তিন বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে চেপে বসা ডলার–সংকট কাটতে শুরু করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ববাজারের ধাক্কা লেগেছিল দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাতে। জ্বালানি থেকে খাদ্যপণ্য, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জেরে বেড়েছিল আমদানি খরচ। ডলারের তীব্র সংকট ও হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি ডেকে এনেছিল মূল্যস্ফীতির অসহনীয় যন্ত্রণা।
ডলারের অস্থির বাজারে এখন অনেকটাই স্বস্তি ফিরেছে। তাতে ইতিবাচক ধারায় ফিরছে আর্থিক সূচকগুলোও। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কাঁটা এখনো সরেনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর থেকে।
ডলারের বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে পুরোপুরি স্বাভাবিক মনে করছেন না অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতি এখন অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। কমেছে শিল্পের কাঁচামালসহ আমদানির চাপ। এ কারণে ডলারের চাহিদাও কম। তাই ডলারের বাজারে কিছুটা স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। এ কারণে এটিকে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী গণমাধ্যমকে বলেন, ডলারের বাজার নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা দেশের জন্য ভালো। তবে দেখতে হবে, বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কারণে যাতে ডলারের দাম খুব বেশি বেড়ে না যায়। এখন অর্থনীতি স্থিমিত অবস্থায় আছে। আমদানির চাপ কম, ফলে ডলারের চাহিদাও কম। এ জন্য ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে গেছে, তা এখনই বলা যাবে না।
মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, ‘আমরা যদি রিজার্ভ বাড়াতে পারি, তাহলে একটা স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। অর্থনীতিতে এখন অন্যতম সমস্যা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগের অভাব। বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। এ কারণে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ ও প্রবাসী আয় বাড়াতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’
ডলার–সংকট কি কাটছে
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডলার–সংকট কাটাতে বড় ভূমিকা রেখেছে অর্থ পাচার রোধে নেওয়া পদক্ষেপ। নজরদারি বৃদ্ধির ফলে বৈধ পথে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। এতে আর্থিক হিসাবে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ ও রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এ ছাড়া পুরোনো আমদানি দায় পরিশোধ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ কমে গেছে। এ অবস্থায় ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার নীতি অব্যাহত থাকলেও ভবিষ্যতে বড় ধরনের অস্থিরতা ফিরে আসার আশঙ্কা কম বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। বিদেশি ঋণ ছাড়াই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতিশীলতা একটি ইতিবাচক দিক বলেও মনে করছেন তাঁরা।
৯ মাস ধরে ডলারের দাম ঘুরেফিরে ১২৩ টাকার মধ্যে রয়েছে। চলতি মাসে মুদ্রার মান বাজারভিত্তিক করার পরও দাম খুব বেশি হেরফের হয়নি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও স্থিতিশীল রয়েছে। ইতিমধ্যে রিজার্ভ থেকে ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের আমদানি দায় শোধ করা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ঋণের কিস্তিসহ সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। এ অর্থ যোগ হলে রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
আয় কতটা বেড়েছে
ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় মাধ্যম প্রবাসী ও রপ্তানি আয়। এ ছাড়া সেবা, বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমেও দেশে ডলার আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১ হাজার ৭৩৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত ৯ মাসে প্রবাসী আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৭১ কোটি ডলার বা ২৭ দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া জুলাই-মার্চ সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৩৮৭ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৯ শতাংশ বেশি। ডলারের আয়-ব্যয়ের ব্যবধানও ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাতে বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতির ধারা অব্যাহত আছে। গত মার্চ শেষে চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে ৬৬ কোটি ডলারে নেমেছে। গত বছরের মার্চে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৩৯ কোটি ডলার।
চলতি হিসাবের সামান্য ঘাটতি থাকলেও আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের মার্চ শেষে ৯ মাসে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ১৩১ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল মাত্র ৯০ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতি হয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৭৬ কোটি ডলার।
ডলার ও রিজার্ভ পরিস্থিতি
ডলার বাজার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে খুব কম। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১২৩ টাকা পর্যন্ত দামে ডলার কেনাবেচার সুযোগ দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো সেটা অনুসরণ করে। সরকার পরিবর্তনের পর নানা বিধিনিষেধ ও সতর্কতার কারণে অর্থ পাচারের চাহিদা কমে আসে এবং অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়েছে ডলারের দামে। এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করে উল্টো ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বড় দায় পরিশোধের পরও রিজার্ভ স্থিতিশীল রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়নের ওপর। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার, বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২০ বিলিয়নের বেশি।
ডলারের বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আমদানিতে এখন আর আগের মতো কড়াকড়ি নেই। এখন আমদানিকারকেরা ব্যাংকে গিয়ে ডলার পাচ্ছেন। গত জুলাই-মার্চে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত বছরের মার্চে শেষে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশের বেশি।
বিদেশি মুদ্রাবাজারের পরিস্থিতি সম্পর্কে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ডলারের বাজার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। ডলারের দামকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ, আমদানি চাপ এখন কম। আশা করা যায়, ডলারের বাজার স্থিতিশীল থাকবে। প্রবাসী ও রপ্তানি আয় ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।