Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিদেশে হারানো পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার গল্প

লেখক১৬ ডিসেম্বর, ঢাকা থেকে ব্যাংকক, তাইপে হয়ে ইনছন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের থাই এয়ারওয়েজ অবতরণ করে ১৪ ঘণ্টার পর। বিমানবন্দরে আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য ২ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় আছেন হাবিল ভাই তথা হাবিল উদ্দীন। তিনি বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন কোরিয়া’র (বিসিকে) সভাপতি এবং ২৬ বছর ধরে কোরিয়া প্রবাসী ব্যবসায়ী।

ইমিগ্রেশন শেষ করতে আমাদের কিছুটা দেরি হতে দেখে সরওয়ার ভাই বারবার ফোন করে খবর নিচ্ছেন। সরওয়ার ভাই বিসিকের সাধারণ সম্পাদক, গুগল কোরিয়ায় সার্চ ভাষা বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত। তিনি ঢাবি পরিবারের একজন সদস্য।incheon

chardike-ad

ঢাকা থেকে থাই এয়ারওয়েজ ২টার বিমান ৩টায় যাত্রা করার বিষয়টি বলা হয়নি সরওয়ার ভাইকে। তার ওপর এদিন ইমিগ্রেশনে খুব চাপ ছিলো।

সফর সঙ্গী মীর লোকমানকে খুব তাড়া দিচ্ছিলাম। দ্রুত যেতে হবে। লোকমান আবার ওয়াশরুমে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ওয়াশরুমে গিয়ে পড়লেন বেগতিক অবস্থায়। কোরিয়ানরা টয়লেট শেষ করে পানি নয়, টিস্যু দিয়ে মুছে নেয়! লোকমান কোরিয়া আসার আগে নানা বিষয় জেনে নিলেও এবিষয়ে তার ধারণা ছিলো না। ফলে তার প্রাকৃতিক কাজ সারতে দেরি হলো।

প্রাকৃতিক কাজ সেরে লোকমান আসলেন। দ্রুত ইমিগ্রেশন কার্ড পূরণ করে লাইনে দাঁড়ালাম। এখানে অবশ্য দেরি হলো না। ইমিগ্রেশন অফিসার খুব দ্রুত কাজ করলেন। কোনো কথাই বললেন না। যা বললো কম্পিউটার। বাংলায় বলল, আপনার ফিঙ্গার প্রিন্ট করুন, ব্যস! এটুকুই। এক মিনিট আগেই কাজ শেষ!

ইমিগ্রশেন শেষ করে বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে দ্রুত বের হতে গিয়ে দেখি দ্বিতীয় ইমিগ্রেশন কার্ডটি পূরণ করা হয়নি। পাশের টেবিলে গিয়ে পাসপোর্ট বের করে তথ্য পূরণের পর দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।

হাবিল ভাই এগিয়ে এলেন। এ প্রথম দেখা লোকটির সঙ্গে। ছবিতে যেমন দেখেছিলাম তার থেকে ব্যতিক্রম। এক কথায় অসাধারণ সহযোগী মনোভাবের মানুষ।

ছবি তোলা হলো। কফি পান করলাম। এরপর দ্রুত গাড়িতে উঠে হাবিল ভাই রওনা দিলেন কোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে চলা বিজয় দিবসের উৎসবে।

দূতাবাসে গিয়ে বিজয় উৎসব করলাম কোরিয়ার বাংলাদেশিদের সাথে। আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে রাতের ভোজ হলো। আগতদের সাথে ছবি তোলা হলো। শিশুদের নিয়ে বেশ মজা করলাম। রাত ১০টার দিকে হাবিল ভাই আবারও নিজে ড্রাইভ করে আমাদেরকে নিয়ে চললেন সরওয়ার ভাইয়ের বাসায়।

বাসায় পৌঁছে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। একই দিন কোরিয়ায় এসেছেন সরওয়ার ভাইয়ের সহধর্মিণী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের কোরিয়ান ভাষার শিক্ষক।

সবার সঙ্গে হায়-হ্যালো করার পর পাসপোর্ট তালাশ করতেই দেখি পাসপোর্ট নেই কোথাও। মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছিলো উত্তর কোরিয়ার কিম জং বোমা মেরে মাথার খুলি উড়িয়ে দিচ্ছেন! পাসপোর্ট কোথায় রাখলাম স্মরণ করার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ দূতাবাস, হাবিল ভাইয়ের গাড়ি এবং বিমানবন্দরের একেবারে শেষ মুহূর্তের ইমিগ্রেশন কার্ড পূরণ করেছি যে টেবিল, এ তিনটি জায়গার যে কোনটিতে পাসপোর্ট থাকতে পারে! এটি আমার ধারণা…

সরওয়ার ভাইকে বিষয়টি জানালাম। বললেন, ‘চিন্তা করো না। কোরিয়ায় কিছু হারানোর সুযোগ নেই। পাওয়া যাবে’।

সরওয়ার ভাই হাবিল ভাইকে ফোন করলেন তার গাড়িতে আছে কিনা চেক করতে। কিন্তু রাত প্রায় ৩টায় হাবিল ভাই স্বভাবতই ফোন রিসিভ করতে পারেননি। সরওয়ার ভাই মেসেজ দিয়ে রাখলেন যেন ভোরে উঠলে গাড়িতে চেক করা হয়।

রাজ্যের চিন্তা মাথা ঘুরতে থাকলো। প্রচণ্ড চাপ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম আসে না। যদিও অনেক ক্লান্ত ছিলাম। চেষ্টা করলাম ঘুমানোর।

সকালে উঠে জানতে পারি, গাড়িতে পাসপোর্ট নেই। এরই মধ্যে হাবিল ভাই দূতাবাসে খবর নিলেন, কিন্তু না। পাওয়া গেলো না। একটি মাত্র জায়গা বাকি, এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কার্ড রাখা টেবিলটি!

পাসপোর্ট না পেলে দেশে ফেরা যাবে না। বিকল্প উপায় কি হতে পারে তা জানতে চাইলাম। সরওয়ার ভাই বললেন, দূতাবাসের মাধ্যমে নতুন একটি পাসপোর্ট করতে ১৫ দিন লেগে যাবে।Incheon airport

এদিকে ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে ইনহা ইউনিভার্সিটির হল রুমে বিসিকের বিজয় উৎসব। দুশ্চিন্তা সঙ্গী করেই যাত্রা করলাম ইনছনের ইনহা ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে। ড্রাইভ করছেন সরওয়ার ভাই। কোরিয়ার এই যে অদ্ভুত সুন্দর মহাসড়ক, দুপাশে পাহাড়, পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পথ, ১২০-১৩০ কিমি গতির মহাসড়কের খানিক পরপর অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা, শোভনীয় সব দালান কোন কিছুই তেমন আকৃষ্ট করছে না আমাকে। এমন হাফ-সেন্স মানসিকতা নিয়েই বিসিকের বিজয় উৎসব শেষ করেছি সেদিন।

সব আয়োজন শেষ করে বাসায় ফিরে হাবিল ভাই ফোন করলেন বিমানবন্দরের কল সেন্টারে। আমার নাম ও জন্ম তারিখ জানতে চাইল। বললাম। খবর এলো। পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। ইনছন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের লস্ট এন্ড ফান্ড সেকশনে সংরক্ষিত আছে। দেশে ফেরার সময় দুই ঘণ্টা আগে গিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে….

পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার পর কোরিয়ার রাজধানী সিউলে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ালাম। পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় এ শহরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দেখা হলো। তার মধ্যে সৌভাগ্যের ব্যাপার, সিউলের তুষারপাত দেখা হলো। ছবি তোলা হলো।

১৯ তারিখ দেশের ফ্লাইট। ফেরার আগে হাবিল ভাই তার রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। কোরিয়ায় হাবিল ভাইয়ের তিনটি রেস্টুরেন্ট। তার একটিতে লাঞ্চ করলাম। এসময় জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াতও লাঞ্চ করলেন। হাবিল ভাইয়ের আমন্ত্রণ ছিলো। বিপাশা আপু এসেছেন আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিতে। খাওয়া দাওয়া এবং সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে হাবিল ভাই আমাদেরকে নিয়ে রওনা দিলেন ইনছন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

আমাদের ফ্লাইট ৫.৩০ মিনিটে। দুই ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্টে আসতে হবে এবং পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে। হাতে সময় আছে মাত্র দুই ঘণ্টা। হাবিল ভাই টান দিলেন ১৪০ কিমি গতিতে। ৬৫কিমি পথ পৌঁছলাম মাত্র ৪৫-৫০ মিনিটে। আল জাবের ফয়সাল(সরওয়ার ভাইয়ের ছোট ভাই, কোরিয়ার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে) আর মীর লোকমানকে ইমিগ্রেশনে পাঠিয়ে হাবিল ভাই আর আমি চলে গেলাম পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে।

কোন ঝামেলা ছাড়াই পাসপোর্ট বের করে দিলেন দায়িত্বরত কর্মকর্তা। একটি স্বাক্ষর দিয়ে পাসপোর্ট নিলাম। প্রাণে স্বস্তি ফিরে এলো। আল্লাহকে স্মরণ করলাম। কৃতজ্ঞতায় প্রাণ ভরে গেলো। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম ইনছন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষকে।

এমন এয়ারপোর্টের ক্ষেত্রেই মানায় টানা ১২ বছর ধরে নিরাপদ সেবার সার্ভিসের দিক থেকে বিশ্বের এক নাম্বার এয়ারপোর্ট হিসেবে স্বীকৃতি।

এটি কোরিয়ার সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ সার্ভিসে এক নাম্বার, বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম বিমানবন্দর এবং বিশ্বের ২য় সেরা ট্রানজিট, লাগেজ ডেলিভারিতে বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর।

১৯৯২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু করে যাত্রা শুরু হয় ২০০১ সালের মার্চে। রাজধানী সিউল থেকে ইনছন এয়ারপোর্টের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিমি। ইনছনের রয়েছে ৭৬টি বোর্ডিং গেট, ৪৪টি প্রধান টার্মিনাল। এর রয়েছে গলফ কোর্ট, প্রাইভেট স্লিপিং রুম, যাদুঘর, আর্টস স্কেটিং টিং ক্যাসিনো, ইনডোর পার্ক।
অত্যন্ত দ্রুতগতিতে যাত্রী সেবা দেয়া হয় এখানে। ফেরার সময় আমাদের ইমিগ্রেশনে ব্যয় হয়েছে মাত্র আধা মিনিট। আগামীতে আরও দ্রুত সেবা দিতে ইনছন বিমানবন্দরে শুরু হচ্ছে ই-মেশিন, যেখানে ইমিগ্রেশন অফিসার ছাড়াই কাজ সারার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। যাত্রীরা শুধু আঙ্গুলের ছাপ দিলেই সেকেন্ডের মধ্যে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হবে..

এভাবে সুন্দর, সুসজ্জিত এবং নিরাপদ সেবার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত এ এয়ারপোর্ট। আমার প্রাণের বাংলাদেশ কি করছে?

লিখেছেনঃ সাইফুল্লাহ সাদিক