বুধবার । ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:২৫ অপরাহ্ন
শেয়ার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশি যুবকরা

পাচার, প্রতারণা আর প্রাণহানির ভয়াবহ গল্প


Russia Ukraine Cover

বাংলাদেশে কাজের অভাব বহুদিনের সমস্যা। গ্রামের তরুণরা পরিবার চালাতে চায়, কিন্তু দেশে ভালো কাজ পায় না। তাই তারা বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

এই স্বপ্নই দালালদের ব্যবসা চালিয়ে রাখে। ‘বিদেশে গেলে মাসে লাখ টাকার বেতন’, ‘রাশিয়ায় ফ্যাক্টরির কাজ’, ‘সাইপ্রাসে ক্লিনারের চাকরি’— এমন নানা প্রতিশ্রুতি শোনা যায়।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, এই স্বপ্নের পেছনে ভয়ংকর বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। অনেক তরুণ কাজের কথা ভেবে বিদেশ গেছে, পরে বুঝেছে—ওদের আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন যেন তাদের কবরস্থানে পরিণত হচ্ছে।

মিডিয়া ও গবেষণা বলছে — বাংলাদেশ থেকেই কমপক্ষে ৭ জন বা আরও বেশি মানুষকে এমনভাবে পাঠানো হয়েছে রাশিয়ায়, যাদের মধ্যে কেউ মারা গেছেন, কেউ রয়েছেন নিখোঁজ।

ভুক্তভোগীদের কাহিনী

Russia Ukraine inner 1

নিহত হাবিবুল্লাহ ভুঁইয়া ।। ছবি: সংগৃহীত

হাবিবুল্লাহ ভূঁইয়া
নরসিংদীর হাবিবুল্লাহকে বলা হয়েছিল, রাশিয়ায় সে কারখানায় কাজ করবে। পরিবার তার বিদেশ যাওয়ার খরচ জোগাড় করতে ৯ লাখ টাকা ঋণ নেয়। শুরুতে ইতালি যাবার কথা থাকলেও দালালরা ২৮ লাখ টাকায় হাবিবুল্লাহকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দেয়। রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় পরিবারের। কয়েক সপ্তাহ পর খবর আসে—তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে। তার পরিবার বহুদিন পর্যন্ত জানত না, সে কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। অবশেষে গত সেপ্টেম্বরে জানা গেছে, হাবিবুল্লাহ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন৷

Russia Ukraine inner 2

নিহত মোহাম্মদ আকরাম হোসেন ।। ছবি: সংগৃহীত

মোহাম্মদ আকরাম হোসেন
আকরামকে এক দালাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রাশিয়ায় সরকারি অনুমোদিত কাজের সুযোগ আছে। সেই স্বপ্নে দালালের হাত ধরে রাশিয়া যায় সে।
রাশিয়ায় গিয়ে প্রথমে কিছুদিন ট্রেনিং করানো হয় আকরামকে। পরে বুঝতে পারে, সেই ট্রেনিং আসলে যুদ্ধের প্রস্তুতি। আকরামের বোন বলেন, ‘ও আমাদের ভিডিও কল করে কাঁদছিল। বলেছিল, পালাতে পারছি না।’ পরবর্তীতে মিসাইল হামলায় আকরাম নিহত হন।

Russia Ukraine inner 3

নিহত হাবিবুল্লাহর সেলফিতে নিহত বদিউজ্জামান (পেছনে) ।। ছবি: সংগৃহীত

বদিউজ্জামান
নিহত হাবিবুল্লাহ ভুঁইয়ার মতোই বদিউজ্জামানের বাড়িও নরসিংদীতে। চার ভাইয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দালালের হাত ধরে তিনিও পাড়ি জমান রাশিয়ায়। কয়েকমাস ধরেই তার কোনো খোঁজ নেই৷ তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা, তাও জানেনা তার পরিবার।

Russia Ukraine inner 4

নিহত নজরুল ইসলাম (ডানে) ।। ছবি: সংগৃহীত

নজরুল ইসলাম
রাজবাড়ীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলামের পরিবার জানায়, তাকে রাশিয়ায় চাকরি দেয়ার কথা বলে নেওয়া হয়েছিল। পরে তারা জানতে পারেন, তাকে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তার সাথে তার স্ত্রীর সর্বশেষ কথা হয় গত ৩০ এপ্রিল। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে ফিরে আসার কোনো উপায় নাই৷ যদি ফোন বন্ধ পাও, ধরে নিবা আমি মারা গেছি।’ এরপর থেকে দীর্ঘদিন তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি তার পরিবার। অবশেষে গত ৮ অক্টোবর তার পরিবার জানতে পারে, নজরুল বেশ আগেই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

Russia Ukraine inner 5

নিহত হুমায়ূন কবির ।। ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ূন কবির
নাটোরের সিংড়া থানার হুলহুলিয়া গ্রামের হুমায়ূন কবির ও তার ভগ্নিপতি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার রহমত আলী আর্থিক স্বচ্ছলতার উদ্দেশ্যে দালালদের মাধ্যমে সৌদি আরব হয়ে রাশিয়া যান। পরবর্তীতে তাদের রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয় ও বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে পাঠানো হয়। ড্রোন হামলায় হুমায়ূন কবির মারা যান গত ২৩ জানুয়ার। রহমত আলী তখনো জীবিত ছিলেন, পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। তবে বর্তমানে তার কোনো খোঁজ নেই৷

দায়ী কারা
এই ভয়াবহ ঘটনার দায় কেবল এক পক্ষের নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক অপরাধচক্র, যেখানে স্থানীয় দালাল থেকে শুরু করে বিদেশি রিক্রুটিং সংস্থা, এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদাসীনতাও ভূমিকা রাখছে।

স্থানীয় দালাল ও চাকরির এজেন্সি
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের দালালরা বিদেশে চাকরি বা ওয়ার্ক পারমিট দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করে। তারা বলে, ‘রাশিয়ায় কাজ আছে, টাকা ভালো, জীবন গড়বে।’ অনেক সময় এই দালালরা গ্রামের মসজিদের ইমাম, স্থানীয় নেতা বা পুরনো প্রবাসীদের পরিচিত হয়—তাদের প্রতি মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে।

এই দালালরা সাধারণত ৩ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়। কেউ কেউ ভুয়া এজেন্সির নাম ব্যবহার করে, আবার কেউ ঢাকায় অবস্থিত অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির ‘সাব-এজেন্ট’ পরিচয়ে কাজ চালায়।
তারা যেসব কাগজ দেয়, তার অনেকটাই ভুয়া— যেমন ওয়ার্ক পারমিট, ভিসা এপ্রুভাল, বা চুক্তিপত্র। বাস্তবে এই কাগজগুলো কোনো দেশেই বৈধ নয়।

অন্যদিকে, রাশিয়ার যুদ্ধে পাঠানোর আগে এই দালালরা বলে যে, সেখানে গার্ডের কাজ, ড্রাইভারের কাজ বা রেস্টুরেন্টে কাজ। কিন্তু পৌঁছানোর পর জানা যায়— তাদের পাঠানো হচ্ছে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে, যেখানে পরোক্ষভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হয়।

বিদেশি মধ্যস্থকারী ও রিক্রুটার
রাশিয়া বা তার মিত্র কিছু দেশের কিছু ব্যক্তি বা সংস্থা, যারা বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগের মাধ্যমে ‘কন্ট্রাক্ট আর্মি’ তৈরি করছে, তারাও এই পাচারচক্রের অংশ। তারা অনেক সময় বাংলাদেশি দালালদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখে— মেসেঞ্জার, টেলিগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করে।
কিছু ক্ষেত্রে ভিসা ও বিমান টিকিটের খরচ রাশিয়া থেকে পাঠানো হয়, পরে সেটা বেতন থেকে কেটে নেওয়ার কথা বলা হয়। অর্থাৎ, এটা এক ধরনের আধুনিক দাসব্যবসা, যেখানে মানুষকে বেঁচে থাকার আশায় এমন এক পথে ঠেলে দেওয়া হয়, যেখান থেকে ফেরার সুযোগ খুবই কম।

আইনের দুর্বলতা ও নজরদারির ঘাটতি
বাংলাদেশে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা থাকলেও, তদারকির ব্যবস্থা দুর্বল। বেশিরভাগ মানুষ জানে না কোন এজেন্সি অনুমোদিত, আর কোনটি নয়। এই সুযোগে ভুয়া বা অস্থায়ী অফিস খুলে অনেকেই মানুষ পাচারের কাজ চালায়।
আইন অনুযায়ী বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে প্রতিটি চুক্তিপত্র, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট যাচাইয়ের কথা থাকলেও, বাস্তবে অনেক সময় তা হয় না।
অন্যদিকে, প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে অনেক সময় দালালদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা অল্প সময়েই ছাড়া পেয়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব
আজকের দিনে ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক, কিংবা টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রচুর ‘বিদেশে সফলতার গল্প’ ছড়ানো হয়। অনেকে বিদেশে গিয়ে ভিডিও বানায়— ‘রাশিয়ায় এক মাসে লাখ টাকার বেশি আয়!’, ‘দুবাই থেকে সরাসরি ওয়ার্ক পারমিট!’
এইসব ভিডিও দেখে গ্রামীণ মানুষদের মনে আশা জাগে— ‘আমিও পারব।’
কিন্তু এই ভিডিওগুলোর পেছনে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক সময় এসব ভিডিও তৈরি করে দালালরা নিজেরাই, বা এমন ইউটিউবার যারা পাচারকারীদের কাছ থেকে অর্থ পায় প্রচারণা চালানোর জন্য।
এর ফলে, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষরা মনে করে ‘চেষ্টা করলে জীবন বদলাবে,’ অথচ তারা জানে না — এটা তাদের শেষ যাত্রা হয়ে যেতে পারে।

পরিবার ও সমাজের চাপ
অনেক পরিবারে বিদেশে কেউ কাজ করলে সেটা গর্বের বিষয়। ‘ওর ছেলে রাশিয়ায় আছে,’ ‘ওর ভাই ইউরোপে গেছে’—এই সামাজিক মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা থেকেও মানুষ দালালদের কাছে যায়।
বিশেষ করে যারা বেকার, দরিদ্র, বা ঋণে জর্জরিত— তারা যেকোনো উপায়ে বিদেশ যেতে চায়। দালালরা এই আবেগ ও চাপের সুযোগ নেয়।

সরকারের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে। বিদেশ মন্ত্রণালয় মস্কো দূতাবাসের মাধ্যমে তথ্য নিচ্ছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ কিছু দালালকে গ্রেপ্তার করেছে। এর ভেতর রাশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো দালাল চক্রের মূল হোতা মুহাম্মদ আলমগীর হোছাইনও রয়েছে। চলতি বছরের ১২ জুন দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যুরো তদন্ত শুরু করেছে, কোন এজেন্সি বা ব্যক্তি এর সঙ্গে জড়িত তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। যারা নিখোঁজ, তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতায় উদ্ধার বা যোগাযোগ করা খুব কঠিন।

Russia Ukraine inner 6

সিআইডির হাতে গ্রেফতার হওয়া দালালচক্রের মূল হোতা মুহাম্মদ আলমগীর হোছাইন (ডানে) ।। ছবি: সংগৃহীত

অনেক সময় পরিবারগুলো নিজেরাই সংবাদমাধ্যম বা আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারস্থ হচ্ছে। কেউ কেউ মানবাধিকার সংগঠনের সাহায্য নিচ্ছে। সরকারের তরফে একাধিক সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে — ‘অপরিচিত ব্যক্তি বা দালালের মাধ্যমে রাশিয়া বা ইউক্রেনে কাজের প্রস্তাবে যাবেন না।’

কেন এমন পরিস্থিতি?

দারিদ্র্য ও বেকারত্ব
গ্রামের অনেক পরিবারের একমাত্র আশা বিদেশে কাজ করা। দেশে কাজের সুযোগ সীমিত। দালালরা এই চাহিদা বোঝে এবং সহজেই ফাঁদ পাতে। বেকার তরুণদের মনে থাকা ‘ বিদেশ মানেই সোনার হরিণ’—এই বিশ্বাস প্রতারণার সুযোগ তৈরি করে।

প্রতারণার নতুন কৌশল
আগে মানুষকে লিবিয়া, দুবাই বা মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে প্রতারণা হতো। এখন রাশিয়া বা ইউক্রেনের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘রাশিয়ায় কাজের সুযোগ, দ্রুত ভিসা, বিনা খরচে টিকেট’— এই সব প্রলোভন দেখানো হয়। যাদের প্রক্রিয়া ষা বা নিয়ম সম্পর্কে বোঝাপড়া নেই, তারা সহজেই জালে আটকা পড়ে।

নিয়ন্ত্রণের অভাব
বিদেশে পাঠানোর কাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বাস্তবে অনেক ফাঁকফোকর। গ্রামে গ্রামে অজানা দালাল ঘুরে বেড়ায়। স্থানীয় প্রশাসনও অনেক সময় জানে না কে কোথায় মানুষ পাঠাচ্ছে। অনলাইন প্রতারণা এখন আরও সহজ হয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার শ্রমবাজারে বড় সংকট তৈরি হয়েছে। তারা বিদেশিদের ব্যবহার করছে। এই সুযোগকে দালালরা কাজে লাগায়—তারা বলে, ‘রাশিয়া এখন অনেক লোক নিচ্ছে, কাজ পেলে ভালো টাকা পাবেন।’ মানুষ ভাবে, যুদ্ধের কথা মিথ্যা, বা তারা সেখানে থাকবে না। কিন্তু পরে ফেঁসে যায়।

আইন ও সচেতনতার ঘাটতি
প্রতারণার শিকার অনেক পরিবার জানেই না কোথায় অভিযোগ করতে হয়।আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল। যারা বিদেশে গেছে, তাদের অনেকে অল্পশিক্ষিত, তাই কাগজপত্রের জটিলতা বোঝে না।

পরিশেষে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন শুধু দুই দেশের নয়—এতে জড়িয়ে পড়ছে দূরের দরিদ্র দেশের মানুষও। বাংলাদেশি তরুণদের রক্ত ও অজানা পরিণতি এই যুদ্ধের নতুন ট্র্যাজেডি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে জীবন হারাচ্ছে, কেউ নিখোঁজ, কেউ পরিবারের কাছে ফেরার আশায় অপেক্ষা করছে।

বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।