্রাম্পের সবচেয়ে আলোচিত নির্বাচনী এজেন্ডা ছিল চীনকে ঠেকানো। ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারসীপ(টিপিপি) হতে পারত চীনকে কন্টেইন করার অন্যতম কার্যকরী উপায়। এতে করে চীনের উপর বিভিন্ন দেশের নির্ভরশীলতা কমে আসতো, মার্কিন বিনিয়োগও চীন থেকে সরিয়ে নেওয়া যেত যা চীনা অর্থনীতিকে চাপে ফেলত। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে তা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। টিপিপিকে তাঁর দেশকে ধর্ষণের সাথে তুলনা করে বলেছেন “ TPP, a rape of our country”। এইদিকে নর্থ আটলান্টিক ফ্রি ট্রেট এগ্রিমেন্ট(নাফটা) থেকেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিতে পারেন। ট্রাম্পের মতে “নাফটা” হল তাঁর দেশের করা সবচেয়ে ক্ষতিকর বানিজ্য চুক্তি যার ফলে চাকরির বাজার প্রতিবেশী মেক্সিকোতে চলে যাচ্ছে। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও জাতিসংঘের মত প্রতিষ্টানে যুক্তরাষ্ট্র চাঁদা দেওয়া কমিয়ে আনবে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায়ও ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন না করার কথা জোর গলায় বলছেন। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশকে দেওয়া সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিবেন। তাঁর ধারণা এই সবের মাধ্যমে আমেরিকা “নিজের খেয়ে বনের মুষ তাড়ানোর” মত কাজ করে চলছে।

মূলত ট্রাম্প মনে করছেন এই সব বানিজ্য চুক্তির ফলে চাকরির বাজার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমেরিকান কোম্পানিগুলো মুনাফার স্বার্থে বিদেশে বিনিয়োগ করছে। এতে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। তাঁর অভিবাসন বিরোধী অবস্থানের কারণ প্রধানত দুইটি। একটি হল অভিবাসীরা স্বল্প বেতনে চাকরী করায় নেটিভ আমেরিকানরা চাকরী হারাচ্ছেন। অন্যদিকে অভিবাসীদের কারণে আমেরিকান সমাজে দিন দিন শ্বেতাঙ্গদের প্রভাব কমছে। ট্রাম্পের ভয় যুক্তরাষ্ট্র অচিরেই কৃষ্ণাঙ্গ প্রধান দেশে পরিনত হবে। তাই কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসী ঠেকাতে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলার পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। অথচ ট্রাম্প নিজে একজন অভিবাসী পরিবারের সন্তান। মূলত অভিবাসীর নামে কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধ করাই তাঁর লক্ষ্য।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে

কট্টর খৃষ্টান ডানপন্থী হিসাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ট্রাম্পকে ব্যাথিত করেছে। তালেবান, আলকায়দা, ও হাল আমলের অপ্রতিরোধ্য আইএসকে পশ্চিমা সভ্যতার জন্য হুমকি মনে করেন।  তাই মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে নিজ দেশে অভিবাসী হয়ে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করবে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হতে পারে সন্ত্রাসের নামে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আবার ধর্ম যুদ্ধ। সম্ভবত, এই কারণে ইজরাইল ও রাশিয়ার সাথে ট্রাম্প বিশেষ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে কার্যকরী যুদ্ধ করতে ট্রাম্প মনে করে রাশিয়া ও ইজরাইল তাঁর সবচেয়ে ভাল সঙ্গী হবে। তাই ইজরাইলের স্বার্থে ইরানের সাথে করা পারমানবিক চুক্তি বাতিল করতে চান তিনি।

রাশিয়ার সাথে ভাল সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে কিছু দিতে পারবে না, উল্টো রাশিয়া সর্বক্ষেত্রে লাভবান হবে, এরপরও ব্যবসায়ী ট্রাম্প কেন পুতিনের সাথে ভাল সম্পর্ক চাইবে? রাশিয়ার প্রভাব মোকাবেলায় পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোকে কাগুজে বাঘে পরিনত করবে ট্রাম্প। এদিকে পুতিন ট্রাম্পকে দাবার গুটির মত ব্যবহার করার জন্য এক পা খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠলে ওবামা প্রশাসন রাশিয়ার কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে, কিন্তু পাল্টা কোন পদক্ষেপ পুতিন গ্রহণ করেননি।

ট্রাম্প নির্দিষ্ট মিশন ও ভিশন নিয়ে  ধুমকেতুর মত আবির্ভুত হয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত নীতি-মূল্যবোধ বিরোধী মিশন ও ভিশন নিয়ে খেলার পূর্ণ শক্তি সমর্থনও তিনি লাভ করেছেন।যার কারণে নানা শঙ্কা সর্বত্র বিরাজ করছে। তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ হচ্ছে সারা বিশ্বে। ট্রাম্প তাঁর বিরুদ্ধে কোন ধরণের সমালোচনাকে কানে তুলছেন না। ট্রাম্পের বিশ্ব মানব সভ্যতার জন্য আশির্বাদ না অভিশাপ হবে তা কেবল সময় নির্ধারণ করে দিতে পারে। শুধু এতটুকু অনুমান করা যায় বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে ট্রাম্পের ঝাকুনির প্রভাব সব দেশেই পড়বে।