Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সৌদি থেকে দলে দলে ফিরছে মেয়েরা, সরকার চুপ

soudi bangladeshi womanবাংলাদেশ থেকে গত প্রায় তিন দশকে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক গিয়েছে সাত লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। সরকারি হিসেবে, এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি নারী শ্রমিক গেছে সৌদি আরবে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেখান থেকে ফিরে এসেছে কয়েকশো নারী শ্রমিক। আর ফিরে আসা নারী শ্রমিকেরা বিবরণ দিচ্ছেন সেখানে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নানা ধরনের নির্যাতনের ।

এমন প্রেক্ষাপটে অভিবাসী শ্রমিক ও সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুলছে, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিকদের রক্ষার বিষয়ে সরকার কতটা তৎপর? গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গত নভেম্বর মাসে সৌদি আরব গিয়েছিলেন বরিশালের আকলিমা বেগম। একহাজার রিয়াল বেতন দেয়ার কথা থাকলেও ফিরেছেন শুন্যহাতে। সেইসাথে সহ্য করতে হয়েছে নানারকম নির্যাতন ।

chardike-ad

“আমি গিয়েছিলাম নভেম্বর মাসে। ঠিকমত খাবার দিত না। মারধোর করতো। বেতন চাইলেই মারধোর করতে শুরু করে। খুন্তি পুড়ে পিঠে গরম ছ্যাঁক দিয়েছে, অনেক নির্যাতন করেছে। তারপর আমি পালিয়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় নিয়েছি। এরপর আমাকে সফর জেলে পাঠায়। একটা সৌদি টাকা দুই চোখে দেখিনাই।”

স্বামী ও শিশু সন্তানকে রেখে গিয়েছিলেন পরিবারে শান্তির জন্য এখন ফিরে আসার পর সেখানেও ঠাই হচ্ছে না।

“সৌদি আরবে নির্যাতনের পর ফিরে আসা একটা নারীর স্বামী কি করতে পারে, আপনি তো বোঝেন।”

তার ওপর কোনও যৌন হামলা বা নির্যাতন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এই নারী বলেন, ” সৌদিতে যে নির্যাতন হয় তার বিষয়ে আপনারা সাংবাদিকরা আরও ভালো জানেন, প্লিজ একটা ব্যবস্থা নেন।”

এমন নির্যাতনের শিকার হয়ে আরও অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন সৌদি আরবে দূতাবাসের সেফ হোমে যাকে তারা বলছেন সফর-জেল। এরকম ১২০ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করা হয় ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির পক্ষ থেকে। এর মধ্যে এ নিয়ে মোট ৯০ জন নারীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

ব্র্যাকের এই অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে এমনকি দেশের বাইরে থেকে তাদের সাথে অনেকে যোগাযোগ করেন এই সব নারীদের ফিরিয়ে আনার জন্য। এরপর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়র ওয়েলফেয়ার বোর্ডের মাধ্যমে এই মেয়েদের ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন।

এছাড়া কয়েক দফায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে এসেছেন আরও কয়েকশো নারী শ্রমিক। তাদের অভিযোগ দিনরাত কাজ করানো হতো, সেইসাথে চলতো শারীরিক ও যৌন নির্যাতন। চুক্তির নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলেও অনেকের পাসপোর্ট অনেকদিন ধরে আটকে রেখেছে সৌদি নিয়োগদাতারা।

এরকম অনেক নারী সম্প্রতি সৌদি আরব, জর্ডান থেকে ফিরে এসেছেন। তেমনই একজন তানিয়া । রোববার ফিরে আসা ত্রিশ জনের একজন। দুই মাসও পেরোয়নি তার আগেই ফিরে আসতে বাধ্য হন শরীরে ক্ষত আর ভাঙা পা নিয়ে।

খুব বেশি কথা বলতে রাজি হলেন না তিনি। এই নারী এবং তার স্বামীর প্রশ্ন- “এসব বলে কি হবে?”

১৯৯১ সাল থেকে এপর্যন্ত প্রায় তিন দশকে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকরা গেছেন তার মধ্যে শুধুমাত্র সৌদি আরবেই গেছে ২ লাখ ৩৪ হাজার আটশোর বেশি নারী। ফিলিপাইন, শ্রীলংকাসহ কিছু দেশ যখন তাদের নারীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে, সেসময় বাংলাদেশ নারীদের সৌদি আরবের পাঠানোর চুক্তি করে । কিন্তু অভিবাসন নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থান নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।

বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিকদের সংগঠন বমসার পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলছেন গত ছয়/সাত মাসে মাসে চার থেকে সাড়ে চার হাজার নারী শ্রমিক ফিরে এসেছেন।

“শ্রমিক যতটা ফিরে আসছে তার চেয়ে বড় মুশকিল হল তার নির্যাতনের পরিমাণটা অনেক মাত্রায় বেশি। শারীরিক, মানসিক যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।”

শ্রীলংকা, ফিলিপাইনের মত দেশ নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কঠোর অবস্থান নিয়ে এখন আবার সেই বাজারে ফিরে গেছে, ফলে তাদের দরকষাকষি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেদিকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ- বলছিলেন সুমাইয়া ইসলাম।

তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপ বিষয় না, বিষয় হচ্ছে যেখানে শ্রমিকের মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে, ন্যায্যটা পাবেনা, সেরকম কোনও দেশে পাঠানোর দরকার নেই। শ্রমিকের অধিকার, মর্যাদা আগে প্রতিষ্ঠা করে তারপর পাঠাতে হবে। ফিলিপাইন, শ্রীলংকা শ্রমিকদের টর্চার হয়, কিন্তু সংখ্যাটা কম কারণ তাদের সরকার খুব স্ট্রং, তাদের রিক্রুটিং এজেন্সি দায়বদ্ধ। এ কারণে তাদের নির্যাতনের পরিমাণটা অনেক কম। তাদের বারগেইনিং পাওয়ার বেশি। সেই জায়গাটাতে আমরা পিছিয়ে আছি।”

এমন প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করার কথা বলছেন ফিরে আসা অনেকে। তবে সরকারি কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এই বাজারটি এখন তাদের ধরে রাখতেই হবে। প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার বলেন, “আমরা একটা শক্ত বা কঠোর অবস্থান নিলে, এত বড় শ্রমবাজার- সৌদি আরব… ধরেন আর যেতে দিলাম না আমাদের মেয়েদের তাহলে তো গেল আমাদের শ্রমবাজারটা বন্ধ হয়ে…।”

“আমাদের মেয়েদের অদক্ষতার বিষয়টিও আমরা আবিষ্কার করলাম। যারা গেছে তারা অনেকে ভাষা বোঝেনা। কথা বলতে না পারলেও নাকি তারা মারধোর করে।”

এইসব মেয়েদের দক্ষতা বাড়ানোর এবং ভাষা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে তিনি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দিকে দোষারোপ করে বলেন, তারা প্রশিক্ষণ ছাড়া, মেডিকেল চেকআপ ছাড়া লোক পাঠিয়ে দিচ্ছে।