Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মগবাজার ফ্লাইওভার : তমা-এলজিইডির দুর্নীতিতে ব্যয় দ্বিগুণ হচ্ছে

নকশা ত্রুটির অজুহাত তুলে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পে এবার হরিলুটের বন্দোবস্ত করছে সংশ্লিষ্ট  ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষভাবে তমা কনস্ট্রাকশনের নেতৃত্বে। খোদ এলজিইডিকে ম্যানেজ করে এই লুটের পরিকল্পনায় দ্বিগুণ হচ্ছে ফ্লাইওভার প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়। অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ও। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি বাড়বে ব্যাপকহারে।

জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে ফ্লাইওভারের পুরো কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিন প্যাকেজের মধ্যে বড় প্যাকেজটির নির্মাণ কাজে হাতই দেওয়া হযনি। অন্য দু’টি প্যাকেজের অগ্রগতি মাত্র যথাক্রমে ৩৮ ও ৪২ ভাগ। উল্টো ফন্দি এঁটে এর জন্য আরো দুই বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তারা। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যয় বরাদ্দও। ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রকল্পের খরচ বেড়ে দাড়াচ্ছে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকায়। এ নিয়ে ইতোমধ্যে নামেমাত্র কয়েক দফায় চিঠি চালাচালিও হয়েছে ঠিকাদার-এলজিইডির মধ্যে।

chardike-ad

mogbazar flyover সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোগান্তি লাঘবের লক্ষে তিনটি আলাদা প্যাকেজ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তিন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চীনের মেটালারজিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি নামক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে দেশীয় তমা কনস্ট্রাকশন টেন্ডার জমা দিয়ে আরো একটি কাজ ভাগিয়ে নিয়ে এখন একাই দু’টি প্যাকেজের কাজ করছে। বলা হচ্ছে চীনের ওই প্রতিষ্ঠান তমাকে এই প্যাকেজটি সাব-কন্টাক্ট দিয়েছে। যদিও চুক্তির শর্তানুযায়ী এক্ষেত্রে সাব কন্টাক্ট সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে দু’টি প্যাকেজতো দূরে থাকুক একটি প্যাকেজের কাজই এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি তমা কনস্ট্রাকশন। যন্ত্রপাতি কেনার কথা বলে বড় অংকের অর্থ অগ্রিম নিয়েছে সরকারের কাছ থেকে। যদিও এটা অবৈধ, তারপরও যেহেতু এরা প্রভাবশালী তাই চাপ দিয়ে আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু, যন্ত্রপাতি কেনার কথা বলা হলেও বাস্তবে তমা কনস্ট্রাকশন ভালো কোন যন্ত্রপাতি ক্রয় করেনি। পুরনো লক্কর-ঝক্কর মার্কা যন্ত্রপাতি দিয়েই চলছে ফ্লাইওভার বানানোর কাজ। এর ফলে একদিকে যেমন কাজের গুণগত মান রক্ষা হচ্ছে না তেমনি পাইল বোরিং এবং কস্টিংএ ১০ ঘন্টার জায়গায় ২৪ থেকে ৩০ ঘন্টা সময় ব্যয় হচ্ছে। এতে প্রকল্পের কাজ নিম্নমানের হচ্ছে, অথচ ব্যয় হচ্ছে বেশি। ফলে নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে এলেও শেষ হচ্ছেনা ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ।

সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দু’বছরে এমসিসি-তমা কনস্ট্রাকশনের অধীন প্যাকেজ-৬ এর কাজ হয়েছে মাত্র ৩৮ শতাংশ। সিমপ্লেক্স নাভানা জেভির প্যাকেজ-৪ এর কাজ হয়েছে মাত্র ৪২ শতাংশ, যে কাজটি সাব-কন্ট্রাকটের নামে জোর করে বাগিয়ে নিয়েছিল। অন্যদিকে কাগজে/কলমে তমার নিজস্ব প্যাকেজ-৫ এগিয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাস্তবে কাজ শুরুই হয়নি। অথচ এ প্যাকেজটির কাজের পরিধি ও ব্যয় বরাদ্দ অন্য দু’টি প্যাকেজের মোট কাজের সমান।

কাজের এই ধীর গতির জন্য ফ্লাইওভারের ডিজাইন ত্রুটির অজুহাত তুলছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে সেই ত্রুটির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই ডিপিপির শর্ত লঙ্গন করে বুয়েটকে ডিজাইন কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর এলজিইডির দুর্নীতিবাজ প্রধান প্রকৌশলীর স্বেচ্ছাচারিতায় উপদেষ্টা ফার্ম হিসেবে অবৈধভাবে নিয়োগের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে প্রতারক কোম্পানি স্মেকের।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য হলো, ডিজাইন ত্রুটির কারণেই নাকি ফ্লাইওভারের নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। আর এর ফলে এখন  পিলার ও পাইলের অবস্থানও নাকি পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে বেশ কয়েকটি পাইল। পাশাপাশি দৈর্ঘ্য বেড়েছে বেশকিছু পাইলের। ঠিকাদাররা দাবি করছে ডিজাইন ত্রুটির কারণে মাটির নিচের ২২ মিটার পাইলের দৈর্ঘ্য এখন দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪৪ মিটার করতে হচ্ছে। এতে নির্মাণ ব্যয়ও বাড়বে। তবে হঠাৎ করে পাইলের দৈর্ঘ্য বাড়ানো নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

প্রশ্ন উঠেছে, নকশা পরিবর্তনের ফলে কাজের এ পর্যায়ে এসে যদি পাইলের দৈর্ঘ্য বাড়াতে হয়, তাহলে এর আগে যেসব জায়গায় ২২ মিটার পাইল করা হয়েছে সেসব স্থান কি ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাবে না? যদি ঝুঁকির মধ্যে পড়েই তাহলে এত বড় প্রকল্পের এ ক্ষতির দায় কে নেবে? সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এত বড় প্রকল্পে হঠাৎ করেই এ ধরনের পরিবর্তন অস্বাভাবিক। প্রকল্পের মাঝামাঝি পর্যায় এসে পাইলের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর অজুহাত ব্যয় বাড়ানোর একটি ফন্দি মাত্র।

সূত্রের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত প্যাকেজ-৬ এর ২২ মিটার দৈর্ঘ্যরে ২৮৮টি, প্যাকেজ-৪ এর ২৩২টি  পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে পাইলের দৈর্ঘ্য বাড়ালে কিভাবে তার টেন্ডার বা দর মূল্যায়ন করা হবে সেটি নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। দেশের দীর্ঘতম এই ফ্লাইওভার প্রকল্পে নকশা পর্যালোচনা এবং তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগে ব্যাপক জালিয়াতির ফলেই সৃষ্টি হয়েছে এ জটিলতা। এমনকি জালিয়াতির মাধ্যমে কম যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী দিয়ে কাজ করানোর কারণে গোটা প্রকল্পটির ভবিষ্যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এতে ফ্লাইওভারটির নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ছে।

নকশা জটিলতার অভিযোগ এনে ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি এলজিইডিকে চিঠি দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন। ব্যয় দ্বিগুণ করার দাবি জানিয়ে এতে বলা হয়, দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা বলা হলেও এখনো ফ্লাইওভারের পুরো নকশাই চূড়ান্ত হয়নি। মাটি খুঁড়ে পরিষেবা সংযোগ লাইনের অবস্থা দেখে পাইল করতে হচ্ছে। এতে ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে একই ধরনের চিঠি দিয়েছে অন্য ঠিকাদার নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডও।

এলজিইডির তথ্যমতে, চার লেনবিশিষ্ট ৮ দশমিক ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা দেবে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট ও ১৯৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা দেবে ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট। অবশিষ্ট ২০০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।

রাজধানীর যানজট নিরসনের অংশ হিসেবে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১১ সালে অনুমোদন করে সরকার। আর ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। ফলে নকশা সংশোধন করে পুরো ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শেষ করতে ২০১৬ সালও পেরিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বলতে গেলে এক হিসেবে বলা যায় এখন পর্যন্ত কাজ শুরুই হয়নি। এখনও অনেক কিছু বাকী। নকশা রিভিশন চলছে। প্রকল্প এলাকায় সার্ভে চলছে। বর্তমানে ফ্লাইওভারটির নকশা সংশোধনে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। এক্ষেত্রে পাইলের জন্য মাটি কেটে দেখা হচ্ছে নিচে কোনো পরিষেবা সংযোগ লাইন আছে কি না। এর পর ওই স্থানে পাইল করার অনুমোদন দিচ্ছে বুয়েট। তবে মাটি কেটে পরিষেবা সংযোগ লাইন দেখা গেলে তা বন্ধ করে পাশে আবার গর্ত করা হচ্ছে। এভাবে চলছে পাইলের নকশা পরিবর্তনের কাজ।

ঠিকাদারদের বক্তব্য হলো- ডব্লিউ-৪ ও ডব্লিউ-৫ প্যাকেজে ১৪৭টি পাইলের মধ্যে ১২২টির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। এছাড়া ৩৫টি পাইলের  দৈর্ঘ্য ২৩ ইঞ্চি থেকে বেড়ে ৪৮ ইঞ্চি করা হয়েছে। আর পরিত্যক্ত হয়েছে ১২টি পাইল। তবে তাদের এই বক্তব্যের সমর্থনে যথাযথ প্রমাণাদি নেই। পাইলের অবস্থান পরিবর্তনে ফ্লাইওভারের পিলারের অবস্থান ও দূরত্বেও পরিবর্তন আসবে বলে তারা জানিয়েছে।

তবে ডব্লিউ-৬ প্যাকেজের নকশা সংশোধনে এখনো কাজ শুরু করেনি বুয়েট। এজন্য মালিবাগে রাস্তার মাঝে গর্ত করে তা ফেলে রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রকল্পের একজন বিশেষজ্ঞ শীর্ষ নিউজকে বলেন, এই প্রকল্পের ডিজাইনে সংশ্লিষ্ট ডিজাইনার কিছুটা গোজামিল দিয়ে গেছেন। তার ড্রয়িংটা কাগজে কলমে ঠিক থাকলেও, বাস্তবে ঠিক  নেই। যে কারণে ফাউণ্ডেশনেই অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এতো বড় একটি প্রকল্পের প্লানিং স্টেজেই ভালোভাবে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া উচিৎ ছিলো।

প্রকল্পের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নাজমুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে। সূত্র জানিয়েছে, তিনি হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে বর্তমানে সৌদি আরব রয়েছেন। শীর্ষ কাগজের সৌজন্যে।