Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কারাগারগুলোতে মানবিক বিপর্যয় : তিল ধারণের ঠাঁই নেই

jelদেশের কারাগারগুলোতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে। এতে কারাগারগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৩ গুণ বেশি বন্দী রাখায় এখন, তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের সব কারাগারে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি বন্দী রাখা হচ্ছে।

chardike-ad

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গত শুক্রবার সকাল ১০ টা পর্যন্ত ৭ হাজার ৫শ’ ১৫ জন বন্দী ছিল। সেখানে ২ হাজার ৬’শ বন্দী রাখার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে বলে জেলার নেসার আলম শীর্ষ নিউজকে জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন ঠেকানোর জন্য গত ৬ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিনই সারাদেশে কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এ সময়ে ১৩ হাজারের বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মী ছাড়াও রয়েছে অনেক সাধারণ নিরীহ মানুষ।

এসব গ্রেফতার অভিযানের শুরুতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশের সাথে অভিযানে অংশ নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

কারা অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ জানুয়ারি দেশের ৬৮টি কারাগারে ৬৭ হাজার ৬১৪ জন বন্দী ছিলেন। এরপর তার সংখ্য বেড়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ৭১ হাজার ৮০২ জন হয়। অথচ দেশের ৬৮টি কারাগারে মোট ধারণক্ষমতা রয়েছে মাত্র ৩৪ হাজার ৪০৬ জন।

কারা কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা মতে, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বন্দী সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এ ব্যাপারে তাদের প্রস্তুতির পরামর্শ দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্দীর সংখ্য দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াতে কারাগারগুলোতে খাদ্য, চিকিৎসা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ১০০ হাজতির কক্ষে ৪০০ জনকে রাখা হচ্ছে। আর টয়লেটগুলোর অবস্থা এমন হয়েছে যে, ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে কারাগারগুলোর পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অনেক সেলে বন্দীরা রাতে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করছেন। একজনের শোয়ার জায়গায় আছেন ৫ থেকে ৭ জন। অনেকেই বাধ্য হয়েই পালা করে ঘণ্টা হিসাবে কোনোমতে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। এছাড়া, মশার উপদ্রব চরম আকার ধারণ করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারারক্ষী বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁবু টাঙিয়ে বন্দী রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও তাঁবু টাঙিয়ে বন্দী রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

অপর সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণক্ষমতা ২,৬৮২ জন হলেও শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত বন্দীর সংখ্যা ৭ হাজার ৫শ’ ১৫ জন।

প্রতিদিন কারাগারে নতুন আরো ৩০০ থেকে ৪০০ শ’ বন্দী যুক্ত হচ্ছেন। এসব নতুন বন্দীদের আমদানি সেলে যাওয়ার পর প্রধান কারারক্ষীর মনোনীত রাইটাররা বিভিন্ন দামে তাদের কিনে নিচ্ছেন।

সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিআইডি (ম্যাট) কয়েদি তোবাররক হোসেন, সিআইডি (ম্যাট) এরশাদ, রাইটার (কয়েদী) মুনসুর, কয়েদী কাউসার, কয়েদী সাক্কু, ওস্তাগার শফিক, আর সুরমা চৌকির ওস্তাগার জুবায়ের একে অপরের সাথে আতাত করে প্রতি সপ্তাহে ৩৬শ’ টাকার বিনিময়ে বন্দীদের কেনা বেচা করছেন। তবে বেশি টাকা আদায় করছেন মনসুর ও কাউসার। তাদের চাহিদা মতো টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বন্দীদের উপর চালানো হয় অমানুসিক নির্যাতন।

অপর দিকে অতিরিক্ত বন্দীর চাপ সামলাতে কারা কর্তৃপক্ষ সপ্তাহের দুই দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে কাশিমপুর কারাগারে বন্দী স্থানান্তর করছেন। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম পোহাতে হচ্ছে। মানবিক বিপর্যয়ের শিকার বন্দীরা রাতে ঠিকমতো ঘুমানোর জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সেলের ‘ইলিশ ফাইলে’ অর্থাৎ কাত হয়ে শুয়ে রাত কাটাচ্ছেন। ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শুক্রবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গণগ্রেফতারের শিকার বন্দীর সাথে স্বজনেরা দেখা করতে সকাল থেকে কারাগারের সাক্ষাৎ কক্ষে ভিড় করেন। দূর দূরান্ত থেকে আসা নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধসহ শত শত মানুষকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

কারারক্ষীদের যারা বেশি টাকা দিতে পারছেন, কেবল তারাই প্রধান লাইন ধরতে দেখা গেছে। বন্দীর স্বজনদের সাথে একাধিক কারারক্ষী প্রধান গেট দিয়ে দেখা করাতে এক হাজার ৫০০ টাকা করে দাবি করছেন। যারা দিতে রাজি হচ্ছেন, তাদেরকেই দেখা করার সুযোগ করে দিচ্ছে।

কারারক্ষীরা জানায়, প্রধান গেট দিয়ে বন্দীর মুখোমুখি দেখা করতে চাইলে এক হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা মালেক জানান, তার ছেলে কারাগারে বন্দী রয়েছেন। কারাগারের ভেতরের অবস্থা এখন খুবই খারাপ যে ভেতরে টয়লেটের পাশে অনেক বন্দীকে এখন রাত কাটাতে হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক সেল আছে যেগুলোতে বেশির ভাগ বন্দীকে ‘ইলিশ ফাইলে’ ঘুমাতে হচ্ছে।‘ইলিশ ফাইল’ সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারারক্ষী জানান, একটি সেলে যেখানে ৫০ জন আসামি থাকতে পারে সেখানেই এখন ২শ’ থেকে ৩শ’ বন্দীকে রাখা হয়। জায়গা নেই, তাই কাত করে ইলিশ মাছের মতো রাতে ঘুমাতে হয়।

কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি সেলে ধারণক্ষমতা আছে ১ হাজার ২০ জনের। আর সেখানে ১ হাজার ৪০০ জন বন্দী রয়েছে। আর কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ এ ধারণক্ষমতা ৩০০ জন থাকলেও সেখানে ১ হাজার ২০ জন বন্দীকে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

কারা সূত্র জানায়, ঢাকা কারাগারের পদ্মা, মেঘনা, মনিহার, যমুনা, সুরমাসহ বেশ কিছু সেলে অতিরিক্ত বন্দী অবস্থান করছে। বন্দীদের আমদানি ওয়ার্ডে নেয়া হয়, তখন প্রধান কারারক্ষী কাউছারের মনোনীত রাইটাররা নতুন বন্দীদের কিনে ফেলেন। প্রতি সপ্তাহের তিন হাজার ৬০০ টাকা, ‘৯০ সেল’র জন্য ৬০০০ টাকা, আর মেডিকেলে থাকার জন্য ১০ হাজার টাকা। এছাড়া খাবারের অতিরিক্ত টাকা স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে বলে সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের এক সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারি থেকে ১ হাজার ৪৯টি যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। আর ১৮৯টিতে পেট্রলবোমা হামলা চালানো হয়েছে। সরকারি-বেসরকারিসহ মোট ২২ টি প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গত বুধবার পর্যন্ত ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। আর ৫০৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ২ জন পুলিশ সদস্যও নিহত হয়েছে। ২৭৩ জন পুলিশ আহত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামেই ১০৪ জন আহত হয়েছে। আর ক্রসফায়ারের ঘটনায় মোট ১৯ জন নিহতসহ মোট ৮৭ জন মারা গেছেন।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নেসার আলম শীর্ষ নিউজকে জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৬’শ বন্দীর ধারণ ক্ষমতা রয়েছে।

শুক্রবার সকাল পর্যন্ত দেখা যায়; ৭ হাজার ৫শ’ ১৫ জন বন্দী রাখা হয়েছে। তবে তিনি বলেন, এখন বন্দী বেশি হলেও আমাদের তেমন সমস্যা হচ্ছে না। এর আগে গণগ্রেফতারের সময় ১১ হাজার বন্দী রাখা হয়েছিল বলে জেলার জানিয়েছেন। শীর্ষ নিউজ।