
জ্যাপা বিশ্বাস করতেন, আমেরিকান সমাজ ভণ্ডামিতে ভরা
রক মিউজিকের ইতিহাসে ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা’র নাম উচ্চারণ করলেই এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। তিনি এমন কোনো শিল্পী নন যাকে সহজে ভালোবাসা যায়। আবার তাকে এড়িয়ে যাওয়াও যায় না। গিটার হাতে মঞ্চে দাঁড়ানো একজন মানুষ হয়েও তিনি ছিলেন একই সঙ্গে দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ব্যঙ্গকার এবং একগুঁয়ে স্বাধীনচেতা নাগরিক। জ্যাপা নিজেকে কখনোই “রকস্টার” হিসেবে ভাবেননি—বরং তিনি ছিলেন এমন একজন, যিনি রক মিউজিককে ব্যবহার করেছিলেন সমাজকে আয়নার সামনে দাঁড় করাতে।
ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা’র সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, তিনি খুব বেশি সত্য বলতেন। আর খুব বেশি বুদ্ধিমান ছিলেন এমন একটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য, যেটি সহজ কথা, সহজ সুর আর নিরাপদ বিদ্রোহ পছন্দ করে।

রকস্টার না কি দার্শনিক ব্যঙ্গকার?
ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপার গান শুনলে প্রথম যে বিষয়টি চোখে পড়ে, তা হলো তার অদ্ভুত—প্রায় বিকৃত—রসবোধ। যৌনতা, ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র—কোনো কিছুই তার ব্যঙ্গ থেকে রেহাই পায়নি। কিন্তু এই ব্যঙ্গ ছিল উদ্দেশ্যহীন কৌতুক নয়; এটি ছিল গভীর সামাজিক পর্যবেক্ষণের ফল।
জ্যাপা বিশ্বাস করতেন, আমেরিকান সমাজ ভণ্ডামিতে ভরা। একদিকে তারা স্বাধীনতার কথা বলে, অন্যদিকে চিন্তা ও শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তার গানগুলো ছিল এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে এক ধরনের মৌখিক আক্রমণ। We’re Only in It for the Money অ্যালবামে তিনি হিপি কালচারকেও ছাড় দেননি—যাদের অনেকেই তাকে ‘কাউন্টারকালচার হিরো’ বানাতে চেয়েছিল। ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা বরাবরই সন্দেহ করতেন দলগত নৈতিকতার প্রতি। তার মতে, যেকোনো ‘নৈতিক আন্দোলন’ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
এই জায়গাতেই জ্যাপা সাধারণ রকস্টারদের থেকে আলাদা। যেখানে অধিকাংশ শিল্পী সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন কোনো সিস্টেম বানাতে চান, সেখানে তিনি সব সিস্টেমকেই প্রশ্ন করেন।
ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা বনাম আমেরিকান ফ্রিডমের ভণ্ডামি
১৯৮৫ সালে আমেরিকায় যখন Parents Music Resource Center (PMRC) ‘অশালীন’ গানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, তখন বহু শিল্পী নীরব ছিলেন। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা ছিলেন না। তিনি মার্কিন সিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে যে বক্তব্য দেন, তা আজও free speech আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
জ্যাপা স্পষ্ট ভাষায় বলেন- সেন্সরশিপ কখনোই শিশুদের রক্ষা করে না, বরং ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে। তার মতে, নৈতিকতার দোহাই দিয়ে শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে মানুষের চিন্তাশক্তিকে অপমান করা। তিনি সতর্ক করে দেন, আজ গান সেন্সর করা হলে কাল বই, পরশু রাজনৈতিক মতামত- সবই নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়বে।
জ্যাপা নৈতিকতার ভাষাকে সন্দেহ করতেন। তার মতে, “নৈতিকতা” শব্দটি প্রায়শই ব্যবহৃত হয় নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র বা সংগঠনের কাজ মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা নয়, বরং চিন্তা করার সুযোগ নিশ্চিত করা।

এখানে লক্ষণীয়, ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শিবিরের মানুষ ছিলেন না। তিনি রক্ষণশীলদের ভণ্ড নৈতিকতাকেও আক্রমণ করেছেন, আবার উদারপন্থীদের প্রতীকী রাজনীতিকেও প্রশ্ন করেছেন। তার কাছে স্বাধীনতা মানে ছিল- অস্বস্তিকর, এমনকি বিরক্তিকর কথাও বলার অধিকার।
এই অবস্থান তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়নি, কিন্তু তাকে ভয়ংকরভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। আজকের ক্যান্সেল কালচার, ট্রিগার ওয়ার্নিং আর নৈতিক পাহারাদারির যুগে জ্যাপার কথাগুলো আরও বেশি তীক্ষ্ণ শোনায়।
রক মিউজিকের ভেতরে এক আধুনিক ধ্রুপদি সুরকার
অনেক শ্রোতাই ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপাকে কেবল একজন বিদ্রূপকারী রক মিউজিশিয়ান হিসেবে জানেন। কিন্তু এই পরিচয় অসম্পূর্ণ। জ্যাপা নিজেকে প্রথমত এবং প্রধানত একজন কম্পোজার মনে করতেন। তার সংগীতচিন্তার শিকড় ছিল আধুনিক ধ্রুপদি সংগীতে—ইগর স্ত্রাভিনস্কি, এডগার ভারেস, এমনকি বিশ শতকের অ্যাভাঁ-গার্দ ধারায়।
তার গানে পাওয়া যায় অদ্ভুত টাইম সিগনেচার, হঠাৎ ছন্দ পরিবর্তন, জ্যাজ, ব্লুজ ও ক্লাসিকালের জটিল সংমিশ্রণ। রক মিউজিককে তিনি ব্যবহার করেছিলেন এক ধরনের বাহন হিসেবে—যাতে কঠিন কম্পোজিশন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়।
এই জটিলতাই তাকে জনপ্রিয়তার মূলধারা থেকে দূরে রেখেছে। ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপার গান সহজে গুনগুন করা যায় না, সহজে নাচা যায় না। তার সংগীত মনোযোগ দাবি করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্প মানে কেবল আরাম দেওয়া নয়; শিল্প মানে চিন্তা তৈরি করা, প্রশ্ন তোলা।
অনেক শ্রোতার কাছে তার গান প্রথমে বিশৃঙ্খল মনে হতে পারে। কিন্তু একটু সময় দিলে বোঝা যায়- এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই রয়েছে এক কঠোর শৃঙ্খলা, এক নির্দয় সংগীতদৃষ্টি।

অস্বস্তিকর বলেই প্রয়োজনীয়
ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা কখনোই শ্রোতাকে স্বস্তি দিতে চাননি। তিনি চেয়েছেন মানুষকে নড়বড়ে করতে, প্রশ্ন করতে বাধ্য করতে। তার মতে, যে শিল্প মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে না, সেটি শেষ পর্যন্ত সিস্টেমের আরামদায়ক অংশ হয়ে ওঠে।
আজকের সময়ে, যখন শিল্পীরা ব্র্যান্ড হয়ে উঠছেন, গ্রহণযোগ্যতাই হয়ে উঠছে প্রধান মাপকাঠি, তখন জ্যাপা–র মতো একজন শিল্পী প্রায় কল্পনার বাইরে। তিনি আজ বেঁচে থাকলে হয়তো তাকে বারবার বিতর্কে জড়ানো হতো, হয়তো তাকে ‘প্রবলেমেটিক’ বলা হতো।
কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে—ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা এক কণ্ঠ। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, স্বাধীনতা মানে শুধু জনপ্রিয় কথা বলা নয়; স্বাধীনতা মানে অপ্রিয় সত্য বলার সাহস।
ফ্র্যাঙ্ক জ্যাপা কোনো রকস্টার ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক চলমান প্রশ্নচিহ্ন—যে প্রশ্ন আজও আমাদের স্বস্তি নষ্ট করে। আর ঠিক সেই কারণেই, তাকে আজও পড়া, শোনা এবং বোঝা প্রয়োজন।
জ্যাপার সেরা কিছু গান (বানান অবিকৃত রাখা হলো)
Peaches en Regalia, Trouble Every Day, Plastic People, Who Are the Brain Police?, The Black Page, Inca Roads, Brown Shoes Don’t Make It, Cosmik Debris, Bobby Brown Goes Down, Joe’s Garage ইত্যাদি।









































