Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

চবি ছাত্র আলাউদ্দিনের ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প

alauddin-murderফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে আলাউদ্দিনের। বিরক্ত চেহারা নিয়ে বালিশের কাছে রাখা ফোনটি হাতে তুলে নেয়। চোখ কুঁচকে তাকায়। রুম্পা! ফোনের ডিসপ্লেতে রুম্পার নামটি ভেসে উঠতে দেখেই শোয়া থেকে লাফিয়ে ওঠে আলাউদ্দিন। বিশ্বাস করতেই পারছিল না, রুম্পা তাকে ফোন দেবে। তাও আবার সাতসকালেই। বহুদিন এমনভাবে ফোন দেয় না রুম্পা। আলাউদ্দিনকেই দিতে হয়।

কানে ফোন লাগিয়ে মুহূর্তেই নানা কিছু ভেবে ফেলে আলাউদ্দিন। হ্যালো! ফোন রিসিভ করে আলাউদ্দিন। এই আমি! ওপাশে রুম্পার কণ্ঠ। হ্যালো বলা ছাড়া আলাউদ্দিন কোনো কথাই বলতে পারছিল না রুম্পার সঙ্গে। এত বছরের সম্পর্ক তাদের, সেদিন আলাউদ্দিনের মনে হচ্ছিল এই তো মাত্র কদিনের পরিচয়। বহুদিন ফোন করে বা ধরে ‘এই আমি’ কথাটি শোনেনি আলাউদ্দিন। অনেক দিন পর এমন কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। সে কথা ফোনে রুম্পাকেও বলছিল আলাউদ্দিন।

chardike-ad

‘এই আজ দেখা করবা? আমার মনটা খুব খারাপ। ভালো লাগছে না। তোমার সঙ্গেও অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি এতদিন। তুমি আসবা? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় রুম্পা। ‘আসব না মানে! কী বলো এসব? এখন আসব?’ গদ গদ করে আলাউদ্দিন বলছিল রুম্পাকে। রুম্পা বলে, ‘আরে না না! এখন না। সৈয়দপাড়ার শহীদনগর বাসার তিনতলায় চলে এসো। সন্ধ্যায়। দেরি কর না।’ না, আমি সময়মতো চলে আসব— বলেই ফোন রাখে আলাউদ্দিন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র আলাউদ্দিন আলাওল। রুম্পা তার সাবেক প্রেমিকা। সকালে কথা বলেছে তারা। আর সেই রাতেই লাশ হয়েছে আলাউদ্দিন। এ বছরের ২২ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার পশ্চিম শহীদনগর এলাকার একটি বাসা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হাত-পা ছিল বাঁধা।

alauddin
খুন হওয়া মো. আলাউদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন

প্রথমে অজ্ঞাত যুবক হিসেবে আলাউদ্দিনের লাশ উদ্ধার করা হলেও পরদিন মর্গে স্বজনরা শনাক্ত করেন। ওই বাসাটি ওমান প্রবাসী আবু সৈয়দের। চারতলা ভবনের তৃতীয় তলার বাসার বাথরুম থেকে লাশ উদ্ধার হয়। তবে কে বা কারা কীভাবে তাকে খুন করেছে পুলিশ তখনো অন্ধকারে।

পুলিশ খুনি গ্রেফতারে নামে মাঠে। তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু বাসাটি খালি থাকায় কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। আলাউদ্দিনের মোবাইল ফোনের কললিস্ট বের করা হয়। পুলিশ দেখতে পায়, খুব সকালেই একটি নাম্বারে কথা বলেছেন আলাউদ্দিন। আরও বেশ কয়েকটি ফোনেও কথা হয়েছিল। কিন্তু সকালে কথা বলা নাম্বারটিকেই পুলিশ সন্দেহের তালিকায় নেয়।

বেশ কিছুদিন আগে একই নাম্বারে কথা বলার রেকর্ড খুঁজে পায় পুলিশ। পুলিশ জানতে পারে নাম্বারটি রুম্পা নামের একজন মেয়ের। এই নামটি পাওয়ার পর পুলিশকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি তার সম্পর্কে জানার জন্য। কিন্তু পুলিশের মাথায় ঢুকে না, কেন আলাউদ্দিনকে খুন করতে যাবে রুম্পা। তারা তো একজন আরেকজনকে ভালোবাসত। কিন্তু পুলিশ যত গভীরে গেছে খুঁজে পেয়েছে এক নিষিদ্ধ গল্প।

এক সময় পুলিশ নিশ্চিত হয়, নিষিদ্ধ প্রেমের নির্মম বলি হয়েছেন সেই মো. আলাউদ্দিন আলাওল (২৪)। প্রেম পরকীয়া অতঃপর অভিসারের ফাঁদ পেতে খুন করা হয় আলাউদ্দিনকে। খুনি তারই সাবেক প্রেমিকা। সঙ্গে ছিল স্বামী, আর দুই দেবর। পুলিশের জালে আটকা পড়েছে তারা। স্বীকার করে নিয়েছে খুনের দায়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সমাজে সর্বগ্রাসী নৈতিক অবক্ষয়ের বড় দৃষ্টান্ত এ খুনের ঘটনাটি।

aluddin-murderআলাউদ্দিনের মোবাইল রেকর্ডের সূত্র ধরে তার প্রেমিকা ইয়াসমিন আক্তার রুম্পাকে (২২) আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। একপর্যায়ে রুম্পা রোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রুম্পার স্বামী ইকবাল হোসেন (২৭), তার দুই সৎ ভাই মো. তৈয়ব (৩২) ও মো. হেলালকে (১৯) গ্রেফতার করে পুলিশ।

রুম্পা আলাউদ্দিনকে অভিসারের ফাঁদ পেতে ডেকে এনে খুন করার ঘটনা বর্ণনা দেয় পুলিশের সামনে। রুম্পা জানায়, আলাউদ্দিনের সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয় ২০০৭ সালে। তখন সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের প্রতিবেশী। একপর্যায়ে তাকে প্রাইভেট পড়াতে শুরু করে সে। পড়ার ফাঁকেই গড়ে ওঠে প্রেম। জীবনের প্রথম প্রেম। মন-প্রাণ উজাড় করে ওকে ভালোবাসতে শুরু করি। আমাকেও ও প্রচণ্ড ভালোবাসত। প্রেম গড়ায় বিছানা পর্যন্ত। আলাউদ্দিন এসব গোপনে ফ্রেমবন্দী করে রাখে মোবাইলে। এরই মধ্যে ২০১০ সালে বিয়ে ঠিক হয়। হাটহাজারীর চৌধুরীহাটের ওমর সাদেকের সঙ্গে বিয়ে হয়।

পুলিশ জানতে পারে, স্বামী যেমন তার প্রেমের কথা জানত না, তেমনি আলাওলের কাছেও বিয়ের কথা গোপন রাখে রুম্পা। তাদের অভিসার চলতে থাকে আগের মতো। এমন লুকোচুরি চলে কয়েক বছর। পরে বিয়ের খবর জেনে যায় আলাওল। আলাওল তাকে পালিয়ে যেতে বলে সংসার ছেড়ে। তবে রুম্পা এতে সায় দেয়নি।

স্বামীর সংসার আর পরকীয়ার নামে নিষিদ্ধ প্রেম চলতেই থাকে। ততদিনে রুম্পার কোলজুড়ে আসে কন্যা শিশু। একপর্যায়ে তাদের এই প্রেমের সম্পর্ক ধরা পড়ে স্বামী সাদেকের হাতে। ঘটনা বিস্তারিত জেনে রুম্পাকে তালাক দেন স্বামী। ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই যেদিন সাদেক রুম্পাকে তালাক দেয় সেদিনই ওমান প্রবাসী রাউজানের ইকবাল হোসেনকে বিয়ে করে রুম্পা।

একপর্যায়ে আলাওলের নিষিদ্ধ প্রেম তাকে বিষিয়ে তোলে। এ কারণে ডিভোর্সের পরই ফের বিয়ে করে সে। পালাতে চায় আলাওলের খপ্পর থেকে। মুক্তি চায় অভিশপ্ত সেই প্রেম থেকে। আবারও সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চায় সে। এবার স্বামী ইকবালকে নিয়ে নতুন জীবন, নতুন সংসার ভালোই চলছিল তার। কিন্তু দৃশ্যপটে আবারও সেই আলাওল চলে আসে। এবার সে তার কাছে থাকা প্রেম আর অভিসারের ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয় এবং তাকে বাধ্য করে আগের মতো তার আহ্বানে সাড়া দিতে।

এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে বিষয়টি ধরা পড়ে স্বামী ইকবালের কাছে। কিন্তু সবকিছুই অস্বীকার করে রুম্পা। এরই মধ্যে স্বামী চলে যায় ওমান। এ সময় তাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। অসুস্থ হয়ে হঠাৎ স্বামী ফিরে এলে সে সংযত হয়। এড়িয়ে চলতে থাকে আলাওলকে। কিন্তু আলাওল কোনো ধরনের বাধাই মানে না। তার অব্যাহত হুমকি সঙ্গে স্বামীর সন্দেহাতুর চোখের পীড়াপীড়িতে একপর্যায়ে স্বামী ইকবালকে সব খুলে বলে রুম্পা। স্বামী ইকবাল ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেয় নিষিদ্ধ ও অভিশপ্ত এই প্রেমের গল্প শেষ করার।

২২ মার্চ রুম্পা ফোন করে আলাওলকে। আসতে বলে সৈয়দপাড়ার শহীদনগর চারতলা মোড়ে। প্রেমের টানে চলে আসে আলাওল। রুম্পা দরজা খুলতেই আলাওল দেখে বাসায় সে একা নয়। স্বামী ইকবালসহ আরও কয়েকজন। রুম্পা জানায়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ওই খালি বাসাটি ভাড়া নেওয়ার কথা বলে তারা সেখানে অবস্থান করে। আলাওল আসতেই প্রথমে ইকবাল ও তার দুই ভাই আলাওলের হাত-পা বেঁধে ফেলে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে আলাওল। আর তখনই ইকবালের দুই ভাই তৈয়ব ও হেলাল গলায় রশি পেঁচিয়ে দুই দিক থেকে টান দেয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। এরপর হাত-পা বাঁধা লাশটি ওই বাসার বাথরুমে রেখে তারা সবাই সটকে পড়ে।

রুম্পা জানায়, আলাওলের হাত-পা বেঁধে ফেলার পরও সে কোনো চিৎকার করেনি। তার ধারণা ছিল তাকে ভয় দেখানোর জন্য এটা করা হচ্ছে। তবে তাকে খুন করার সময় রুম্পা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বলে দাবি করে পুলিশের কাছে। রুম্পা বলে, খুন করে তার স্বামী ও দেবররা তাকে জানায় সব শেষ করে দিয়েছি।

লেখক: মির্জা মেহেদী তমাল, সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন।