চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পণ্য রফতানিতে রেকর্ড গড়েছে কুমিল্লা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (ইপিজেড)। গত তিন বছরে এখান থেকে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। চলতি বছর রফতানি গত তিন বছরকে ছাড়িয়ে এক হাজার মিলিয়ন ডলার হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুমিল্লা ইপিজেডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাত মাসে (জুন থেকে জানুয়ারি) ৬১৬ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। বাকি পাঁচ মাসে এটি এক হাজার মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত যেতে পারে। বিগত বছরগুলোতে এমন রফতানির রেকর্ড নেই। এই সাফল্য এবারই প্রথম।
ইপিজেড সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ চর্থা এলাকায় ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা ইপিজেড। এখানে ৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে কর্মরত আছেন ৫০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত তিন অর্থবছরে পণ্য রফতানি করেছে দুই হাজার ৯৩৩ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত রফতানি না বেড়ে কমে গিয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮১৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৯০ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১১ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য যায়। দুই বছরের ব্যবধানে প্রায় ১০৩ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার কমে যায় রফতানি।
দুই বছরের ব্যবধানে পণ্য রফতানি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে কুমিল্লা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এর মধ্যে একটি কারণ ছিল করোনার ধাক্কা। আরেকটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। করোনায় আমরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের রফতানি কমে যায়। অনেক কাঁচামাল আসে ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল আনায় যেমন বাধার সৃষ্টি হয়েছে, তেমন রফতানিকারক দেশগুলো হাত গুটিয়ে নেয়। যে কারণে ইপিজেডের পণ্য অর্ডার কমে যায়। তবে বড় প্রভাব পড়েনি। আমরা বিভিন্নভাবে রফতানি চালিয়ে গেছি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক।’
যে কারণে বেড়েছে রফতানি
চলতি বছর রফতানি বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কুমিল্লা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহকারী পরিচালক এএইচএম এরশাদুর রহমান বলেন, ‘করোনাকালীন অনেক অর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। তখন কেউ কারও দিকে তাকায়নি। একটা খারাপ অবস্থা ছিল। অন্যদিকে যুদ্ধরত দেশ আমদানি-রফতানি ছেড়ে সামরিক দিকে নজর দেয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্গে অনেক দেশ ব্যবসায় যুক্ত। যে কারণে শুধু কুমিল্লা ইপিজেডে নয়, সব দেশকে বিপাকে পড়তে হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় পণ্য রফতানি বেড়ে যায়।’
একই কথা বলেছেন ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব। তিনি বলেন, ‘কুমিল্লা ইপিজেডে প্রতিনিয়ত কোটি ডলারের পণ্য রফতানির বিষয় থাকে। এতে একজন রফতানিকারক ভাগ্য বদলে দিতে পারেন। আবার কোনও একটি ছোট দুর্ঘটনা যেকোনো পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে। যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যা এখনও চলছে। তবে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আমাদের রফতানি বেড়েছে। কিন্তু রফতানির খাত বাড়েনি। আগে যারা আমাদের পণ্য নিতেন এখনও তারাই নিচ্ছেন, তবে পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
কুমিল্লা ইপিজেডে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় এবং যেসব দেশে যায়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫ শতাংশ পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সুইডেন, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তবে রফতানি বেশি হয় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে।
চলতি বছর রফতানি গত তিন বছরকে ছাড়িয়ে এক হাজার মিলিয়ন ডলার হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা
বিনিয়োগে শীর্ষে আছে অন্তত ১৫টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিনিয়োগ আছে কুমিল্লা ইপিজেডে।
উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে, গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ, সোয়েটার, ফেব্রিক্স, টেক্সটাইল ডাইজ অ্যান্ড অক্সিলিয়ারিজ, ইলেকট্রনিকস পার্টস, এলিমেনেটিং ব্রাশ, ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার অ্যাপারেলস, ক্যামেরা কেস, ব্যাগ, ইয়ার্ন, প্লাস্টিক পণ্য, হেয়ার ও ফ্যাশন অ্যাকসেসারিজ, মেডিসিন বাক্স, আই প্যাচ, কার্পেট, গ্লাভস, লাগেজ, মেডেল, পেপার প্রোডাক্টসহ বিভিন্ন পণ্য।
রফতানিতে এগিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান
কুমিল্লা ইপিজেডে তিন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ক্যাটাগরিতে অর্থাৎ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৩০টি, বি ক্যাটাগরির অর্থাৎ যৌথ মালিকানাধীন সাতটি প্রতিষ্ঠান। সি ক্যাটাগরির বা দেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ১১টি। এর মধ্যে রফতানির শীর্ষে রয়েছে পাঁচ প্রতিষ্ঠান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এ ক্যাটাগরির মেসার্স কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড। চীনা মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালে ব্যবসা শুরু করেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯১ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্য রফতানি করেছে। এ ছাড়া বেশি রফতানিকারক বাকি চার প্রতিষ্ঠান হলো- সুরতি টেক্সটাইল (বিডি) লিমিটেড, নাসা তেইপ ডেনিমস লিমিটেড, জিংস্যাং সুজ (বিডি) লিমিটেড ও ইস্টপোর্ট লিমিটেড।