Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে বাংলাদেশিদের সাফল্য

mishigunমিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েটকে বলা হয় মটর সিটি। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর তিন গাড়ি কোম্পানির সদর দফতর ও প্রধান প্রকৌশলকেন্দ্র এই শহরকে ঘিরে। মিশিগানের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। সবার হয়তো মনে আছে- ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য মিশিগান। দেশের বৃহৎ গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরস ও ক্রাইসলার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল। ফোরড মটরস তাদের লোগো জামানত রেখেছিল। অন্যদের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝেও এর ব্যাপকতা লক্ষ্য করা গেছে। সে সময় প্রতিদিন প্রচুর বাংলাদেশি ইমিগ্রান্ট মিশিগান ছেড়ে নিউইয়র্ক, ডালাস, ফিলাডেলফিয়া পাড়ি জমান। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা হারিয়েছেন। বাড়িঘর ফেলে রাজ্য ছেড়েছেন। সরকারের বিশেষ প্রণোদনায় গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মিশিগানকে এখন বলা হয় ‘কামব্যাক স্টেট’।

মিশিগানের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রধান কারণ গাড়ি কোম্পানিগুলোর আমূল পরিবর্তন। মিশিগানে তৈরি হয়েছে প্রচুর কর্মসংস্থান। সম্প্রতি বছরগুলোতে অন্যদের মতো প্রচুর বাংলাদেশি ইমিগ্রান্ট মিশিগানে স্থানান্তরিত হয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশি অভিবাসী যে কোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশি অভিবাসীদের সঠিক সংখ্যা না জানলেও এটুকু বলা যায়- নিউইয়র্ক, টেক্সাসের পাশাপাশি মিশিগান অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বৃহৎ অংশের বসবাস। চাকরি, বাড়ি ভাড়া, জীবনযাপন খরচ সবদিক থেকে সম্প্রতি বছরগুলোতে মিশিগানে বাংলাদেশিদের আগমন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

chardike-ad

মিশিগানের ডেট্রয়েট এবং এর পার্শ্ববর্তী হ্যামট্র্যামাক, ওয়ারেন, স্টারলিং হাইটস, ট্রয়, রচেস্টার, রচেস্টার হিলস, ফারমিংটন, ফারমিংটন হিলস, নোভাই, নর্থভীল, কেন্টন, ডিয়ারবর্ণ হাইটস, টেইলর, সাউথগেট, এন আরবার, ফ্লিন্ট, ল্যান্সিং, শাগিনাও, গ্রান্ড রাপিড ও বে-সিটির প্রায় সব শহরে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি কমিউনিটি।

সংখ্যা বিবেচনায় নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে সর্বাধিক বাংলাদেশি আমেরিকানদের আবাসন। নতুন অভিবাসীদের প্রথম পছন্দ নিউইয়র্ক। কিন্তু বর্তমানে বাসা ভাড়া, বাড়ির উচ্চমূল্য, জীবনযাপন খরচের কারণে নিম্ন আয়ের অভিবাসীদের প্রথম পছন্দ মিশিগান। জ্বালানি তেলের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে টেক্সাস, আলাবামা, ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের অনেক প্রকৌশলী মিশিগানে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

মিশিগানের প্রায় প্রতিটি শহরেই গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি, যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, জাপান ও জার্মানি গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের উত্তর আমেরিকার প্রধান প্রকৌশল কেন্দ্র রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রচুর বাংলাদেশি অভিবাসী চাকরিরত। অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত প্রচুর বাংলাদেশি এখন মিশিগানে আসছেন। এ ব্যাপারে নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রতিদিন ৩ থেকে ৫টি পরিবার নিউইয়র্ক থেকে মিশিগানে পাড়ি জমিয়েছেন। এখানে গাড়ি নির্মাণ, যন্ত্রাংশ নির্মাণ, আইটি কোম্পানিগুলোতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের পরিসংখ্যান এখন বলার মতো না হলেও উপস্থিতি মিলবে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই।

মিশিগানে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশির অবস্থান রাজ্যের প্রধান শহর ডেট্রয়েটের পার্শ্ববর্তী হ্যামট্র্যামাক শহরে। এ শহরে বাংলাদেশির সংখ্যা, স্থানীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশির অংশগ্রহণ ও রাজ্যের অর্থনীতিতে উপস্থিতির কারণে সরকারিভাবে মিশিগানের গভর্নর রিক স্নাইডার শহরকে ‘বাংলা টাউন’ হিসেবে ঘোষণা করেন। রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ এভিনিউ। এ শহরে নির্বাচনে ব্যালট পেপার হয় বাংলায়। এ শহরের বাংলাদেশিরা প্রধানত ব্যবসায়ী, এছাড়া বড় অংশ গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। তবে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিরা এখানে পড়াশোনা শেষে চিকিৎসক- প্রকৌশলী হিসেবে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করছেন।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের বড় একটি অংশের বসবাস হ্যামট্র্যামাকের পার্শ্ববর্তী ওয়ারেন শহরে। হ্যামট্র্যামাক থেকে অনেকে এই শহরে স্থানান্তরিত হন। জেনারেল মটরসের ওয়ার্ল্ড টেকনিক্যাল সেন্টার এই শহরে। তাই রয়েছে অনেক যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি এক গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেল, ফ্যাক্টরিতে কর্মরত শ্রমিকের অধিকাংশই নারী এবং তারা বাংলাদেশি অভিবাসী। এ শহরে প্রচুর ক্ষুদ্র নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা। শহরের বাংলাদেশি গ্রোসারি (মনোহরি) দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের দোকানের জন্য বাংলাদেশি শ্রমিক পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। প্রায় সবাই বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ নিয়ে চলে যায়।

জেনারেল মটরসের ওয়ার্ল্ড টেকনিক্যাল সেন্টারে কর্মরত বাংলাদেশি প্রকৌশলীর সংখ্যা শতাধিক। এখানে বাংলাদেশি নারী প্রকৌশলীর সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো। ওয়ারেন শহর লাগোয়া দুই শহর স্টারলিং হাইটস ও ট্রয় শহরে বাংলাদেশিদের বড় কমিউনিটি। উত্তর আমেরিকাতে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি বলা চলে। রয়েছে বাংলা স্কুল ও প্রকৌশলীদের সংগঠন। সম্প্রতি বছরে এ শহরে বাংলাদেশি অভিবাসী বেড়েছে কয়েকগুণ। রচেস্টার ও রচেস্টার হিলস শহরে বাংলাদেশিদের বসবাস বেড়েছে বেশ কয়েকগুণ। অধিকাংশ গাড়ি নির্মাণ ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। পার্শ্ববর্তী পন্টিয়াক শহরে জেনারেল মটরসের প্রকৌশল কেন্দ্রে প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি কর্মরত। আরবান হিলে ফিয়েট ক্রাইস্লার কোম্পানিতে বাংলাদেশির সংখ্যা শতাধিক। এমনকি এ শহরে গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘কন্টিনেন্টালে’ অর্ধশতাধিক প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন।

গ্রেটার ডেট্রয়েটের পশ্চিম প্রান্তের শহর ফারমিংটন, ফারমিংটন হিলস, নোভাই ও নর্থভীল শহরে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের একটি বড় অংশের বসবাস। শহরগুলোতে ভারত, পাকিস্তান ও জাপানি আমেরিকানদের বসবাস। তাই রয়েছে প্রচুর দেশি রেস্টুরেন্ট। মজার ব্যাপার হলো, এর অধিকাংশের বাবুর্চি বাংলাদেশি। সম্প্রতি অন্যান্য অঙ্গরাজ্য থেকে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশি অভিবাসী এখানে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

ক্যান্টন ও এন আরবার শহরে রয়েছে বাংলাদেশি অভিবাসীদের একটি অংশ। গাড়ি ও যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ অভিবাসী রয়েছে এ শহরে।

ফোর্ড গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি ও আমেরিকার সবচেয়ে বেশি মধ্যপ্রাচ্যের বসবাসের কারণে ডিয়ারবর্ন বেশ আলোচিত। এ শহরেও বাংলাদেশি অভিবাসীদের বসবাস রয়েছে। সম্প্রতি বেড়েছে বেশ দ্রুত। পার্শ্ববর্তী ডিয়ারবর্ন হাইটস, টেইলর, সাউথগেট মিলে বাংলাদেশি শতাধিক পরিবারের বসবাস।

ল্যান্সিং হচ্ছে মিশিগান রাজ্যের রাজধানী। শহরে রয়েছে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি। আর তাই পনেরো থেকে বিশটি বাংলাদেশি ছাত্র পরিবার থাকে, যারা দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে এখানে আসেন। এছাড়া ল্যান্সিং, মেসন, হল্ট শহরে বাংলাদেশি অভিবাসীদের কমিউনিটির পদচারণা চোখে পড়ার মতো। গ্র্যান্ড র্যাপিড শহরে বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশের বসবাস, পার্শ্ববর্তী হল্যান্ড, জি ল্যান্ড, বিগ র্যাপিড মিলে বেশ বড় কমিউনিটি। শহরগুলোতে গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী।

ফ্লিন্ট শহরে বাংলাদেশিদের বাস বহুদিন আগ থেকেই। ছোট কিন্তু বেশ আন্তরিক এ বাংলাদেশ কমিউনিটি। চিকিৎসক, প্রকৌশলী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী রয়েছে। শাগিনাও, মিডল্যান্ড, ব-সিটি মিলে বেশ বড় বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ গাড়ি যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। রয়েছে বেশ ক’জন বাংলাদেশি চিকিৎসক। শহরের বাংলদেশি অভিবাসী ডা. দেবাশিষ মৃধা গতবার অঙ্গরাজ্যের সিনেটর পদে নির্বাচন করেন। শাগিনাও ভ্যালি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি পরিবার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত।

আমেরিকার রাজনীতির প্রধান দলগুলোর একটি ডেমোক্র্যাটিক দলের বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক (বিএডিসি) বেশ সক্রিয়। এছাড়া দল নিরপেক্ষ সংগঠন বাংলাদেশি আমেরিকান পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (ব্যাপাক) বাংলাদেশি অভিবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড আর্কিটেকচার (আবিয়া)। রয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা। সংগঠনগুলো বাংলাদেশি অভিবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে চলেছে। রাজ্যের মূল ধারার রাজনীতিতে সংগঠনগুলো অভিবাসীদের ‘কণ্ঠস্বর’ হিসেবে পরিচিত।

মিশিগানে বাংলাদেশি অনেক পরিবারের বসবাস, চলে বাঙালিয়ানার ষোলকলা আয়োজন। খাবারের জন্য বাংলাদেশি দোকানপাট ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক। প্রায় সব বড় শহরেই রয়েছে দেশি বুটিক হাউজ। সম্প্রতি স্থানীয় বাংলাদেশি কিছু পরিবার বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশি শাক-সবজি চাষ করছেন। তাই বাংলাদেশি শিম-লাউ সব কিছুরই স্বাদ পাবেন এ রাজ্যে। বাংলাদেশের সব জাতীয় দিবসগুলো ঘটা করে পালিত হয় বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে। চাকরি, পড়াশোনা ও বিভিন্ন কারণে প্রবাসী হলেও বাংলাদেশের খারাপ সংবাদে হৃদয় কাঁদে, ভালো সংবাদে অানন্দে নেচে ওঠে মন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিজয়ে মিষ্টি বিতরণ ও বড় আনন্দ আয়োজন এখন হরহামেশা। ‘কামব্যাক’ রাজ্য মিশিগানের সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিকাশে বাংলাদেশি অভিবাসীরা বেশ ভালোভাবেই অংশ নিচ্ছেন। রাজ্যের রাজনীতিতেও অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের কাছে বাংলাদেশিরা উদাহরণ।

ইতোমধ্যে সারা বিশ্ব জেনে গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি অভিবাসী অনুকূল দল নয়। মিশিগানের গভর্নর রিক স্নাইডার রিপাবলিকান দলের। তিনি বহুবার মিডিয়াতে অকপটে স্বীকার করেছেন মিশিগানের অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে আভিবাসীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। বাংলা টাউন ঘোষণার মঞ্চে তিনি বাংলাদেশি অভিবাসীদের মডেল হিসেবে উদাহরণ দিয়েছিলেন। মিশিগানের ইতিহাসে প্রথম কোনো শহরকে সরকারিভাবে ‘বাংলা টাউন’র মতো ‘অভিবাসীদের শহর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

লেখক- সাইফুল আজম সিদ্দিকী, মিশিগান(যুক্তরাষ্ট্র) থেকে
সৌজন্যে- জাগো নিউজ