-এই ইফতি এই
সাত সকালে কার হাকডাক, মেজাজটা এমনিতেই খারাপ হয়ে গেল, কি সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম আমার প্রথম ক্রাশ মনিকা বেলুচ্চি এর সাথে!
-ওহ নাজমুল!
-তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস যে? সবাই উঠে পড়েছে, আর তুই কিনা এখনো বিছানাতে গড়াগড়ি খাচ্ছিস! কত কিছু বাকি? ১১টার ভেতরে বের হতে হবে সবাইকে!
বন্ধুর হাকডাক এ উঠে পড়লাম ঝটপট। কোরিয়াতে ব্যস্ত জীবনের মাঝে দুই দিন ছুটি পেয়েছি, তাই নিয়ে কত প্রোগ্রাম! শেষ পর্যন্ত ঠিক হল আমরা ইনছন বীচ এ যাচ্ছি। আজকে তার প্রথম দিন। মানুষ সব মিলিয়ে আমরা নয় জন। আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে বীচ খুব একটা দূরে নয়। বাস এ গেলে খুব বেশী হলে ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। আগে থেকেই মোটেল বুক করে রাখা হয়েছে। প্রাথমিক কেনাকাটা ও শেষ। অনেক খাবার কেনা হয়েছে। আজ রাতে খাবার শেষই হবে না। সবাই জিনিসপত্র নিয়ে হাজির বাসায়। শুধু আমার নিজের গোছানোটা বাকি রয়ে গেছে। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে এক ছুট লাগালাম ওয়াশরুমের দিকে। আজকে কি এক অজানা কারণে সব কিছুই ভাল লাগছে। কোরিয়া এর এই একঘেয়ে জীবনটাকেও। ঝটপট তৈরি হয়ে নিয়ে ১১টার ভেতর বের হয়ে পড়লাম বাসস্টপ এর উদ্দেশ্য। বুচ্ছন তেকন পার্ক এ ৩০২ নম্বর বাস এর জন্য অপেক্ষা।
এদিকে আজ আতিক খুব স্টাইল করে এসেছে। ওকে খ্যাপানোর সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করল না। ওদিকে সকালে এত খাবার পরও রাব্বির ক্ষুধাটা রয়েই গেছে! এত খাবার যায় কোথায়? অগত্যা দুজনকে যাত্রাপথেই নেমে যেতে হল বার্গার কিনতে। আমার হাতে গিটার থাকায় আমি আর নামলাম না। দুপুর ১ টা নাগাদ হোটেল এ পৌছালাম। অপূর্ব! ঠিক মোটেলের সামনেই সমুদ্র। জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকালে সমুদ্রের স্বচ্ছ জলে প্রিয়তমার মুখ আঁকতে ইচ্ছে হয়! হাত মুখ ধুয়ে রান্না-বান্নার আয়োজন শুরু হল। রান্না মোটেলেই হবে। কেউ মাংস কাটছে কেউ চাল ধুচ্ছে। কেউ এক জন আর একজনকে নিয়ে খুনসুটিতে বাস্ত। সে এক অদ্ভুত পরিবেশ। সারাজীবন এমনটা থাকলে বেশ হত। রাতে আমরা বারবি-কিউ করবো সমুদ্রের পাড়ে। রাতে খাওয়ার পরে আবার সঙ্গী্ত, অভিনয়, নৃত্য এর আয়োজন রয়েছে। সবার এই উন্মাদনা দেখে মনে হয় এটাই জীবন, এর জন্যই বেঁচে থাকা!
দুপুরে সবাই খেয়ে নিলাম। বিকেল বেলা সমুদ্রের পাড়ে গেলাম সূর্যাস্তের ছবি তুলতে। ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। সূর্যটা যেন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে আমাদের পরম মমটায় রাঙ্গিয়ে দিতে চাইছে। কেন জানি উদাসীনতা মনটাকে গ্রাস করে নিলো। কিছুক্ষণ পর একা একা হাঁটতে লাগলাম সমুদ্র পাড়ে। একটু দূরে একটা নিরিবিলি জায়গা পেয়ে বসে পড়লাম। বসে কেবল পাশ ফিরেছি, অমনি দেখলাম একজন একটু দূরে বসে বালিতে কি যেন এঁকে যাচ্ছে আপনমনে। দেখে কোরিয়ান মনে হলনা, আমাদের উপমহাদেশের কোন মেয়ে হবে। সূর্যের আলো থেকে বাঁচতে চুল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার বৃথা চেষ্টা করছে মেয়েটি। মানুষ এতো সুন্দর হয় কি করে? অনেকটা হুট করেই ওর চোখে চোখ পড়লো। আমি তাও তাকিয়ে আছি অবাক বিস্ময়ে। আমার মুখে হাল্কা হাসির আভা। মেয়েটা বোধহয় হুট করেই আমার হাসির অর্থটা ধরে ফেললো! মেয়েটি কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। ভাবলাম, উঠে চলে যাই, পরে আবার কি মনে হতেই চুপটি করে বসে রইলাম। এসেই আচমকা ইংরেজিতে প্রশ্ন ছুড়ে বসলো, কারও দিকে এভাবে তাকিয়ে বোকার মত হাসাটা অভদ্রতা। আপনি কোন দেশের! এতক্ষণতো সব ভালই ছিল, দেশের কথা শুনে হাল্কা ছন্দপতন ঘটলো একটা অদৃশ্য পিয়ানোর আওয়াজে! আমি বললাম, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, আমি আপনার পেছনে একজনকে দেখছিলাম, আপনি কাবাবে হাড্ডি হয়েছেন। আপনার চেয়ে ঢের সুন্দরী মেয়ে আছে এখানে দেখার মত সময় থাকলে! আমার উত্তরটা যথারীতি ওর চেয়ে ঢের ভাল ভাষায়। মেয়েটা বোধহয় একটু কষ্টই পেল আমার কথায়! যাকগে বেশ হয়েছে, আমি চলে আসলাম সেখান থেকে। এসে দেখি ওরা পানিতে ঝাপাঝাপি করছে। একটু পরে সবাই মিলে যাত্রা করলাম হোটেল এর দিকে।
কিন্তু কেন যেন মন থেকে মেয়েটার ছবি কিছুতেই মুছতে পারছিলামনা। রুমে ফিরে আড্ডা, কার্ড খেলা চলতে থাকলো। রনি আবার শাড়ী নিয়ে এসেছে, রাতের বেলা ও শাড়ী পরে অভিনয় করবে, এই নিয়ে সবার আগ্রহের অন্ত নেই। আমি বারবি-কিউ এর জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনতে নীচে নামলাম, তখন আবার দেখলাম ওকে! আমাদের মোটেল এর পাশেই অনেকগুলো মেয়ের সাথে বসে আছে। পরে হোটেল বয় এর কাছ থেকে জানতে পারলাম, স্যামসাং থেকে একটা দল ঘুরতে এসেছে। মেয়েটা পাকিস্তানী, অন্তত হোটেল বুক এ নাম দেখে তাই বলল। আমি কেনাকাটা করে উপরে চলে গেলাম আর ভাবতে লাগলাম আপনমনে, একবার দুঃখিত বলা উচিৎ ছিল মেয়েটিকে, যাতে তার মনে আর কোন কষ্ট না থাকে আর আমিও এই বিষয়টা যেন মন থেকে ঝেরে ফেলতে পারি। যাক পরে সময় হলে ভাবা যাবে। এখন বন্ধুদের সাথে শুধুই অফুরন্ত আনন্দ। এরপর বীচে সব তৈজসপত্র নিয়ে যাত্রা করলাম সূর্য ডোবার ঠিক আগে। আদ্ভুত সুন্দর একটি আলোয় চারিদিকে ঢাকা। যাইহোক ওখানে গিয়ে যে যার কাজ এ নেমে পড়লো। অবাক ব্যাপার, আবার দেখি ঐ মেয়েটি, বান্ধবীদের নিয়ে হাঁটছে একটু দূরে। রাজ কে আমার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম।
মেয়েটির সামনে গিয়ে বললাম, একটু এদিকে আসবেন, কথা ছিল। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল সেও আমাকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য খুঁজছিল। তার আগুন গলা এবার শোনা গেলো।
বললো, যা বলার এখানেই বলুন। আমি বললাম, আমরা সবাই এখানে বেড়াতে এসেছি। চাইলে আপনারা আমাদের সাথে বারবি-কিউ তে যোগ দিতে পারেন। মেয়েটি এবার বলল, এই কথা সবার সামনে বললে তো কোন সমস্যা হবার কথা না। আমি বললাম, আপনার সাথে আজই আলাপ হলো, ওনাদের কে তো চিনিনা। তাই ভাবলাম, আপনাকে বললে যদি ওনাদেরকে আমাদের পক্ষ হতে বলে দেন। মেয়েটি এবার আশ্বস্ত হলো। বলল, ঠিক আছে, ধন্যবাদ। আমরা এখানেই ভাল আছি। আপনি আসতে পারেন। আর কি বলবো, একটু ভেবে উত্তর দিলাম, আমাদের বারবি-কিউ খেয়ে পেট ভরলেও মন ভরবেনা, কারণ আমার আমন্ত্রণ কেউ রাখেনি। আমি হয়তবা আপনাদের ঠিকভাবে আমন্ত্রণ করতে পারিনি, সে জন্য দুঃখিত। বলেই হাঁটা দিলাম। তখন পাশের মেয়েটি তাকে বলল, ভদ্রলোকটিকে এভাবে ফিরিয়ে দেয়াটা ঠিক হচ্ছেনা, আমরা তো চাইলেই তাদের সাথে গল্প করতে পারি কিছুক্ষণ। মেয়েটি তখন ক্ষেপে গিয়ে বলল, তোরা যা, আমি যাবনা। আমি এখানেই থাকবো। একটু পর পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম, মেয়েগুলো বলল, তারা আমার সাথে যেতে চায়। আমি তাদেরকে নিয়ে এসে আমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বেশকিছু ভাল সময় পার হতে লাগলো। আমি দূর থেকে দেখছি মেয়েটা এদিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি বাকি মেয়েদের কে বললাম, উনি যে একা একা বসে আছেন, খারাপ লাগছেনা ওনার? মেয়েগুলো বলল, ও নাকি এমনই! আমি খাবার বেড়ে দিলাম তাদের। এক বন্ধুকে বললাম, একটা প্লেট আমাকে দে। খাবার প্লেট নিয়ে ঐ মেয়েটার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। মেয়েটির রাগ আর দেখে কে! বলল, আমি একা থাকতে চাই কিছুক্ষণ প্লীজ। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি একটু পরেই চলে যাচ্ছি। বিকালের ব্যাবহার এর জন্য আমি দুঃখিত, আসলে আমি আপনাকেই দেখছিলাম। কেউ যখন কোন পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, যার পানি অনেক স্বচ্ছ, যে নিজেকে দেখা যায় তখন সে কি করে? দাঁড়িয়ে দেখে না নিজেকে? মেয়েটি চুপ করে রইলো। আমি আবার বললাম, আপনাকে দেখে আমার নিজের ছায়ার অংশ মনে হয়েছিল, তাই জমে গিয়েছিলাম! আপনার যদি খারাপ লেগে থাকে,আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। এই প্রথম মেয়েটা আমার দিকে ভাল করে তাকাল। কি আশ্চর্য, চোখদুটো যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা! হুট করেই হেসে ফেললো। বলল, মেয়ে পটাতে ভালই পারেন দেখছি, তো এখন কি করবো বলুন। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। বললাম কিছু করতে হবেনা আপনাকে। যা ইচ্ছে হয় করবেন, শুধু আমাকে ক্ষমা করলেই হবে। এই বলে প্লেট টা নিয়ে চলে আসছিলাম। পেছন থেকে ডাক দিল, বলল, আমি বারবি-কিউ অনেক পছন্দ করি, একটু খেতে পারি? আমি বললাম আসুন আমার সাথে। সবাই একসাথে খাবো। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসে ঘণ্টা খানেক আড্ডা, গান এ সময় পার করে চলে আসলাম রুমে।
এরপর আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই রাত দুইটা বেজে গেলো। সবাই তখন ঘুমাতে গেল। সবাই সকালে বীচে যাবে এই প্ল্যান নিয়ে। আমার সারা টা রাত ঘুম হলনা। চোখে শুধু ওর ছবি ভেসে রইলো। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন সকাল ১০ টা। উঠে দেখি সবাই বীচ এ চলে গেছে আমাকে ফেলে। এক দৌড় এ বীচে গেলাম। সবাইকে ঝাড়ি দিলাম আমাকে ফেলে আসার জন্য…উলটো আমাকে ওরা বকা দিল, বলল আমাকে অনেক বার ডাকার পরও নাকি আমি জাগিনি। যাই হোক, কিছুক্ষণ পর হোটেল এ ফিরে এলাম, এসেই ছুটলাম একটা মুখ দেখার জন্য চাতকের মত! তিন তলায় গিয়ে দেখলাম রুম খালি, শুনলাম চেক আউট করে সকালেই চলে গেছে ওরা! সোফাতে ধপাস করে বসে পড়লাম। কি করবো না করবো বুঝতে পারছিলামনা। একদিনের অল্প একটু দেখা যে এভাবে বুমেরাং হয়ে যাবে কে বুঝেছিল! নীচে নেমে আসার পর, হোটেল এর ম্যানেজার বললো, আপনাদের মাঝে ইফতি কে? আমি এগিয়ে গেলাম। সে বলল, আমার জন্য নাকি একটা চিঠি রাখা আছে। চিঠি টা খুললাম, তাতে লেখা –
” ইফতি,কাল রাতে সাগর পারে বারবি-কিউ পার্টিতে আপনার গান অসাধারণ ছিল,তখন কিছু বলিনি। আপনি একজন ভাল মনের মানুষ, আমার ফেসবুক আইডি দিলাম। আমাকে বন্ধু মনে করলে খুশী হব।
সারাহ”
চিঠিটা পেয়ে চুপ করে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। নাহ,সারাহ…তোমায় আমি কি ভেবেছি জানিনা, কিন্তু আমি এতটা ভাবিনি কারও জন্য। কিছু সুন্দর হয়ত থাকে দূর থেকে দেখার জন্য, অনুভবের জন্য, ছুয়ে দেখতে হয়না কখনও। তুমি না হয়, আমার খারাপ লাগার মুহূর্তগুলোতে আনন্দের রঙ হয়ে থাক, যা দিয়ে আমি নিমেষে রাঙ্গিয়ে নিতে পারি নিজেকে! যেখানেই থাকো, ভাল থেকো, সারাহ্…খুব ভালো।
চিঠিটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেললাম একটু পর। ইচ্ছে হচ্ছিলো না তারপরও কারণ মানুষের জীবনে সব ভাললাগাকে পূর্ণতা দিতে নেই। ও থাকুক আমার কাছে চিরদিন অন্যভাবে, অদৃশ্য শক্তি হয়ে যা কখনও এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তে ফুরিয়ে যাবে না,থাকবে চির নতুন চির সবুজ সবসময়।
এবার ফেরার পালা। বাস এর পেছন থেকে লিমন বলে উঠল, কিরে ইফতির মন এত খারাপ কেন? পাশ থেকে কেউ একজন বলল, কালকে ঐ মেয়েদের কথা মনে পড়ছে ওর বোধ হয়! সবাই এক সাথে হেসে উঠল। কিন্তু আমার মনের ঝড় আর থামেনা, এ ঝড় যে থামার নয়। চলুক এ মন খারাপের লুকোচুরি খেলা না হয় কালকের যান্ত্রিক জীবনের আগ পর্যন্ত!
লেখকের ইমেইল sgc.ifti@gmail.com