বর্তমান উজবেকিস্তানের বোখারা শহরে আব্বাসীয় খলিফা আল আমিনের শাসনামলে ১৯৪ হিজরির ১৩ শাওয়াল মোতাবেক ৮০৯ সালে জুমার নামাজের পর যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বোখারি (রহ.) এর জন্ম। অধিকাংশ আলেমের মতে, ইমাম বোখারির উপনাম ছিল আবদুল্লাহ এবং তিনি এ নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেন। ইমাম বোখারি (রহ.) প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তার মায়ের কাছ থেকে। অতঃপর পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে ভর্তি হন। ছয় বছর বয়সেই কোরআনের হাফেজ হন, ১০ বছর বয়সে মক্তবের পড়াশোনা শেষ করেন। (সিরাতে ইমাম বোখারি)।
ইমাম বোখারি (রহ.) বাল্যকাল থেকেই প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেই তিনি ইলমে হাদিসের জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ করেন। ছাত্র জীবনে ইমাম বোখারি (রহ.) বাগদাদে গমন করেন, সেখানে তিনি মাত্র ১৬ দিন অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি ১৫ হাজারেরও বেশি হাদিস মুখস্থ করে ফেলেন। ইমাম বোখারি (রহ.) বাল্যকালেই ৭০ হাজার হাদিসের হাফেজ ছিলেন। তিনি ১ লাখ সহিহ হাদিস ও ২ লাখ গাইরে সহিহ হাদিস মুখস্থ করেন। তিনি যে কোনো কিতাব একবার পড়লে বা দেখলেই তা মুখস্থ হয়ে যেত। এটা তার বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির প্রমাণ।
ইমাম বোখারি (রহ.) হাদিস গ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করেন। নির্ধারিত নীতিমালা যাচাই-বাছাই করে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হলেই কেবল তার হাদিস গ্রহণ করতেন। ইমাম বোখারি (রহ.) এর ব্যাপারে ইমাম হাকেম (রহ.) বলেন, তিনি রমজানে প্রত্যেক দিন একবার কোরআন খতম করতেন এবং প্রত্যেক তিন রাতে একবার কোরআন খতম করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা- পৃ. ৪৩৯)। ইমাম বোখারি (রহ.) অত্যন্ত একাগ্রচিত্তে বিনয়ের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন। একদা নামাজ আদায়রত অবস্থায় তার জামার নিচে ভিমরুল ঢুকে কামড়াতে শুরু করে। এতে তিনি নামাজ ছেড়ে দিলেন না। নামাজ শেষে দেখা গেল, ভিমরুল ১৭ স্থানে হুল ফুটিয়েছিল। হাফেজ ইবনে ফাসরি (রহ.) বলেন, তিনি বেশি দান করতেন। স্বল্পভোজী ছিলেন এবং বেশি বেশি ইবাদত করতেন। ইমাম বোখারি (রহ.) ১৬ বছর বয়সে তার ভাই এবং মায়ের সঙ্গে হজ করেন। এরপরও তিনি কয়েকবার হজ করেন। তিনি কখনও গিবত করেননি। এসবই ইমাম বোখারির খোদাভীতির উত্তম নিদর্শন।
ইমাম বোখারি (রহ.) কোনো মাজহাবের অনুসারী ছিলেন কিনা এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেছেন, তিনি শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী, কারও মতে হাম্বলি। তবে তিনি মাসয়ালার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ মাসয়ালাগুলোতে ইমাম শাফেয়ির সঙ্গে একমত ছিলেন। তবে একথা বলা প্রয়োজন মনে করছি যে, ইমাম বোখারি (রহ.) কে কোনো মাজহাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা মোটেই সঠিক কাজ বলে মনে হয় না। কেননা, তিনি নিজেই একজন মুজতাহিদ ছিলেন। তার ইজতেহাদ করার ক্ষমতা ছিল। কোরআন-হাদিসের পর্যালোচনা করে আমল করতেন। বিভিন্ন মনীষী ইমাম বোখারি (রহ.) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক মন্তব্য করেছেন। তার মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মন্তব্য তুলে ধরছি। ইমাম বোখারির ওস্তাদ ইয়াহইয়া ইবনে জাফর আল বাইকান্দি (রহ.) বলেন, আমি যদি সক্ষম হতাম আমার হায়াতের বিনিময়ে ইমাম বোখারির হায়াত বাড়াতে, তাহলে আমি তাই করতাম। কেননা, আমি মারা গেলে শুধু একজন লোকই মারা যাবে আর ইমাম বোখারি মারা গেলে ইলম চলে যাবে। (তারিখ-ই-বাগদাদ)। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, তিনি এমন এক জ্ঞানের সাগর যার কোনো তীর বা উপকূল নেই। ইমাম বোখারি (রহ.) বোখারি শরিফ ছাড়াও অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ আল জামে কাবির, আল জামে সগির, আততারিখুল কাবির, কিতাবুস সুনানে ফিল ফিকহি, তাফসিরে কাবির, আদাবুল মুফরাদ, ফিল আকাইদ ওয়াত তাওহিদ ইত্যাদি। আলোকিত বাংলাদেশ।