Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ডিজিটাল যুগেও ক্রীতদাস!

Kritodas‘দাস প্রথা’ বা ‘ক্রীতদাস প্রথা’ যাই বলি না কেন, সে তো অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? একুশ শতকে এসে এই ডিজিটাল যুগেও বিশ্বে চলছে আধুনিক দাস প্রথা! বিশ্ব ক্রীতদাস সূচক-২০১৪ সংক্ষেপে জিএসআই জানাচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বের ৩ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ ক্রীতদাসের মতো জীবনযাপন করছে। অমানবিক পেশায় যারা যুক্ত তাদের ‘আধুনিক যুগের ক্রীতদাস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

দাসত্ব বলতে বুঝায় কোনো মানুষকে জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করা এবং এ ক্ষেত্রে মানুষকে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা। অমানবিক ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, ‘দাসত্ব যদি অন্যায় না হয়, তাহলে পৃথিবীতে অন্যায় বলে কিছু নেই’। ক্রীতদাস প্রথা প্রাচীন যুগে তো ছিলই, মধ্যযুগেও ছিল। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) হযরত বেলাল (রাঃ)-কে ক্রীতদাসের জীবন থেকে মুক্ত করেছিলেন। সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লুটোসহ বিশ্বের বিখ্যাত দার্শনিকগণ ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। স্পারটাকাসসহ তার ৬ হাজার অনুসারীকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। ক্রীতদাস প্রথার বিরোধীতাকারী স্পারটাকাসের প্রশংসা করায় স্বয়ং সক্রেটিস সম্রাটের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। রাশিয়ার জারদের হাত থেকে ক্রীতদাস ক্ষেতমজুররা মুক্তি পেয়েছিল রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে। তলস্তয়, লেলিন, মাও সে তুং, মহাত্মা গান্ধীসহ বিশ্বনন্দিত নেতারা ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

chardike-ad

স্পারটাকাস, নাট টারনার, হ্যারিয়েত তুবম্যানসহ অসংখ্য ব্যক্তি ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির জন্য গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জয়ী হয়েছেন। একইভাবে বিভিন্ন দেশে দাস প্রথা বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। ‘দাস অর্থনীতি’র উপর বই লিখে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন কার্ল মার্কস।

অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন তাদের জরিপে দাবি করেছে বাংলাদেশে আধুনিক দাসের সংখ্যা সাত লাখ। এই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৪৩৫ ভাগ। বৈশ্বিক সূচকে ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৯তম। সবচেয়ে বেশি ক্রীতদাস ভারতে এবং জনসংখ্যার শতকরা হারে আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ায়। ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলেও ঋণের জালে আটকানো, জোরপূর্বক শ্রম, অর্থের বিনিময়ে যৌন চাহিদা মেটানো ও বাধ্যতামূলক বিয়ে এবং ভিক্ষার পাশাপাশি ইটভাটা, চিংড়ি শিল্প ও গার্মেন্টস-এ কর্মরতদের দাসের তালিকায় ফেলা হয়েছে এই সূচকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতেই এই সমস্যা বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বেসরকারি খাতে ‘অভাবনীয়’ অর্থনৈতিক অগ্রগতি, রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র বিমোচন, উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পরেও দেশের মানুষ ‘আধুনিক দাসত্বের’ ঝুঁকিতে আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সবচেয়ে বেশি ক্রীতদাস। সেখানে দাস হিসেবে জীবনযাপন করে এক কোটি ৪০ লাখ লোক। যা মোট জনসংখ্যার এক দশমিক ১৪ শতাংশ। ভারতের পরেই চীনের অবস্থান। এই তালিকায় নাম রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং রাশিয়ার। দাসত্বের শতকরা হার (৪ শতাংশ) সবচেয়ে বেশি মৌরিতানিয়ায়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে প্রতি বছর বিশ্বে বলপূর্বক শ্রম থেকে দেড়শ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হয়ে থাকে। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোতে এইসব দাসদের কাছ থেকে স্বল্প মূল্যে শ্রম আদায় করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্প, চিংড়ি ঘের ও কৃষিকাজে স্বল্প মূল্যে শ্রম শোষণ করা হয়। মাত্র কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকায় ক্ষেতমজুরদের কাছ থেকে আগাম শ্রম ক্রয় করা হতো খুবই কম দামে। অভাবের সময় বা বর্ষাকালে শুধুমাত্র খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করার জন্য আগাম শ্রম বিক্রি করা হতো। এখন এই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে এখন প্রায় ৩ কোটি ৫৮ লাখ দাস রয়েছে। এই সংখ্যা ইতিহাসের যে কোনো সময়ের দাসের সংখ্যার তুলনায় বেশি। এমনকি প্রায় চারশ বছরের ইতিহাসে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় নেয়া আফ্রিকান দাসের মোট সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার আমরা যখন নিজেদের সভ্য বলে দাবি করছি তখনই বিশ্বের ১৬৭টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে সবদেশেই ক্রীতদাসত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে মানবাধিকার সংস্থাটি দাবি করেছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জোরপূর্বক শ্রম নেওয়াকে দাসত্ব হিসেবে গণ্য করে না। তাদের হিসেব অনুযায়ী এখন বিশ্বের দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব ও দাসত্বসংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দী। এই দাসদের বেশিরভাগই ঋণ শোধের জন্য দাসে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে পরবর্তীতে অর্থ শোধ দিতে না পারায় দাসে পরিণত হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু আছে যারা কয়েক প্রজন্মের দাস। নারী ও শিশুদের যৌন ব্যবসায় খাটোনো হয়। এটিকে বর্ণনা করা হয় ‘ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দাস বাণিজ্য’ হিসেবে। অবৈধ মাদকদ্রব্য পরিবহনে ব্যবহার করার কারণে একই সাথে এটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষেত্র।

প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে সমাজে মানুষ বেচা-কেনার প্রথা ছিল। বিভিন্ন মূল্যের বিনিময়ে মানুষ কেনা যেত। এই প্রচলিত প্রথাটিকেই দাস প্রথা বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে যেমন পণ্য বেচা-কেনার বাজার রয়েছে অতীতে সেরকমই দাসদাসী বিক্রি অথবা ক্রয়ের জন্য আলাদা বাজার ছিল। তখন দাস-দাসী আমদানী এবং রপ্তানীতে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন হতো এবং তা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব রাখতো। সাধারণত দাসদাসীরা আফ্রিকান হতো। আফ্রিকান দাসদের মধ্যে হাবশি ও কাফ্রির চাহিদা ছিল বেশি। বাংলায় এসব দাস-দাসী ৫ থেকে ৭ টাকায় কেনা যেতো। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দাস কিনতে লাগতো ২০ থেকে ২২ টাকা। দাসদের দিয়ে দুই ধরণের কাজ করানো হতো- কৃষিকাজ ও গার্হস্থ্য কাজ। তখন দাস রাখা একটি সামাজিক মর্যাদার ব্যাপার ছিল। তাছাড়া উচ্চবিত্তরা দাসদের দিয়ে বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমের কাজ করাতো। যেমন ঘানি ভাঙানো, আখ মাড়াই, হালচাষ, সেচ এর পানি, গবাদী পশুপালন, বৃক্ষাদির পরিচর্যা ইত্যাদি। দাসীদের রাখা হতো সাধারণত যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য। তাদের উপপত্নী করে রাখা হতো এবং তাদের সন্তানদের দাস রূপে রাখা হতো বা বিক্রি করা হতো। ওইসব সন্তানরা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে পারতো না। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এবং আমেরিকার সরকার ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে দাস-দাসী আমদানী ও রপ্তানী সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে।

মানুষ তার জীবন-জীবিকার তাগিদে দেশান্তরী হচ্ছে। বিদেশে বাধ্য হয়ে শ্রম বিক্রি করছে। বাংলাদেশ থেকে শ্রমজীবী মানুষ মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকায় যাচ্ছে। তারা কম দামে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। পাসপোর্ট আটকে রেখে কম মূল্যে শ্রম বিক্রিতে বাধ্য করার খবর আমরা প্রায়ই সংবাদপত্রে পড়ি। আগের দিনে ক্রীতদাসরা যাতে পালাতে না পারে এ জন্য তাদের নির্দিষ্ট খোয়ারে আটকে রাখা হতো। আবার পায়ে শেকল দিয়ে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। ক্রীতদাসদের উপর চালতো বর্বর নির্যাতন। এখন নির্যাতনের ধরণ পাল্টে গেছে। কদিন আগে খবরের কাগজেই পড়লাম বাংলাদেশের একজন নারী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কাজ করতে গিয়ে কীভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শ্রমিক বা গৃহকর্মী হিসেবে তাদের পাঠানো হয়েছে আরব দেশে। ওরা নারী শ্রমিকদের আটকে রেখে অমানবিক কাজ তো করায়ই, অনেক সময় জোরপূর্বক যৌনকর্মে বাধ্য করে। আবার শিশুদের নিয়ে যায় টাকার বিনিময়ে। তাদের দিয়ে করানো হয় উট দৌড়ের জকির কাজ।

আমি ষাট এবং সত্তরের দশকে দেখেছি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি গৃহস্ত পরিবারে বছর চুক্তিতে ‘হাইল্যা’ বা কামলা রাখা হতো। মুসলিম হলে বছরে মাত্র দুই দিন, হিন্দু শ্রমিক হলে বড় পূজার (দূর্গা পূজা) দুই দিন ছুটি পেতো। শারীরিক অসুস্থতা বা কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে চুক্তি থেকে টাকা কেটে রাখা হতো। বাড়ির মালিক তাদের বছরে দুই থেকে তিনটি লুঙ্গি এবং সমসংখ্যক গামছা দিতো। ক্রমশ শ্রমিকের (কৃষি শ্রমিক) কদর বাড়তে থাকে। এখন সেই পরিস্থিতি আর নেই। তবুও অতিবর্ষণ, বন্যা এবং অন্যান্য দুযোর্গে খেটে খাওয়া মানুষগুলো হয়ে পড়ে অসহায়। তাদের স্বল্প পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয়।

গার্মেন্টস শ্রমিক, চিংড়ি ঘেরের শ্রমিক এবং নির্মাণ শ্রমিকদের অবস্থার যৎসামান্য উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে এখনও তারা ন্যায্য মজুরি পায় না। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানীখাত তৈরি পোষাক শিল্পে শ্রমিক নিপীড়ন, বেতন কম দেয়া, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ও নিরাপত্তাহীনতার মতো বিষয় ঘটছে। ইটভাটায় শ্রমিকদের আটকে রেখে কাজ করানোর খবর তো আমরা গত বছরই সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি। প্রতিষ্ঠিত বা ভালো শিল্প হিসেবে পরিচিত কারখানায় দিনে একজন শ্রমিককে চুক্তিভিত্তিক মাত্র দেড়শ টাকায় কাজ করানো হয়। বছরের পর বছর কাজ করেও চাকুরি স্থায়ী হয় না। এছাড়াও কাজ দেয়ার কথা বলে নারীদের নিয়ে যৌন পল্লীতে বিক্রি করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। শিশুশ্রম চলছে গার্মেন্টস, ওয়ার্কশপ, পরিবহনে। বাল্য বিয়ের ঘটনা এখনও ঘটছে।

দাসত্ব নির্মূল বা প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন কাজ। কারণ মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদেই কাজ করে এবং সেই কাজ যারা করিয়ে নেয় তারা অসহায় মানুষকে ঠকায়। কম দামে শ্রম কেনে। কিন্তু এতকিছুর পরও দাসত্ব নির্মূলের সরকারি চেষ্টা খুবই শ্লথ গতিতে চলছে। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কার্যকরি ভূমিকা রাখতে হবে। ‘আধুনিক দাসত্ব’ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে শ্রমিক এবং সাক্ষী সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার তদারকি করতে হবে। আইএলও-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ যে ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০০৬’ সংশোধন করেছে তার যথাযথ অনুসরণও জরুরি।

 

লেখক : হাবিবুর রহমান স্বপন ( সাংবাদিক, কলামিস্ট)