
ছবি: সংগৃহীত
মাধ্যমিক শেষ করেই পরিবারের অভাব ঘোচাতে সৌদি আরব পাড়ি দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার নুরুল আলম (৩৮)। টানা ১৮ বছরের পরিশ্রম, সংগ্রাম আর ঘাম—সব মিলিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজের স্বপ্নের সংসার। সেলাই শিখে চাকরি, তারপর নিজস্ব ব্যবসা—ধীরে ধীরে পরিবারকে দাঁড় করিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্নের পথেই থেমে গেল জীবন। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টার দিকে সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই প্রবাসী।
লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের আকবরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আলমের বাড়িতে এখন শুধু আহাজারি। শনিবার দুপুরে তাঁর নিকটাত্মীয় মোরশেদ আলম জানান, দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে নুরুল আলম ছিলেন বড়। আর্থিক টানাপোড়নের কারণে এসএসসি পাস করেই বিদেশ যেতে বাধ্য হন। প্রথমে সেলাইয়ের কাজ শেখা, এরপর প্রায় ১০ বছর চাকরি—কঠোর পরিশ্রম করে সঞ্চিত টাকায় আট বছর আগে আবহা শহরের মাহাইল এলাকায় কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। প্রতিদিন নিজেই মাইক্রোবাস চালিয়ে দোকানে পণ্য সরবরাহ করতেন। সেই মাইক্রোবাসেই ফিরতি পথে মালবাহী লরির ধাক্কায় তাঁর মৃত্যু হয়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, শুধু নিজের জন্য নয়—সব সময়ই পরিবারের কথা ভেবেছেন নুরুল আলম। ছোট ভাইকে সৌদি আরবে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। এ বছরের শুরুতে ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছেন জাঁকজমকভাবে। মাত্র ১১ দিন আগেই মা ও খালাকে ওমরাহ করাতে সৌদি আরব নেন তিনি। মাকে নিজের গাড়িতে করে দেশটি ঘুরে দেখানোর কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আর পূরণ হলো না।
নুরুল আলমের তিন ছোট ছেলে—নওশাদ (১১), নওয়াজ (৬) ও নাওহাজ (৪)—বাড়ির পাশে ক্রিকেট খেলছিল। তারা জানেই না, তাদের বাবা আর কোনোদিন ফিরবেন না। শুধু বড় ছেলে নওশাদ মানুষের ভিড় দেখে কিছুটা বুঝতে পারছে। শিশুটি বলছিল, “বুধবার রাতে বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। বলেছিল ভালো করে পড়াশোনা করতে। রেজাল্টে ভালো করলে ল্যাপটপ কিনে দেবে।”
আধাপাকা ঘরের বারান্দায় বসে কাগজপত্র গোছাচ্ছিলেন নুরুলের বাবা সালে আহমদ (৬৮)। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “পরিবারের জন্য সারাজীবন খেটেছে আমার ছেলেটা। নিজের জন্য কিছু করতে পারেনি। তিনটা ছোট নাতি আছে, আরেকজন আসতে বাকি… ওদের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে মন ছটফট করে।”
স্বামীবিয়োগে বাকরুদ্ধ স্ত্রী নওরিন আক্তার। প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বললেন, “স্বামীর লাশটা দ্রুত দেশে আসুক। ছেলেরা যেন অন্তত বাবার কবরটা দেখতে পারে।”
আধুনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন বলেন, নুরুল আলমের মরদেহ দেশে আনার প্রক্রিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন সহযোগিতা করছে। তবে কবে লাশ দেশে পৌঁছাবে, তা নিশ্চিত নয়।
নুরুল আলমের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ভেঙে দিয়েছে একটি পরিবারকে। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত—তিনটি অবুঝ শিশুর, যারা এখনও খেলায় মগ্ন… কারণ তারা জানে না, তাদের বাবা আর কখনোই ফিরে আসবেন না।










































