শনিবার । ডিসেম্বর ১৩, ২০২৫
সেতু ইসরাত বিজনেস ৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫:০৯ অপরাহ্ন
শেয়ার

এসএমই মেলার ৬০% উদ্যোক্তাই নারী, দিনবদলের নতুন বার্তা


SME Fair

দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে নারীর ক্ষমতায়নের এক শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে এই মেলা

রাজধানীতে চলছে ১২তম জাতীয় এসএমই মেলা। এবারের মেলা কেবল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মিলনক্ষেত্র নয়, এটি যেন বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এক বিশাল উৎসবের মঞ্চ। মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রায় সাড়ে তিনশ’ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নারী-উদ্যোক্তা, যা দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে নারীর ক্ষমতায়নের এক শক্তিশালী বার্তা দেয়। তাদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী শক্তি মেলাকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা।

ঐতিহ্যের পুনর্জন্ম: হাতে তৈরি পণ্যের বিপুল সমাহার
মেলায় নারী উদ্যোক্তাদের স্টলগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তারা কেবল ব্যবসা করছেন না বরং বাংলাদেশের হারানো ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করছেন। বিশেষ করে হস্ত ও কারুশিল্প ক্যাটাগরিতে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।

প্রথাগত নকশী কাঁথা থেকে শুরু করে পাটজাত বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব পণ্য, জামদানি, মসলিন এবং টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বৈচিত্র্য মুগ্ধ করছে ক্রেতাদের। অনেক নারী উদ্যোক্তা বিলুপ্তপ্রায় লোকশিল্পের মোটিফ ব্যবহার করে আধুনিক ফ্যাশনের সঙ্গে মিশিয়ে নতুনত্ব এনেছেন। এই যেমন উদ্যোক্তা সানজিদা আলম পুরনো পাটের বস্তা প্রক্রিয়াজাত করে চমৎকার হ্যান্ডব্যাগ ও গৃহসজ্জার সামগ্রী তৈরি করছেন, যা দেশীয় কাঁচামালের প্রতি তাদের অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। তাদের হাসিমুখ, পণ্যের গুণগত মান নিয়ে আত্মবিশ্বাস এবং ক্রেতাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা—সব মিলিয়ে মেলায় এক ইতিবাচক ও কর্মমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। 

Sme Fair 6

স্বাদ ও স্বাস্থ্য: খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে নারীর দক্ষতা
নারী-উদ্যোক্তারা তাদের দক্ষতার প্রমাণ রাখছেন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতেও। এই বিভাগে স্বাস্থ্যকর এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিপুল সমাহার দেখা যাচ্ছে মেলায়। বিভিন্ন ধরনের আচার, হাতে তৈরি মসলা, অর্গানিক মধু, গ্রামীণ পদ্ধতিতে তৈরি গুড়ের পাটালি এবং ভিন্ন স্বাদের পিঠা-পুলি বিক্রি হচ্ছে ব্যাপক হারে। এই পণ্যগুলোর প্যাকেজিংয়েও এসেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। সতেজ এন্ড সেইফ ফুডের কর্ণধার শায়লা আখন্দ বাংলা টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘আমরা আমাদের মায়ের বা দাদির ঐতিহ্যবাহী রেসিপিকে আধুনিক প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে চেষ্টা করছি। ক্রেতারা যখন স্বাদে মুগ্ধ হন, তখন আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়।” তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, তারা কেবল রান্নাঘর নয় বৃহৎ খাদ্যশিল্পেও নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। 

প্রযুক্তির ছোঁয়া: পোশাক, চামড়া ও তথ্য প্রযুক্তিতে নতুন নারী নেতৃত্ব
আগে ধারণা করা হতো, কিছু নির্দিষ্ট ঐতিহ্যবাহী শিল্পেই নারীদের প্রধান ভূমিকা। কিন্তু এই মেলা সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে। তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য এবং এমনকি তথ্য প্রযুক্তি খাতেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।

পোশাক ও ফ্যাশন: নারী উদ্যোক্তারা শুধু শাড়ি বা সালোয়ার কামিজেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তারা নিজেদের তৈরি পোশাক ও গহনা ডিজাইনে বৈশ্বিক ট্রেন্ড অনুসরণ করছেন।

চামড়াজাত পণ্য: চামড়ার ব্যাগ, জুতা ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক তৈরির ক্ষেত্রেও নারী-উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী ডিজাইন বিশেষভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।

Sme Fair 7

তথ্য প্রযুক্তি: এই খাতের কিছু স্টলে নারী উদ্যোক্তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা তাদের প্রযুক্তি এবং উৎপাদন শিল্পে আগ্রহের পরিচয় বহন করে।

অনেক নারী উদ্যোক্তা তাদের উৎপাদিত পণ্য শুধু মেলায় নয়, অনলাইনেও বিক্রি করছেন। এই ডিজিটাল উপস্থিতি তাদের ব্যবসায়িক পরিসরকে আরও প্রসারিত করেছে। তারা শুধু পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করছেন না বরং নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছেন। 

মেলায় আগত নারী উদ্যোক্তাদের প্রাণবন্ত হাসি আর উদ্যম দেখে মনে হতে পারে, তাদের পথচলা খুবই সহজ। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। মূলধন সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ এবং একই সাথে সংসার সামলানোর মতো চ্যালেঞ্জগুলো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু মেলায় তাদের স্বতঃস্ফূর্ত এবং আশাবাদী বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, তারা কোনো চ্যালেঞ্জকেই বাধা মানেননি। তাদের দৃঢ়তা, সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ এবং এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তারা আজ এই জাতীয় মঞ্চে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

Sme Fair 5

১২তম জাতীয় এসএমই মেলা একথাই প্রমাণ করলো যে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নারীশক্তি আজ আর কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়—এটি অপরিহার্য। এই নারীরাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি।