Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মালয়েশিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় শ্রমিকরা

malaysiaমালয়েশিয়ার কেলাংয়ের কাপার বাতু লিমার মিনহু ফ্যাক্টরি এলাকায় থাকেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ইব্রাহিম মানিক। ২০০৮ সালের প্রথমদিকে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়া আসেন তিনি। ভিসার মেয়াদ শেষে বর্তমানে তিনি অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছেন।

ইব্রাহিম মানিক বৈধতা নিতে ভিসার জন্য পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে যোগাযোগ করেন টাঙ্গাইলের মাসুদের সঙ্গে। মাসুদও মালয়েশিয়ায় একই এলাকায় থাকেন দীর্ঘদিন ধরে। গত শুক্রবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইব্রাহিম মানিক জানান, ভিসা করে দেয়ার জন্য মাসুদকে দুই দফায় ১০ হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুই লাখ টাকা) দিয়েছেন তিনি। পাঁচ হাজার দেন ২০১৫ সালের অক্টোবরে আর বাকি রিঙ্গিত গত বছর।

chardike-ad

ইব্রাহিম মানিকের অভিযোগ, এত টাকা দেয়া হলেও মাসুদ তাকে ভিসা করে দেননি। প্রথম দফায় পাসপোর্টে একটি ভিসা লাগিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু অনলাইনে চেক করতে গেলে জানা যায় তা ভুয়া। পরেরবার আমার ছবির পরিবর্তে পাসপোর্টে অন্যের ছবিযুক্ত ভুয়া ভিসা লাগিয়ে দেন মাসুদ। প্রতারণার বিষয়টি জানতে চাইলে উল্টো জীবননাশের হুমকি দেয়া হয়- বলেন ইব্রাহিম মানিক।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে একটি গ্লাস কোম্পানিতে কাজ করছি। অবৈধ হওয়ায় সচরাচর বাইরে বের হতে পারি না। যেখানে কাজ করি সেখানেই রাত কাটাই।

কেলাংয়ের কাপার বাতু লিমার মিনহু ফ্যাক্টরি এলাকায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা জানান, মাসুদ এক সময় কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়ায় আসেন। বর্তমানে তিনি কোনো কাজ করেন না। ইব্রাহিম মানিকের মতো অনেক শ্রমিকের কাছ থেকে ভিসা করিয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন তিনি। ওই এলাকায় ভারতীয়দের সমন্বয়ে তার একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও তার বেশ সখ্য রয়েছে।

তারা আরও জানান, বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করাই তাদের কাজ। এছাড়া অবৈধ হুন্ডি ব্যবসাও রয়েছে তাদের। প্রবাসীকর্মীরা তাদের মাধ্যমে নানাভাবে নির্যাতিত হলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না।

malaysiaসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রি-হায়ারিংয়ের নামে অবৈধদের বৈধ হওয়ার ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া সরকার। এর আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিক রেজিস্ট্রেশন করেন।

রি-হায়ারিংয়ের আওতায় প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি ভিসা পেয়েছেন। বাকি দুই লাখ ৭০ হাজার অবৈধ শ্রমিক এখনও ভিসা পাননি। তবে এ রি-হায়ারিং প্রোগ্রাম চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে বলে জানা গেছে।

মালয়েশিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় হয়ে পড়েছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। অবৈধ কর্মীদের বৈধ করতে মালয়েশিয়া সরকারের চালু করা বিশেষ প্রোগ্রাম ঘিরে গড়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের শক্তিশালী একটি চক্র।

শুধু তাই নয়, শর্তের জালে আটকা পড়েছেন মালয়েশিয়ায় বৈধতার চেষ্টায় থাকা অবৈধরা। বাংলাদেশিদের জন্য দুটি বিকল্প শর্ত দেয়া হয়েছে। প্রথমত, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান রি-হায়ারিং বা পুনর্নিয়োগের সুযোগ নেয়া। দ্বিতীয়ত, থ্রি প্লাস ওয়ান অর্থাৎ ভেলিড ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ, জরিমানা ও দেশে ফেরত।

পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, প্রথম শর্ত অর্থাৎ রি-হায়ারিংয়ের সুযোগই নিতে চান বাংলাদেশিরা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এ সুযোগ কাজে লাগাতে সেদেশের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ সরকার।

এদিকে বৈধ হতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে দালালদের খপ্পরে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কাগজপত্রহীন বাংলাদেশিরা। রি-হায়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাসপোর্টসহ টাকা-পয়সা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেকে। আবার যারা রি-হায়ারিংয়ে অংশ নিয়েছেন তাদের অনেকেরই এখনও ভিসা না মেলায় গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন।

মালয়েশিয়ায় সব অবৈধ অভিবাসীর বৈধ হওয়ার মেয়াদ এ বছরের শেষ পর্যন্ত বাড়ানোর পর সুযোগটি কাজে লাগাতে মরিয়া বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অবৈধ শ্রমিকরা। মালয়েশীয় সরকার বৈধ হওয়ার সুযোগ দিলেও রি-হায়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে নির্ধারিত শর্ত বেঁধে দেয়ায় বিপাকে পড়ার কথা জানান কাগজপত্রহীন অবৈধ বাংলাদেশিরা। অবৈধরা বৈধতা পেতে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনিক জোরালো পদক্ষেপ চান প্রবাসী কমিউনিটির নেতারা।

মালয়েশিয়া শ্রমিক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহ আলম হাওলাদার অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার জন্য নিয়োগকর্তা ও কর্মরত প্রতিষ্ঠানসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দায়ী করেছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেকেই দালালদের খপ্পরে পড়ে পাসপোর্টসহ টাকা-পয়সা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ রি-হায়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার এক বছরেও হাতে পাননি ভিসা।

‘যারা মাই-ইজির মাধ্যমে লেভি পরিশোধ করেও ভিসা পাচ্ছেন না সে বিষয়ে দূতাবাস কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে- এটি আমাদের প্রশ্ন। জাতীয় নেতা-প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সভা-সেমিনারে বলেন প্রবাসীরা হচ্ছেন গোল্ডেন বয়। কিন্তু গোল্ডেন বয়রা যে ধাপে ধাপে বিপদগ্রস্ত সেদিকে সরকার তথা সমাজপতিদের কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই’- যোগ করেন তিনি।

সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দুটি প্রোগ্রাম চালু করে। একটি রি-হায়ারিং অন্যটি ই-কার্ড প্রোগ্রাম। এ দুটি প্রোগ্রামের মধ্যে বিনামূল্যের ই-কার্ড প্রোগ্রামেও এক হাজার রিঙ্গিত জমা দিয়ে আবেদন করে বৈধতা নিতে হয়। যদিও এর আওতায় বৈধ হওয়ার সুযোগ ছিল না। সরকার কয়েকটি ক্রাইটেরিয়ার মাধ্যমে বৈধকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। ই-কার্ডের আওতায় প্রায় এক লাখ অবৈধ শ্রমিক নিবন্ধিত হন। এ কার্ডের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পাদন করে ভিসা নিতে হবে।

অভিযোগ উঠেছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা বৈধ করে দেবার নামে বাংলাদেশি কর্মীদের কাছে থেকে অর্থ নিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা তা করতে পারেননি। এজন্য অর্থের যে লেনদেন হয়েছিল তাও ফেরত দিচ্ছেন না তারা। উল্টো তাদের পুলিশের ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে এ চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন অনেক বাংলাদেশি।

ভুক্তভোগী শ্রমিকরা জানান, এ সুযোগে মালিকপক্ষ অবৈধ শ্রমিকদের দিয়ে অর্ধেক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাস শেষে নিজেদের খেয়েপরে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়ছে। অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক জানান, ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি মধ্যস্বত্বভোগী দেশটিতে কর্মী কিনছেন এবং বিক্রি করছেন। তারা যে যেভাবে পারেন সেভাবেই কর্মীদের শোষণ করছেন। কখনও হাইকমিশনের নামে, কখনও পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে দেয়ার নামে, আবার কখনও বৈধ করে দেয়ার নামে তাদের শোষণ প্রক্রিয়া চলছে।

তিনি জানান, সাধারণ কর্মীরা বাধ্য হচ্ছেন এ চক্রের কথা মতো চলতে। বৈধ হওয়ার আবেদন করতে সরকারিভাবে ১২শ’ রিঙ্গিত জমা দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিকরা অনেকেই মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিরাও বাংলাদেশের নাগরিক। তারাও একদিন কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়ায় আসেন। দীর্ঘদিন দেশটিতে বসবাস করে স্থানীয়দের সঙ্গে তারা ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এমনকি পুলিশের সঙ্গেও তাদের বেশ যোগাযোগ রয়েছে।

মালয়েশিয়ায় প্রচুর বিদেশিকর্মী বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করছেন। দেশটিতে কর্মরত বিদেশিদের ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার, ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ নেপালের, ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ বাংলাদেশের, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ মিয়ানমারের এবং ভারতের ৫ দশমিক ১ শতাংশ।

এছাড়া ফিলিপাইনের ৩ দশমিক ১, ২ দশমিক ৫ শতাংশ পাকিস্তানের এবং থাইল্যান্ডের রয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যান্য দেশের ৪ শতাংশ শ্রমিক কাজ করছেন মালয়েশিয়ায়।

কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দেন-দরবার করা হচ্ছে। বৈধ হওয়ার সময় চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হলেও দেশটিতে অবৈধ কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চলছে প্রতিনিয়ত। আটকের পর কাউকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আবার অনেককে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

মালয়েশিয়ার পুলিশ আগে ঘুষ খেত না। বাংলাদেশি মধ্যস্বত্বভোগীরাই তাদের ঘুষ খাওয়া শিখিয়েছেন- অভিযোগ করেন তিনি।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম শাখার প্রথম সচিব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সচিব জানান, আমরা চেষ্টা করছি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দিতে। কিন্তু বৈধ হওয়ার আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে। কারণ কেউ হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে চান না।

এর একটাই কারণ। হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে- এমন ভয় আছে অনেকের মধ্যে। অন্য একটি কারণ হলো- বৈধ করার নামে তাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। সবকিছু তাদের ওপর ছেড়ে দেন। পরে যখন সময় শেষ হওয়ার পথে তখন দেখেন মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের বৈধ করতে পারেননি।

‘কাজটা নিজের। এখানে কোনো মিডিলম্যান দিয়ে কাজ করা যাবে না। কর্মীরা হাইকমিশনে এসে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে আবেদন করবেন। এরপরই কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে বৈধ হবেন। বার বার এ আহ্বান জানানোর পরও যদি মিডিলম্যানের দ্বারস্থ হন, তাহলে কী করার আছে? মিশন সবসময় শ্রমিকবান্ধব- যোগ করেন তিনি।

নরসিংদীর আহমদ আলী জানান, গত বছর বৈধ হওয়ায় জন্য এক কোম্পানির মাধ্যমে রি-হায়রিং সম্পন্ন করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভিসা পাচ্ছেন না। কোম্পানিতে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ইমিগ্রেশন ভিসা দিচ্ছে না, অপেক্ষা করতে হবে।

এখন পর্যন্ত ছয়বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন আহমদ আলী। বৈধ ডকুমেন্ট থাকার পরও হাজতে তিনদিন থাকতে হয়েছে। তিনদিন পর কোম্পানির মালিক ছাড়িয়ে আনেন, তাও এক হাজার টাকার বিনিময়ে- অভিযোগ করেন তিনি। জাগো নিউজ