Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি মুসলমানদের দিনকাল

shahjalal-centre
নিউইয়র্কে বাঙালিদের করা মসজিদ শাহজালাল মুসলিম সেন্টার

অনেক দিন থেকেই উত্তর আমেরিকার অভিবাসী বাংলাদেশী মুসলমানসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আগত মুসলমানদের প্রবাসে রোজার অভিজ্ঞতা ও তাদের ধর্ম চর্চা নিয়ে লিখার ইচ্ছে ছিলো। লিখাটি কিভাবে আরম্ভ করবো সেটা ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই লিখছি।

প্রবাস জীবনের প্রথম দিনগুলোতে মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খুব মিস করেছি। আরো দুটি মুহুর্তে মায়ের কথা মনে পড়েছে খুব বেশি। প্রথমত বিশেষ করে অসুস্হ অবস্হায়। অসুস্হ হলে মায়েদের সেবার তুলনা হয় না। মায়েরা আমাদের জন্মদিয়েই শুধু নয়, লালন পালন করে আমাদের আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসার সকল কৃতিত্বই তাদের।

chardike-ad

মায়েদের বিকল্প আর কেউই হতে পারে না এই পৃথিবীতে। আর দ্বিতীয়ত সেহরী খাবারের সময় হলেই মা ডেকে উঠাতেন বলে প্রবাসে এসে বহুবার সেহরী না খেয়েই রোজা রাখতে হয়েছে। কারণ, এখানে সেহরীর সময় ঘুম থেকে ডেকে তুলে দেবার কেউ নেই। আর তরুণ বয়সে গভীর ঘুম লেগে গেলে ঘড়ির অ্যালার্মেও কাজ হয় না।

দিনের পর দিন সেহরী না খেয়ে রোজা রাখতে রাখতে এক পর্যায়ে রাতে একটু আগেই-ভাগেই একেবারে সেহরী খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তাম। আর অনেক সময়ই রাস্তা-ঘাটে থাকাকালীন ইফতারের সময় হয়ে গেলে প্রচণ্ড ক্ষুধাপেটে এক ঢোক পানি গিলে ইফতার করা হতো। অনেক অভিবাসী মুসলমানেরা যারা দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করেন, তাদের অনেককেই দেখা যায় ইফতারের সময় হলে কোনো ভবনের প্লাজায় বসে ইফতার সেরে নিচ্ছেন। ইফতারের সময় কেউ যদি বুঝতে পারেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি মুসলমান তাহলে খাবারে যোগ দেবার জন্য অনুরোধ করেন।

ম্যানহাটনে আমার এমন বহু অভিজ্ঞতা হয়েছে। পরে সৌজন্যমুলকভাবে আমি তাদের স্টারবাক্সের কফি খাইয়েছি। আর ইফতার করেই প্লাজাগুলোতে দাঁড়িয়েই একসাতে দুই তিনজন মিলে জামাতে নামাজও পড়েছি বহুদিন। নিউইয়র্ক নগরীতে রাস্তায় দাঁডিয়ে ফল ও নানা ধরনের খাবার বিক্রি করেন অনেক অভিবাসী মুসলমান, তাদেরও দেখা যায় বিক্রি ক্ষণিক সময়ের জন্য বন্ধ করে দিয়ে নামাজ আদায় করছেন।

তাদের পাশে দাঁডিয়ে থাকে আমেরিকানরা যারা খাবার কিনতে আসে। সেসব আমেরিকানরা খুবই শ্রদ্ধাশীল, তারা বুঝতে পারে যে লোকটি প্রার্থনা করছে। তাই নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁডিয়ে থাকে।

আমেরিকানদের আরেকটি গুণের কথা গোটা বিশ্বের মানুষের কাছেই অজানা। বিশেষ করে মুসলমানদের মাঝে যারা ধর্ম-কর্ম করে তাদের ব্যাপারে আমেরিকানরা ভীষণ শ্রদ্ধাশীল এবং খুবই কৌতুহলী। কারণ, তারা নিজেরা কোনো ধর্ম পালন করে না বলেই হয়তো এমন মস্তক অবনত ও শ্রদ্ধাশীল।

আমার মেয়ের প্রথম রোজা রাখার অভিজ্ঞতা পাঁচ বছর বয়সে কিন্ডার গার্টেনে থাকতে। একটি রোজা রেখে দ্বিতীয়টির সময় বেলা দুটোতে বলে উঠলো বাবা আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তারপর দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে আশ্চর্যজনকভাবে সবগুলি রোজা রাখার অভ্যেস করে ফেলেছে। আর ছেলে প্রথম শ্রেণি থেকে রোজা রাখা শুরু করে দিয়েছে। গেলো বছর বিশটি রেখেছে। এবছর গোঁ ধরেছে সবগুলো রাখার জন্য। আজ তার স্কুলের ফিল্ড ট্রিপ থাকায় আমার ছেলেকে রোজা রাখতে দেওয়া হয়নি, তাই সে স্কুলে অনেক লজ্জা পেয়েছে যখন ক্যাফেটেরিয়াতে সহপাঠীরা জিজ্ঞেস করলো, “কিরে আজ রোজা রাখিসনি”! রোজা রাখতে না পারার লজ্জা কয়জনের হয়?

স্কুলে দুজনই রোজা সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তাদের মার্কিন সহপাঠিদের সবাই ও শিক্ষকরাও তাদের নানা প্রশ্ন করে এবং জবাব শুনে সবাই খুবই অভিভূত হয়। শুধু আমার ছেলে-মেয়েই নয়, আরো অনেক মুসলমান স্কুলগামী বাচ্চারা রোজা রাখে নিয়মিত। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা রোজা রাখা স্কুলগামী বাচ্চাদের পক্ষে অনেক বড় ত্যাগ। যা অনেক মুসলমান অধ্যুষিত দেশেও আজকাল দেখা যায় না।

বছরের পর বছর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতারের সামগ্রীগুলো যেমন পিঁয়াজু, ছোলা ভাজা, ঘুগনী, বেগুনী, পাকোড়া জাতীয় খাবারগুলোর আর চকবাজারের লাচ্ছির কথা খুবই মনে পড়তো ইফতারের সময়। ছুটির দিনে ঘরে থাকলে কাঁচা ছোলা ও খেজুর দিয়েই ইফতার করা হতো। আমরা যখন মার্কিন মুল্লুকে এসেছি তখন বাঙালি মেয়েরা তেমন আসেনি।

আমাদের মাঝে প্রথম যে দুজন মহিলা এলেন তারা নাহার ও বনানী ভাবী। এই দুজন মহিলার কাছে আমি নানাভাবে অনেক ঋণী হয়ে আছি। এই দুজনের আগমনের পরই আমরা ইফতারে প্রথম খেতে পারলাম পিঁয়াজু, বেগুনী, ছোলা ভাজাসহ আরো অনেক বাহারী খাবার। বড় তৃপ্তির সাথে খাওয়া হতো সেইদিনগুলোর ইফতারী। আরেকজন শামসুন নাহার ভাবী ডেকে নিয়ে অনেকদিন ভুনা খিচুড়ি গরুর মাংস ভুনা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। আর শরীয়তপুরের মহসিন ভাই যার হাতে রান্না করা খাসীর মাংস ও ডাল অসাধারণ, তিনিও খাবার খাইয়ে ঋণী বানিয়েছেন আমাকে। মহসীন ভাইয়ের ঘরেও তার নিজ হাতে বানানো অনেক বাহারী ইফতারী খেয়েছি।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে আসতে থাকলো অভিবাসীদের স্ত্রীরা। বিশেষ করে অভিবাসীদের শহর নিউইয়র্কে বাঙালিদের সংসার জীবন শুরু হলো। আস্তে আস্তে তাদের সন্তানদের জন্ম হলো। নিউইয়র্ক নগরীর সামাজিক জীবনের আরেক বড় অংশীদার হয়ে দাঁড়ালো বাংলাদেশের অভিবাসী বাঙালিরা। আজকের নিউইয়র্ক নগরীতে বাংলাদেশিদের অবস্থান অনেক দৃঢ়, আগের তুলনায়। বাঙালিরা তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছে নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি। ঢাকাকে যেমন মসজিদের নগরী বলা হয়, আজকের নিউইয়র্ক নগরীকেও মসজিদের নগরী বললে কম বলা হবে না। গর্ব করার বিষয় হলো মসজিদগুলোর ৯০% ভাগেরও বেশি বাঙালিদেরই হাতে গড়া।

বিরক্তির উদ্রেক হয়েছে এমন একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছিনা। প্রতিটি ঈদে চাঁদ দেখা নিয়ে বাংলাদেশি আলেম সমাজের মতবিরোধের ব্যাপারটা বড়ই বিরক্তিকর ছিলো। প্রায় তিন দশকে দুই বা তিনবার ২৯ রোজা করেছি। আর বাদবাকি সব বছরই ৩০টি করে রোজা রাখতে হয়েছে। এমনকি অমিমাংসিত সিদ্ধান্তের জন্য অনেকে ৩১টি রোজাও রেখেছেন। কিন্তু নিউইয়র্ক নগরীর বর্তমান মেয়র বিল ডি বিলাসিওর বদৌলতে অন্তত এই নগরীর মুসলমানদের চাঁদ দেখা বা ঈদের দিন ধার্যের ব্যাপারটির সমাধান হয়েছে। মেয়র স্কুলের মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাধিক্য বুঝতে পেরে দুই ঈদের দিন ছুটি নির্ধারণ করেছেন আধুনিক উপায়ে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে। এবং এই চাঁদ দেখার উপায়টিই সঠিক বলে আমি মনে করি। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার চাঁদের ব্যাপারটি লক্ষ্য করে নিশ্চিত হয়েছি পত্রিকায় তাদের দেওয়া চাঁদ সংক্রান্ত তথ্য বিজ্ঞান সম্মত এবং সঠিক।

নগরীর স্কুলগুলোর অনেকগুলোতেই প্রায় অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রীই বাংলাদেশি বংশোদ্ভুতসহ পাকিস্তান, আরব, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের। নিউইয়র্ক নগরীর স্কুল হাসপাতালসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের লিফলেট ফ্লেয়ারগুলোতে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলায়ও লিখা হয় নির্দেশনাগুলো। এমন কি নগরীর রেলগাড়ির ডাব্বাগুলোয়ও বাংলায় অনেক তথ্য ও নির্দেশনা লিখা থাকে।

আমরা যারা ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমান আছি তারা নিজ সন্তানদের নিয়ে একটি সময় খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। সবাই দুশ্চিন্তায় থাকতেন তাদের সন্তানদের ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে এবং সন্তানদের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির ব্যাপারে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানা ওয়াতাআলা সেই সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়েছেন।

সুবহানআল্লাহ। এদেশের মসজিদগুলোয় আজ ছুটির দিনে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয় নিয়মিত। সুশিক্ষিত অনেক আলেমদের আগমন ঘটেছে মসজিদগুলোর উছিলায়। এসব আলেমদের অনেকেই বাংলাদেশের বাহিরে অর্থাৎ মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড ও আফ্রিকার অনেক দেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছেন। আমার ছেলে ও মেয়ে দুজনেই খুবই অল্প বয়সেই কোরআন শরীফ খতম দিয়েছে। তারা দুজনেই খুব সহিহভাবে কোরআন পড়ার শিক্ষা গ্রহণ করেছে। সত্যি কথা, যা আমাদের সৌভাগ্য হয়নি। আমরা দেশে অনেক ভুলভাবেই শিখে এসেছি। আজ বুঝতে পেরে অনেকেই অনুশোচনায় ভোগেন। তবে আমার সন্তানদের কোরআন শিক্ষার ব্যাপারে আমার স্ত্রীর ভুমিকা প্রশংসনীয়। তিনি ছেলে ও মেয়ে দুজনকেই মাগরিবের নামাজের পর বাধ্যতামূলকভাবে তেলাওয়াত করতে বসাতেন।

এবার বলছি এদেশের আলেম সম্প্রদায়ের কৃতিত্বের কথা। আলেমরা মসজিদে কেবলমাত্র কোরআন পড়ানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। তারা ইতিমধ্যেই অনেক কোরআনে হাফেজ সৃষ্টি করেছেন। আর যারা এদেশে কোরআনে হাফেজ হয়েছে এরা প্রত্যেকেই প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র। এইসব মেধাবী ছাত্রদের অনেকে মূলধারার স্কুলের লেখাপড়ার ফাঁকেই কোরআন হেফজ করছে। আর কিছু আছে গোটা সময়টাকেই কোরআন হেফজ করার জন্য ব্যয় করছে। হেফজ হয়ে গেলে তারা আবারও স্কুলে ফিরে যাচ্ছে।

এদেশের আলেমদের লক্ষ্যই থাকে সবচাইতে ভালো ছাত্রটিকে কোরআনে হাফেজ বানানোর জন্য বাছাই করা। আমাদের দেশে সাধারণত হাবা-গোবা ছেলেটিকেই মাদ্রাসায় পাঠানো হয় যে কিনা “হালেরও নয়, বীজেরও নয়”। কিন্তু এদেশে তা নয়। গত প্রায় ৮/১০ বছর থেকে নিউইয়র্ক নগরীর মুসলমানেরা নবপ্রজন্মের এই অল্প বয়সী হাফেজদের পেছনে দাঁডিয়ে তারাবির নামাজ পড়ছে। যা কিনা আমাদের দেশ বা গোটা উপমহাদেশেই কল্পনা করা যায় না।

নিউইয়র্ক নগরীতে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত অনেকগুলো মসজিদেই হেফজখানা খোলা হয়েছে। তাছাড়াও নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী বাফেলোতে বিশাল বড় একটি মাদ্রাসা তৈরি করেছে আফ্রিকার মুসলমানেরা। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সাথেই। ছাত্র-ছাত্রীদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় অনেক দূর-দুরান্তের রাজ্যসমূহ থেকেও অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের বাফেলো মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন।

ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পূর্বের ভীতি আজ আর নেই। এদেশের স্কুল-কলেজ হাসপাতালসহ নানান চাকরির স্থলে আজকাল দেখা যায় হিজাব পরিহিতা মেয়েদের। দেখে বড় ভালো লাগে মার্কিন মুল্লুকে জন্ম নেওয়া ভবিষ্যত প্রজন্মকে। আমার প্রাণভরা দোয়া রইলো এই প্রজন্মের জন্য। যারা এই লেখাটি পড়বেন তারাও সবাই যেনো অভিবাসীর দেশের এই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দোওয়া করেন।

লেখক- আহসান হাবীব, নিউ ইয়র্ক প্রবাসী ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ