Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ব্র্যান্ডভ্যালু কেন এত মূল্যবান?

একটি প্রতিষ্ঠানের অধিকারে থাকা অনেক সম্পদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এর ব্র্যান্ডভ্যালু। কিন্তু কেন ও কীভাবে তা এত গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই—

গত জুলাইয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল টোব্যাকো যখন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ৭ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করার ঘোষণা দেয়, তখন প্রধান নির্বাহী এলিসন কুপার একটি সিদ্ধান্তে একেবারেই অনঢ় ছিলেন, তা হচ্ছে এ অর্থ দিয়ে কিছুতেই অন্য প্রতিষ্ঠান কেনা যাবে না। তার বদলে রেনল্ডস আমেরিকান ও লরিলার্ডের সঙ্গে ত্রিমুখী চুক্তির মাধ্যমে একটি কারখানা, একদল দক্ষ কর্মী ও কিছু ব্র্যান্ড পেয়ে যায় ইম্পেরিয়াল। ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে উইনস্টন ও ব্লু’কেই বাজার দখলের বড় চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে প্রতিষ্ঠানটি।

chardike-ad

brand valueশুধু ব্র্যান্ডগুলোর পেছনে ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে ইম্পেরিয়ালের পদক্ষেপকে কেউ অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বিপণন জগতে কাজ করা যে কেউ জানেন, একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে সেটির মূল্য প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বা যন্ত্রপাতির চাইতেও অনেক মূল্যবান হয়ে থাকে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলওয়ার্ড ব্রাউনের হিসাবে, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের কোম্পানিগুলোর মোট সম্পদের মূল্যমানের ৩০ শতাংশই তাদের ব্র্যান্ডের পেছনে জমা হয়ে আছে। সবাই জানে, একটি সাধারণ পোলো শার্টের চেয়ে র্যালফ লরেন শার্ট কেন দামি অথবা লোগো ছাড়া কোকাকোলা শুধুই একটি সাধারণ পানীয়।

তার পরও ব্র্যান্ডের মূল্যমান ও তার গুরুত্ব নিয়ে এখনো বিতর্ক বিদ্যমান। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতপত্রে ব্র্যান্ডকে সম্পদ হিসেবে দেখানো হয় না। তাই একেকটি প্রতিষ্ঠান ভিন্নভাবে ব্র্যান্ডের গুরুত্বকে তুলে ধরে। এক পক্ষের যুক্তি, ক্রেতা বা গ্রাহকদের মাঝে আনুগত্যকে উজ্জীবিত করার মধ্যে ব্র্যান্ডের সফলতা নিহিত থাকে। যেমন: অনেকে অ্যাপলের আইফোন কেনার জন্য পাগল হয়ে থাকে। অন্য পক্ষের দাবি, ব্র্যান্ড নিয়ে চিন্তা করার সময় ক্রেতাদের নেই। অতীতে ব্র্যান্ডের অনেক গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে সেগুলো ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য ব্র্যান্ডভেদে পরিস্থিতি ভিন্ন। কোনো কোনো ব্র্যান্ড বিশেষ বৈশিষ্ট্যসূচক পরিচয়ের জন্য বিখ্যাত, যেমন: অ্যাপলের আইম্যাক পিসি। আবার কিছু কিছু ব্র্যান্ড তার সমগোত্রীয় পণ্যের মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, যেমন: কোকাকোলা। ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ব্র্যান্ডভ্যালু তাদের গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা ও সেবার মানের ওপর অধিক নির্ভরশীল।

আশির দশকে বিক্রি বাড়াতে ভোক্তাপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় ডিসকাউন্ট দেয়ার হিড়িক পড়লে প্রথম ব্র্যান্ড ভ্যালু ধারণাটির সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে ধৈর্যসহকারে ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর পথে পা বাড়াতে আগ্রহী হয় অনেক প্রতিষ্ঠান। এ পথে শুধু নিজস্ব গ্রাহক বা ক্রেতাদেরই ধরে রাখা সম্ভব হয় না, নতুন ক্রেতাদের মন জয় করা যায় এবং এটি নতুন বা অন্য পণ্য বাজারজাতে এক শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই ধারণা ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন শিক্ষাবিদ ডেভিড আকের। তিনি ব্র্যান্ডভ্যালুর তিনটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন: ব্র্যান্ড সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতা, সেটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মানদণ্ড (বিএমডব্লিউর সঙ্গে জড়িত জার্মান প্রকৌশলজ্ঞান, টয়োটার সঙ্গে কম দামি গাড়ি) এবং আনুগত্য। তার দৃষ্টি, ব্র্যান্ডিং নিয়ে যাবতীয় বিতর্ক আসলে এ তিনটির গুরুত্ব নিয়ে।

বিজ্ঞাপন সংস্থা সাচি অ্যান্ড সাচির মতে, আনুগত্যই সবার আগে। অ্যাপল ও কোকাকোলা এমন কিছু ট্রেডমার্ক যা ‘যুক্তিতর্কের বাইরে আনুগত্য তৈরি করে।’ এদের আছে অগণিতসংখ্যক ভোক্তাগোষ্ঠী যারা শুধু আনুগত্যের ওপর ভর করে চোখ বন্ধ করে সেসব পণ্য কেনে। অন্যদিকে একই ধরনের আনুগত্য বা ‘আবেগী বন্ধনের’ কারণে একটি ব্যাংকে গ্রাহকরা তাদের টাকা জমা রাখেন বলে মনে করেন এলিসন কুপার। তার দৃষ্টিতে ব্র্যান্ড অনেকটা ইন্স্যুরেন্স পলিসির মতো কাজ করে।

ব্র্যান্ডকে নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, এটি ‘পছন্দের শর্টহ্যান্ড’। অর্থাত্ পণ্যের সমুদ্রে সঠিক পণ্যটি কিনতে ব্র্যান্ড ভ্যালু ভোক্তাকে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে আনুগত্য বা আবেগের চাইতেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ব্র্যান্ডের প্রতি ভোক্তাদের সচেতনতাকে। যেমন: ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক বায়রন শার্প মনে করেন, ক্রেতাদের অভিজ্ঞতার কারণে ব্র্যান্ড হিসেবে অ্যাপল কম্পিউটার তার অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে, আবেগ বা আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে নয়। বিখ্যাত মোটরসাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হারলে ডেভিডসন তার নিবেদিত ভক্তকুলের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এমন ভক্তকুল তার মোট ক্রেতার মাত্র ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানটির মোট রাজস্বে অবদান রাখে মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

শার্পের মতে, ‘শারীরিক ও মানসিক উপস্থিতি’ একটি ব্র্যান্ডের গুরুত্ব নির্ধারণ করে। অর্থাত্ এক্ষেত্রে নিকটবর্তী স্থানে ব্র্যান্ডগুলোর উপস্থিতি জরুরি। টিভি বা গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বা প্রথাগত বিপণন পন্থার মাধ্যমে এ ব্র্যান্ড ভ্যালু অর্জন করা যায়। শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ক্যালগের বিপণন শাখার পরিচালক জেন ঘোষের মতে, ‘আনুগত্য কার্যকর, তবে সবসময় নয়। এটি কখনো বলে না যে ভোক্তারা ব্র্যান্ড নিয়ে বিশেষ আবেগী। তারা সেই ধরনের পণ্য বা ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি আনুগত্য দেখায়, যেগুলো দোকানে বা তাদের স্মৃতিতে সহজে হাজির হয়।’

অনেকেই বলে থাকেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে ই-কমার্সের আগমনে ফলে ব্র্যান্ড ধারণাটিরই অবসান হয়েছে। কারণ ভোক্তারা অনলাইনে পর্যাপ্ত তথ্য পেয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে পারছেন। কিন্তু শার্পের মতে তা হয়নি। তিনি বলেন, ইন্টারনেট আসায় লোকজন বরং আরো অলস হয়ে পড়েছে। কোনো পণ্য নিয়ে ঘাটার সময় বা ইচ্ছা তাদের নেই। উপরন্তু পণ্যগুলোর রিভিউও ভালো নয়। এক্ষেত্রে সঠিক ও পছন্দনীয় পণ্য বাছাই করতে ব্র্যান্ডগুলো একপ্রকার গাইড হিসেবেই কাজ করে। তাই বলা যায়, এই উন্মুক্ত তথ্যের যুগেও ব্র্যান্ডগুলো ভালোভাবেই টিকে থাকবে। তবে কীভাবে বা কেন টিকে থাকবে, সে নিয়ে বিতর্কও চলতে থাকবে সমান্তরালে। ইকোনমিস্ট অবলম্বনে/ বণিকবার্তার সৌজন্যে।