“আমার ভাইয়ের একটাই দোষ, বিএনপি করত। পারিবারিকভাবেই আমরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। গত ৪ ডিসেম্বর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত তিনটি গাড়িতে করে র্যাব-১ আমার ভাইসহ কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যায়। আমরা দেরি করিনি। আধ ঘণ্টার মধ্যে মা-বাবা-বোন নিয়ে র্যাব-১ এ যাই। নয় মাস ধরে ওরা মিথ্যে বলছে। বলছে, ওরা কিছু জানে না। ওরা যদি তুলে নিয়ে নাও যায়, ওরা খুঁজে দিক।” আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘স্বজনদের ব্যথা: গুম, খুন, নির্যাতন আর না’ শীর্ষক এক সম্মেলনে কথাগুলো বলছিলেন নয় মাস ধরে নিখোঁজ সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলাম।
গত বছরের ৪ঠা ডিসেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লক থেকে ঢাকা মহানগরের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমন (৩৪), তাঁর খালাতো ভাই জাহিদুল করিম ওরফে তানভীরসহ (৩০) ছয়জনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।। বাকি চারজন হলেন পূর্ব নাখালপাড়ার বাসিন্দা আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম (২৪), পশ্চিম নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল (২৪), মুগদার আসাদুজ্জামান ওরফে রানা (২৭) ও উত্তর বাড্ডার আল আমিন (২৬)।
সানজিদা বলছিলেন ভাইকে ফিরে পাওয়ার অসহনীয় প্রতীক্ষার কথা, ‘আমার বৃদ্ধ মা প্রতি সপ্তাহে একবার র্যাবের ডিজি, এডিজি, সিইওর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। চিত্কার করে কাঁদে। আমার ভাইয়ের মেয়েরা অপেক্ষায় থাকে। এ দৃশ্য অসহনীয়। আমার ট্যাক্সের টাকায় প্রতিরক্ষা বাহিনী চলে। ওরা কেন উত্তর দেবে না? আমাদের একটাই দাবি, হয় ফেরত দিন, নয় উদ্ধার করে দিন। ফেরত আপনাদের দিতেই হবে। উত্তর দিতেই হবে। আমাকে জানতেই হবে, ওরা কোথায়?”
উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এম এ আদনান চৌধুরী (২৮)। সাজেদুলরা নিখোঁজ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর রাত দুইটার দিকে শাহীনবাগের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপি সমর্থক আদনানকে। বাব রুহুল আমিন হাওলাদার জানেন না কি তাঁর ছেলের অপরাধ। র্যাব পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলেও নিখোঁজের পর থেকে কোন কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নি সেটা। রুহুল আমিন যেন নিজেকেই অবিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছেন এখন, “র্যাবের কাছে গেলাম, ডিবির কাছে গেলাম, থানায় গেলাম। কোথাও নেই আমার ছেলেটা। প্রশাসন তুলে নেওয়ার কথা অস্বীকার করে। তাহলে আমার সামনে দিয়ে আমার ছেলেকে তুলে নেওয়ার যে ঘটনা ঘটল, সেটা কী? আমার ছেলে কী অপরাধ করেছিল যে গায়েব হয়ে গেল?”
প্রায় একই প্রশ্ন বিএনপি দলীয় সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলামের মেয়ে মাশরুফা ইসলামের, “আমার বাবাকে কী করা হয়েছে, আমরা জানি না। তিনি জীবিত, না তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে—তাও জানি না। এ ঘটনায় মামলা করা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। এর পরও নানা রকমের চাপ রয়েছে মামলা না চালানোর জন্য।”
গত বছরের ২৭ নভেম্বর রাতে ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে লাকসাম থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে সদর দক্ষিণ উপজেলার আলী শহর নামক স্থানে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায় লাকসাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু, লাকসাম পৌরসভা বিএনপি সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ ও জসিম উদ্দিনকে। এদের মধ্যে জসিম উদ্দিনকে উদ্ধার করা গেলেও খোঁজ মেলে নি বাকি দু’জনের। কান্না ও ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে মাশরুফা প্রশ্ন রাখেন, “আমরা কেউই দেশে স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারছি না। নিজের দেশেই নাগরিকেরা গুম হচ্ছেন, তাহলে কী লাভ হলো স্বাধীন হয়ে?”
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ ও গুম-খুন হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা অংশ নেন। দেশের মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতারা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর প্রতি সংহতি ও সমবেদনা জানান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নূর খান লিটন।
সম্মেলনে দেয়া বক্তৃতায় বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদিন মালিক সকল গুমের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার পণ করে বলেন, “প্রতিটি গুমের বিচার হতেই হবে। না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না। এটা আমাদের দেশ। এই দেশে এভাবে মানুষকে ধরে নিয়ে যাবে, আর সবাই কান্নাকাটি করবে, এটা হবে না। দেশ বিচার না হলে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।”
জানমালের নিরাপত্তার সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রবীণ আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, “খুন-গুমের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপস হতে পারে না। আজকের এই অনুষ্ঠান প্রমাণ করে জনগণের ভয় ভেঙেছে। এই বিষয়টি আরও সুসংহত করতে হবে। এটা এও প্রমাণ করে যে আমরা নির্ভয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। আমরা কোনো প্রকার অন্যায় মেনে নেব না। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা কোনো দল নয়, কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আছে বলে মনে করি না। এখানে দলমত নির্বিশেষে সবাই খুন-গুমের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছে।”
প্রসঙ্গত, ২০১১ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।