আজ থেকে দুই যুগ আগে চাকরি পেয়েছিল সে। বেতন স্কেল ১২০০ টাকায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ প্রকল্পের চাকরি। তার নাম আবজাল হোসেন। ১২০০ টাকা বেতনের চাকরি যে কারো কারো জন্য আলাদীনের চেরাগের সমতুল্য সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে এই আবজাল। দুর্নীতিকে রীতিমত ‘শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে’ ২৪ বছরেই ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করে নিয়েছে সে! আপনি ভুল পড়েননি, দুর্নীতির নবসম্রাট আবজালের অর্জন ১৫০০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে দুর্নীতির সমস্যা অনেক বেশি প্রকট। ব্যাংকখাত, শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে শিক্ষাখাত দুর্নীতির ছায়া থেকে রেহাই পায়নি৷ কিন্তু, একজন কর্মচারী যে চাকরি জীবন শুরু করেছিল অস্থায়ী ভিত্তিতে, সে যখন একাই ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়, তখন বোঝা যায় দুর্নীতিবাজদের শেকড় কতটা গভীর। কিভাবে আবজাল একজন নোবডি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িয়েছে? আবজাল ধরা পড়েছে তার দুর্নীতির পরিমাণ শুনে আমরা আতংকিত হচ্ছি। কিন্তু, কারো সাহায্য ছাড়া সে নিশ্চয়ই নিজে নিজে এই পর্যায়ে আসেনি? পুরো সিস্টেমের ফাঁক গলে আবজাল কিভাবে এই জাল বিস্তার করেছে, সঠিক তদন্ত হলে নিশ্চিতভাবে হয়ত অনেক থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।
আবজাল হোসেন যেভাবে দুর্নীতির বরপুত্র হলেন: পাঁচটি সরকারি মেডিকেল কলেজের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাকরির কিছুদিনের মাথায় তাকে আনা হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের ক্যাশিয়ার পদে। তারপর প্রেষণে চলে যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখায়। এখানে একযুগের মতো সময় কাটিয়ে বদলি হন মহাখালীতে। অধিদপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তা তাকে এই বদলিতে সাহায্য করে৷
আবজালের স্ত্রীও চাকরি করত। কুমিল্লা মেডিক্যালের স্টেনোগ্রাফার পদের চাকরি দশ বছর করে অব্যাহতি নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। ২০০৯ সালে অব্যাহতি নিলেও ব্যবসা শুরু করেছিলেন ২০০৫ সালে। প্রতিষ্ঠানের নাম রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। মালিক আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসাধু কিছু ব্যাক্তিদের ছায়ায় ‘রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার নামে টাকা নিয়ে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করত। আর নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সাপ্লাই করেই তারা আত্মসাৎ করেছে কোটি কোটি টাকা!
আবজাল টেন্ডার বাণিজ্যকেও নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনাকাটার টেন্ডার থেকে শুরু করে বদলি বাণিজ্য, দুর্নীতি করার সবগুলো সুযোগ সে কাজে লাগিয়ে বাগিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। তার সম্পদের হিসাব বোধহয় সে নিজেই বলে শেষ করতে পারবে না। ১২০০ টাকার কর্মচারী আঙ্গুল ফুলে যখন কলাগাছ হয় তখন তার হাতে রোলেক্স ঘড়ি, আঙ্গুলে হীরার আংটি থাকাই স্বাভাবিক।
ঢাকা, ঢাকার বাইরে ফ্ল্যাট, প্লটের হিসাব বাদই দিলাম, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এই বাটপার দেশের বাইরেও সম্পদের পাহাড় বানিয়ে নিয়েছে। মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র কোথায় নেই আবজালের সম্পদ! মালয়েশিয়ায় ২ একর জমি, কানাডায় ক্যাসিনো, ফার্ম হাউজ, যুক্তরাষ্ট্রে হোটেল, অস্ট্রেলিয়ায় ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা, বাড়ি- কি করেনি আবজাল? বাংলাদেশের সচিব, মন্ত্রীরা যে গাড়ি ব্যবহার করেন, আবজালও ১২০০ টাকার কর্মচারী হয়ে সেই গাড়িতে চড়ে। লেক্সাস গাড়ি। বিমানে ভ্রমণ করলে বিজন্যাস ক্লাসের টিকেট ছাড়া অন্য কিছুতে তার এবং তার স্ত্রীর পোষায় না। সারাদেশে শতাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট আছে তার নামে, তার আত্মীয়স্বজনের নামে!
একজন আবজাল যদি ১২০০ টাকা কর্মচারী থেকে ১৫০০০ কোটি টাকার কুমির বনে যেতে পারেন, একজন নোবডি যদি আঙ্গুল ফুলে তালগাছ হয়ে যেতে পারেন, তাহলে গোটা স্বাস্থ্য খাত কিভাবে চলছে সেটা ভেবেই তো আতংকিত হতে হয়। এমনিতেই আমাদের দেশের সরকারি মেডিকেলগুলোর অবস্থা আশাব্যাঞ্জক নয়। দালালের খপ্পরে এম্বুলেন্সগুলো পর্যন্ত আটক থাকে। হাসপাতালের ডাক্তার দেখানোর টিকেট বিক্রি করতে দেখা যায় দালালদের। দুইটা না বাজতেই অনেক ডাক্তার বেরিয়ে যান। তারউপর যন্ত্রপাতিও প্রায়ই শোনা যায়, নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এগুলো সাধারণ চালচিত্র। যে কেউই দেখে থাকবেন।
কিন্তু, ভিতরে ভিতরে এই খাতজুড়ে দুর্নীতি কতটা গভীরে পৌঁছে গেছে সেটা বোঝা যায় আবজাল দম্পতির কীর্তিতে। কে দেখবে, কে রুখবে এদের? আমাদের দেশের বড় বড় নেতাদের তো আর এসব মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে হয় না। তারা সামান্য জ্বর হলেও দৌড় দেন সিঙ্গাপুরে, আমেরিকায়। অনেক মধ্যবিত্তও আজকাল দেশের স্বাস্থ্যসেবার উপর আস্থা রাখতে পারেন না। তারা বরং কষ্ট স্বীকার করে হলেও ভারতে যান। ভারতে আমাদের দেশ থেকে মেডিকেল ভিসায় এখন প্রচুর মানুষ যাচ্ছে। কারণ, স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা, দূর্ণীতি তাদের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আবজালকে বরখাস্ত করেছে। দুদক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বামী-স্ত্রীর বিদেশ চলাচলে। তবে, ওই খাতজুড়ে আরো কত আবজাল গাপটি মেরে আছে তাদের বিরুদ্ধে চিরুনী অভিযান চালানো সময়ের দাবি এখন। আবজালের নেতৃত্বে যেসব নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে, ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি নিয়েছে তারাও কি সিস্টেমের কল্যানে আবজালের ভূমিকা নেবে না? এই গোটা সিস্টেমটাকে ধুয়ে মুছে সাফ করার জন্য কঠিন এক শুদ্ধ অভিযান দরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন এক্ষেত্রে ধন্যবাদ পেতে পারেন, তারা এত বড় দুর্নীতি তদন্তের আওতায় এনেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে হবে। দুর্নীতিবাজদের দিতে হবে কঠোর বার্তা।
সৌজন্যে- বাংলাদেশ টুডে