রবিবার । ডিসেম্বর ২১, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ২০ অগাস্ট ২০২৫, ৮:৪০ অপরাহ্ন
শেয়ার

একাকী মানুষের জন্য আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে সিউলের কনভিনিয়েন্স স্টোর


korea-news

এই স্টোরগুলো বাড়ির বসার ঘরের মতো তৈরি, যেখানে আরাম এবং সঙ্গ পাওয়া যায়। ছবি: বিবিসি বাংলা

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে একাকীত্ব মোকাবিলায় এক নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার নাম “উষ্ণ হৃদয়ের কনভিনিয়েন্স স্টোর”। এই দোকানগুলো কোনো সাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নয়, বরং একাকী মানুষদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল। এখানে মানুষজন বিনামূল্যে ইনস্ট্যান্ট রামেন নুডলস খেতে পারেন এবং অন্যদের সাথে গল্প-আড্ডা দিতে পারেন।

২৯ বছর বয়সী হি কাং প্রতিদিন আসেন এই স্টোরে। বিনামূল্যের ইনস্ট্যান্ট রামেন নুডলস খাওয়ার পাশাপাশি তিনি আড্ডা দেন সমাজকর্মী ও অন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে। কিশোর বয়সে পরিবার ছেড়ে আসার পর থেকে তিনি একা থাকেন, বেকার হওয়ায় তার তেমন কোনো বন্ধু বা সহকর্মীও নেই। তিনি বলেন, “এই স্টোর না থাকলে আমার যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা থাকত না।” হি কাং-এর মতো হাজারো তরুণ ও বয়স্ক মানুষ এই স্টোরগুলোতে এসে একে অপরের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন।

চলতি বছরের মার্চে চালু হওয়া এই উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ২০ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন, যদিও প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল বছরে মাত্র পাঁচ হাজার মানুষ আসবে। শহরের উত্তর-পূর্ব দোংদেমুন জেলায় অবস্থিত এই স্টোরে প্রতিদিন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন দর্শনার্থী আসে। বেশির ভাগের বয়স ৪০ বা ৫০ বছর বয়সের মধ্যে। তবে হি কাংয়ের মতো অনেক তরুণরাও এই সেবা নিচ্ছে।

korea-news

দক্ষিণ কোরিয়ার বয়স্ক জনগোষ্ঠী বাড়ার সাথে সাথে একাকীত্বের অনুভূতিও বাড়ছে। ছবি: বিবিসি বাংলা

২০২২ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, সিউলে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার তরুণ (১৯-৩৯ বছর বয়সী) সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন বা গৃহবন্দি। এছাড়াও, শহরে একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। জন্ম ও বিয়ের হার কমে যাওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া সরকার এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই সমস্যা মোকাবিলায় সিউল কর্তৃপক্ষ প্রথমে একটি হটলাইন চালু করে, যেখানে একাকী মানুষরা কথা বলতে পারেন। এরপর, তারা ‘উষ্ণ হৃদয়ের কনভিনিয়েন্স স্টোর’-এর মতো কাঠামোগত জায়গা তৈরি করে।

এই দোকানগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে কফি শপের মতো আরামদায়ক পরিবেশ থাকে। এখানে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা, ম্যাসাজ চেয়ার এবং বিন ব্যাগ রয়েছে। নুডলস সেদ্ধ হওয়ার সময় দর্শনার্থীদের একটি ছোট জরিপ পূরণ করতে বলা হয়, যেখানে তাদের মেজাজ ও জীবনযাত্রার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।

এই দোকানগুলোর একটি বিশেষ দিক হলো, এখানে সাহায্য চাওয়ার সামাজিক লজ্জা এড়ানো যায়। ইচ্ছাকৃতভাবে এর নাম ‘কনভিনিয়েন্স স্টোর’ রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ এটিকে মানসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক না ভাবে। কারণ দক্ষিণ কোরিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সাহায্য চাওয়াকে এখনও একটি সামাজিক কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয়, বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে।

এক দোকানের কাউন্সেলর লি ইন সুক বলেন, হি কাং-এর মতো অনেকেই প্রথম দিকে চুপচাপ থাকলেও, ধীরে ধীরে তারা নিজেদের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া শুরু করেন এবং অন্যদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। হি কাং ও ইন সুকের মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব এই উদ্যোগের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

কেবল তরুণরাই নয়, অনেক বয়স্ক মানুষও এই দোকানগুলোর সেবা নিচ্ছেন। ৬৮ বছর বয়সী সন তার জীবনের ৫০ বছরেরও বেশি সময় অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা করেছেন এবং কখনো বিয়ে বা সন্তান গ্রহণ করেননি। এখন তার একাকী জীবনের একমাত্র আশ্রয়স্থল এই দোকানগুলো। তিনি বলেন, “এই স্টোরগুলো আমার জন্মের আগেই খোলা উচিত ছিল।” নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এখানে বিনামূল্যে এয়ার কন্ডিশনিংয়েরও ব্যবস্থা থাকে, যা তাদের জন্য খুবই উপকারী।

সিউল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ সময় একা থাকা এখন কেবল অনুভূতি নয়, বরং সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই মানুষকে এখানে শুধু নুডলস খেতে হলেও একই টেবিলে বসতে উৎসাহিত করা হয়।

বিশ্বের অনেক দেশেই একাকীত্ব একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। যুক্তরাজ্য এবং জাপানের মতো দেশগুলোও এই সমস্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার এই ‘উষ্ণ হৃদয়ের কনভিনিয়েন্স স্টোর’ মডেলটি একাকীত্বে ভোগা মানুষদের জীবনে উষ্ণতা ও আশার আলো ফিরিয়ে আনছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা